শেষ আপডেট: 2nd April 2024 12:05
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: কোনও এক হিমেল সকালে, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আপনার গাড়ি শুভম রোড, সাহুডাঙ্গি রোড, আমবাড়ি ক্যানাল রোড পেরিয়ে ছুটে চলবে, অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যে ঠাসা গজলডোবা রোড ধরে। গেট বাজারে এসে আপনার গাড়ি ধরবে ডানদিকে নেমে যাওয়া বেলাকোবা রোড। পেরিয়ে যাবে মান্তাদারি, চৌধুরী মোড় ও মালিভিটা। এগিয়ে আসবে শাল, সেগুন, চিলাউনি, গামার, চিকরাসি, লালি, পানিসাজ, শিমুল, খয়ের, শিশু গাছে ঘেরা বৈকুণ্ঠপুর অরণ্য।
যে অরণ্যের পশ্চিমে বইছে মহানন্দা, পূর্বে তিস্তা। যে অরণ্যের বুকে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় বার্কিং ডিয়ার, হগ ডিয়ার, গাউর, চিতল হরিণ, বুনো শুয়োর, গন্ডার, বানর, প্যাঙ্গোলিন ও নানান প্রজাতির সাপ। এই বৈকুণ্ঠপুর অরণ্যের গা ছমছমে পরিবেশে বিরাজ করেন, বাঙালির কাছে প্রায় অচেনা এক দেবী। মা পার্বতীর অবতার দেবী ভ্রামরী।
জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে, আপনার গাড়ি এসে থামবে এসে বোদাগঞ্জ এলাকার শালবাড়ি গ্রামে। দূর থেকে দেখা যাবে আরণ্যক পরিবেশে থাকা উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটি আটচালা ও লাল রঙের তিনটি একচালা মন্দির। বুঝবেন আপনি পৌঁছে গিয়েছেন, ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে সবচেয়ে অপরিচিত শক্তিপীঠ ত্রিস্রোতায় (Trisrota Maa Bhramari Sakti Peeth)। পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে এই ত্রিস্রোতাতেই পতিত হয়েছিল সতীর বাম পা। নদীর তিনটি স্রোতের মাঝে অবস্থান করায়, এই শক্তিপীঠের নাম ত্রিস্রোতা। যে পীঠে ভৈরব জল্পেশের(অম্বর) সঙ্গে বিরাজ করেন মা ভ্রামরী।
প্রবেশদ্বার পেরিয়ে মূল মন্দিরের দিকে এগিয়ে গিয়েছে সিমেন্ট বাঁধানো আঁকাবাঁকা পথ। বাম দিকে গাড়ি রাখার জায়গা। আশপাশে থাকা দোকানগুলিতে বিক্রি হচ্ছে পুজোর ডালা। পথ আপনাকে নিয়ে যাবে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি শেডের কাছে। সেখান থেকেই সিঁড়ি পথ নেমে গিয়েছে লাল রঙের মূল মন্দিরটির দিকে। মন্দিরের বাইরে আছে মাথায় মাথায় জুড়ে যাওয়া দুটি বট গাছ। যে গাছদুটির গুঁড়িতে ভক্তেরা পরিয়ে যান মানতের সুতো। মন্দিরের দালানে রাখা আছে দেবী পার্বতীর বিভিন্ন রূপের প্রতিমা । তারই মধ্যে আপনার নজর কাড়বে তিব্বতি আঙ্গিকে নির্মিত একটি প্রতিমা। মা ভ্রামরীর দরবারে প্রবেশের আগে প্রতিমাগুলিকে ভক্তিভরে প্রণাম করেন ভক্তের দল।
মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করা মাত্রই, আপনার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠবে। কারণ আপনার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন কৃষ্ণবর্ণা, ষড়ভূজা এক দেবী। সর্বা অলঙ্কার বিভূষিতা। মাথায় সোনার মুকুট। পরনে রক্তলাল শাড়ি। ইনিই দেবী ভ্রামরী। দেবীর পদতলে শুয়ে আছেন ভৈরব জল্পেশ। দেব ও দেবীকে বহন করছে এক ভয়ঙ্কর সিংহ। ত্রিস্রোতা মাতা ভ্রামরীর মূর্তির সামনেই সতীর সিঁদুর রঞ্জিত বাম পা। ধীরে ধীরে আপনাকে তাঁর মায়াজালে জড়িয়ে নেবেন মা ভ্রামরী। তাঁর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারবেন না আপনি। মনে জাগবে সেই অমোঘ প্রশ্ন, "কে এই দেবী ভ্রামরী?"
