Latest News

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লেখেন ‘বাংলাদেশ’, উর্দু কবি কাইফি আজমি কেমন মানুষ ছিলেন

শ্যামলেশ ঘোষ

তখন সেই ভূখণ্ড পরিচিত পূর্ব পাকিস্তান নামে। সেই ভূখণ্ডের অগণিত মানুষ মুক্তির দাবিতে তুচ্ছ করছে মৃত্যুকে। মুক্তিকামী বাংলাভাষীদের ওপর উর্দুভাষী পাকিস্তানি শাসকের ভারি বুট, বন্দুক, বুলেট, বেয়নেট বইয়ে দিচ্ছে রক্তপদ্মা। আর ভারতে বসে যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মানো, আমৃত্যু মার্কসীয় দর্শনে অবিচল এক উর্দু কবি। লিখে ফেলছেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কবিতা। শিরোনাম, ‘বাংলাদেশ’। মানুষের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। মনে করতেন, কোনও শাসক-শক্তিই সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তিকে পরাস্ত করতে পারে না। সাধারণের শুধু ইতিহাস আছে, ভূগোল নেই। আদতে মানুষের তৈরি কোনও ভৌগোলিক সীমারেখায় বিশ্বাস করতেন না তিনি। তিনি কবি কাইফি আজমি। সমাজতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন দেখা সেই কবিকে জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছে গুগল।

অবশ্য জন্মদিনে তাঁর জন্মস্থান ‘বদলে যাওয়া’ উত্তরপ্রদেশে বা ভারতে তাঁকে নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই! কেন? সে আলোচনার পরিসর এখানে নেই। আমরা বরং সেই প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে ভাষা যোগানো কবির জীবন ও লক্ষ্য সম্পর্কে জেনে নিই। কাইফি আজমি নামেই তাঁর পরিচিতি। আসল নাম সৈয়দ আতাহার হোসেন রিজভি। জন্মেছেন উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের এক জমিদার পরিবারে। আজমগড় নিবাসী, তাই ‘আজমি’। চলে এসেছিলেন মুম্বাইতে। স্বাধীনতাকামী ভারতে ১৯১৯-এর ১৪ জানুয়ারি জন্ম, মৃত্যু স্বাধীনোত্তর ভারতে ২০০২-এর ১০ মে। বলতেন, ‘পরাধীন ভারতে জন্মালাম, স্বাধীন ভারতে বড় হলাম আর মরতে চাই সমাজতান্ত্রিক ভারতে।’ সেই স্বপ্নকে বুকে আঁকড়েই বিদায় জানিয়েছেন পৃথিবীকে। কবির বামপন্থী উত্তরসূরিরা কি তাঁর সেই স্বপ্ন ভুলেছেন?

সব স্বপ্ন যে একজীবনে পূরণ হবার নয়, এ সত্যও নিশ্চিত জানতেন। তাই লেখায়-কথায় ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে বুনে গিয়েছেন অনন্ত সম্ভাবনার বীজ। লিখে রেখে গিয়েছেন অমর সব কাব্য-কবিতা। তাঁর অসাধারণ সে সব সৃষ্টি আজও দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। ‘কর চলে হাম ফিদা জান-ও-তন সাথিয়ো, অব তুমহারে হাভালে ওয়াতন সাথিয়ে।’ গানটা মনে পড়ছে? ১৯৬২-তে চিনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছে ভারত। মুষড়ে পড়া ভারতবাসীকে দেশাত্মবোধে জাগ্রত করল ১৯৬৪-তে চেতন আনন্দের ‘হকিকৎ’ ছবিতে মুহাম্মদ রফির কণ্ঠের এই গান। আবার, ‘পাকিজা’ ছবির  ‘চলতে চলতে ইউহি কোয়ি মিল গয়া থা’ কিংবা ‘অর্থ’ ছবির ‘তুম ইতনা যো মুসকরা রহে হো’, ‘ঝুকি ঝুকি সি নজর’-এর মত কালজয়ী গানে মজেননি, এমন প্রেমিক ভূ-ভারতে বিরল। বিশ্বজোড়া ছড়িয়েছে সে রোমান্টিসিজমের দীপ্তি।

গজল লেখার সাধনা তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। সিনেমার জন্য গান লেখার পাশাপাশি পঞ্চাশের দশকে লিখেছেন অনেক চিত্রকাহিনিও। দেশভাগের ওপর নির্মিত ১৯৭৩-এ এম এস সত্থ্যুর ‘গরম হাওয়া’ সিনেমার কাহিনি-সংলাপ তাঁরই অনবদ্য সৃষ্টি। ‘ঝংকার’ তাঁর প্রথম কাব্যসংকলনের নাম, যা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৪৪-এ। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আখিরে-শব (১৯৪৭), আওয়ারা সাজদে (১৯৭৩), মেরি আওয়াজ শুনো (১৯৭৪), ইবলিস কি মজলিস-এ-শোরি (১৯৮৩) প্রভৃতি। নারী অধিকারের পক্ষে, জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতায় অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ‘আউরত’, ‘মকান’, ‘বহুরূপনী’, ‘দাইরা’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ‘ম্যায় আউর মেরি শায়েরি’ নামক দীর্ঘ প্রবন্ধে তাঁর জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে, তা যেন আত্মজীবনীর অংশ।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবনভর পেয়েছেন দেশবিদেশের নানা সম্মান। সেই পুরস্কারের ঝুলিতে রয়েছে সাহিত্য একাডেমি থেকে পদ্মশ্রী। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ও দিয়েছে সাম্মানিক ডক্টরেট। পেয়েছেন বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ও। কিন্তু দেশ আজ তাঁর জন্মদিনে আশ্চর্য নীরব! আমরা বিশ্বাস করি, কাইফির উদ্ধৃতির চেয়ে বড় কোনও শ্রদ্ধাঞ্জলি নেই। তাই তাঁর ‘বাংলাদেশ’ কবিতার অংশ রইল পাঠকের জন্য। ‘শুধু তো একটি দেশ নই যে জ্বালিয়ে দেবে/ প্রাচীর নই যে তা একেবারে ধসিয়ে দেবে/ সীমান্তও নই যে তা পুরোপুরি মুছে ফেলবে/… …/ খয়রাতে পাওয়া ট্রাঙ্ক নিয়ে আমার দিকে ধেয়ে আসছ/ রাতদিন নাপাম বোমার বৃষ্টি বর্ষাচ্ছ/ … …/ শৃঙ্খল পরাবে তুমি কোন হাতে/ হাত তো আছে আমার সাত কোটি/ গর্দান থেকে কোন মাথাটি তুমি আলাদা করবে/ সেখানে তো মাথা আছে সাত কোটি।’

You might also like