দেবী ভাগবত পুরাণ ও দেবীমাহাত্ম্যম্ থেকে জানা যায়, বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে গঙ্গার তীরে ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করেছিলেন অসুররাজ অরুণাসুর। অবিরাম গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে করতে কাটিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার বছর। অরুণাসুরের দেহ থেকে নির্গত হয়েছিল অপরিমিত তেজরাশি। প্রচণ্ড উত্তাপে দগ্ধ হতে শুরু করেছিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড।
ভক্তের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিলেন ব্রহ্মা। অরুণাসুরকে বর দিয়ে বলেছিলেন, "তোমাকে হত্যা করতে পারবে না বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনও দুই বা চার পা যুক্ত প্রাণী, দেবতা, অসুর, দানব, ভুত, প্রেত, পিশাচ।" ব্রহ্মার বরে বলীয়ান অরুণাসুর দেবতাদের যুদ্ধে হারিয়ে দখল করে নিয়েছিলেন অর্ধেক স্বর্গ। অরুণাসুরের তেজের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন ব্রহ্মা ও বিষ্ণু। দেবতারা তখন গিয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে।
খবর পেয়ে কৈলাশ আক্রমণ করেছিলেন অরুণাসুর। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ব্রহ্মার রক্ষাকবচ থাকায় মহাদেবের পক্ষেও অরুণাসুরকে হত্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন মহাদেব আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আদি পরাশক্তির অবতার মা পার্বতীকে। সুবিশাল পর্বতের মত দেহ নিয়ে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন মা পার্বতীর এক ভয়ঙ্কর অবতার দেবী ভ্রামরী। কৃষ্ণবর্ণা দেবীর ত্রিনয়নে বিরাজ করছিলেন চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি। দেবী বিশ্বগ্রাসী মুখ গহবর ও ছ'টি হাতের মুঠো থেকে নির্গত হতে শুরু করেছিল কোটি কোটি মৌমাছি, ভিমরুল, বোলতা, উই, মশা মাকড়সা। পতঙ্গগুলির ছ'টি করে পা। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন অরুণাসুর।
কোটি কোটি পতঙ্গ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসুরবাহিনীর ওপর। মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছিল অরুণাসুরের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী। অরুণাসুর তখন রণক্ষেত্রে একা। দেবী ভ্রামরীর নির্দেশে অরুণাসুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পতঙ্গের দল। আকাশ কালো করে ধেয়ে আসা পতঙ্গদের সম্মিলিত আক্রমণে ধরাশায়ী হয়েছিলেন অরুণাসুর। অসুররাজের মাংস, মজ্জা, মেদ কুরে কুরে খেয়েছিল পতঙ্গের দল। দেবী ভ্রামরীর অট্টহাসিতে কেঁপে উঠেছিল মেদিনী। সেই দিন থেকে ত্রিলোকে শুরু হয়েছিল মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গদের দেবী, মা ভ্রামরীর পুজো। যাঁর দেহে বসে থাকে কোটি কোটি মৌমাছি।
বোদাগঞ্জের ত্রিস্রোতা শক্তিপীঠে ভক্তদের জন্য খোলা থাকে দিবারাত্র। তিস্তা নদীতে স্নান করে, নতুন বস্ত্র পরে মন্দিরে আসেন ভক্তের দল। মন্দিরে জাগ্রতা দেবী ভ্রামরীর নিত্যপূজা অনুষ্ঠিত হয়।এছাড়া প্রতি মঙ্গল, শনি, রবি, অমাবস্যা ও পুর্ণিমায়, দুপুর একটায় দেবীকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। শরৎকালে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজা ও কালীপূজা। মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে হয় মা ভ্রামরীর বিশেষ পুজো। এই সময় মন্দির প্রাঙ্গণে চারদিনের মেলা বসে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেক আসেন সাধু সন্ন্যাসী ও ভক্তের দল।
তবুও ভক্তদের মনে বাস করে এক আকাশছোঁয়া আক্ষেপ। ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠ ত্রিস্রোতা আজও অবহেলিত। অন্যান্য শক্তিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীদের তুলনায় মা ভ্রামরী আজও সবচেয়ে অচেনা। প্রতি বছর গজলডোবার অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অবগাহন করতে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। তাঁদের এক শতাংশও আসেন না ত্রিস্রোতা মাতা ভ্রামরীকে দর্শন করতে। এলে হয়ত এই অচেনা জাগ্রতা দেবীর আখ্যান ছড়িয়ে পড়ত দিকে দিগন্তরে।