
The Yakuza
রূপাঞ্জন গোস্বামী
১১ মার্চ, ২০১১
দুপুর দুটো বেজে ছেচল্লিশ মিনিট। প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে হয়েছিল এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৯.০-৯.১। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল জাপানের টোহোকু এলাকার ওশিকা উপদ্বীপ থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। জাপানের ইতিহাসের সবথেকে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি চলেছিল প্রায় ছ’মিনিট ধরে। ভূমিকম্পের অভিঘাতে এসেছিল ভয়ঙ্কর সুনামি। ১৩০ ফুট উঁচু ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উত্তর পূর্ব জাপানের সমুদ্র ঘেঁষা শহরগুলিতে। সুনামির ঢেউ প্রবেশ করেছিল ভূখণ্ডের দশ কিলোমিটার ভেতরে। প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৯৭৪৭ জন জাপানবাসী। খোঁজ মেলেনি ২৫৫৬ জনের।

প্রলয়কাণ্ড থামার পর চারদিকে উঠেছিল কান্নার রোল। কাদার ভেতর ডুবে থাকা গাড়ি ও ভাঙা জাহাজের সঙ্গেই রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়েছিল হাজার হাজার মানুষ ও পশুর লাশ। ভাগ্যবলে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা আশ্রয়, সামান্য জল ও খাবারের জন্য উন্মাদের মত ছুটে বেড়াচ্ছিলেন এদিক ওদিক। শুরু হয়েছিল প্রবল তুষারপাত। এক ঘণ্টা কেটে গেলেও আসেনি কোনও সরকারি সাহায্য। খোলা আকাশের নীচে ঠান্ডায় জমতে শুরু করেছিলেন শহরগুলির মানুষেরা।
ঠিক তখনই একে একে এসে থেমেছিল টন টন ত্রাণ সামগ্রী বোঝাই ট্রাক। মাস্ক পরা কয়েক হাজার যুবক এসে অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিল খাবার, জল, ওষুধ, কম্বল ও তাঁবু। শক্তপোক্ত চেহারার যুবকগুলির পরনে ছাই রঙের প্যান্ট ও সাদা ফুলহাতা শার্ট। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যুবকগুলি উদ্ধার করতে শুরু করেছিল তখনও বিপদে থাকা শহরবাসীদের। তাদের সঙ্গে আসা চিকিৎসকেরা শুরু করেছিলেন প্রাথমিক চিকিৎসা। আকাশে উড়ছিল অগুনতি হেলিকপ্টার। ভেতরে বসে ত্রাণ কার্য্যের ওপর কড়া নজর রাখছিলেন কিছু সুবেশ জাপানি পুরুষ।

জাপান সরকারের ত্রাণ এসেছিল পাঁচ ঘণ্টা পরে। কিন্তু তার আগেই শহরগুলির বাসিন্দাদের অনেকটা গুছিয়ে দিয়ে যুবকগুলি হারিয়ে গিয়েছিল শহরের রাজপথে। জাপানি সেনারা এসে দেখেছিল, তারা আসার আগেই তাদের কাজ করে দিয়ে গিয়েছে ‘জাকুজা’ (The Yakuza)। চার শতাব্দী ধরে জাপানের হাড় হিম করে দেওয়া মাফিয়া সংগঠন। জাপানের বিপদে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাদের দেখা গিয়েছে। একবার নয় বার বার।

অন্যায়ের প্রতিবাদে তৈরি হয়েছিল জাকুজা (The Yakuza)
সতেরো শতাব্দীর শুরু থেকেই জাপান চলে গিয়েছিল সামরিক সরকারের হাতে। স্বেচ্ছাচারী সেনাপতি টোকুগাওয়া ইয়েসাসুর নেতৃত্বে দেশ চালাচ্ছিলেন ডামিও জমিদার ও সামুরাই যোদ্ধারা। সেই সময় জাপানে ছিল বুরাকুমিন নামে এক প্রান্তিক সম্প্রদায়। জাপানের অভিজাত সমাজের কাছে ছিল সম্প্রদায়টি ছিল অস্পৃশ্য। কারণ বুরাকুমিনেরা জল্লাদ,কসাই, ডোম, ও চামড়া পরিষ্কার করার কাজ করত। ভালো খাওয়া বা পরার অধিকার তাদের ছিল না।
পরিস্থিতি চরমে উঠেছিল ১৬০৩ সালে। আইন করে সমাজ থেকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল বুরাকুমিনদের। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল চিরাচরিত পেশাগুলিও। চরম বিপদে পড়েছিল বুরাকুমিন সম্প্রদায়ের কয়েক লক্ষ মানুষ। এক মুঠো খাবার জোগাড় করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাধ্য হয়ে বুরাকুমিন যুবকেরা বেছে নিয়েছিল অন্ধকার জগত। ১৬০৩ সালে জাপানের কিউসু দ্বীপে গঠিত হয়েছিল মাফিয়া সংগঠন ‘জাকুজা’। জাপানি ভাষায় শব্দটির অর্থ হল ‘চরম পথ’। সদস্যরাও পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন জাকুজা নামেই। চোরাচালান ও চুরি ডাকাতি দিয়ে শুরু হয়েছিল অন্ধকার জগতে জাকুজার পথ চলা। ধনীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অর্থ বিলিয়ে দেওয়া হত গরিব বুরাকুমিন পরিবারগুলির মধ্যে। কিছুদিনের মধ্যেই অসহায় বুরাকুমিনদের নয়নের মণি হয়ে গিয়েছিল জাকুজারা। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এই মাফিয়া দলের সদস্যদের চেনা যেত, অদ্ভুত পোশাক আশাক, চুলের ছাঁট চুল ও নৃশংস ভাবমূর্তির জন্য।

অন্ধকার জগতে ক্রমশ ডালপালা মেলতে শুরু করেছিল ‘জাকুজা‘
যাত্রা শুরু কয়েক বছর পরেই দুটি উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল ‘জাকুজা’। একটি হল ‘টেকিয়া’। যেটি সারা জাপান জুড়ে চোরাচালান ও ডাকাতি করত। অন্যটি হল ‘বাকুটো’। যেটি জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত মন্দির ও ধর্মস্থানগুলিতে চালাত অবৈধ জুয়ার ঠেক। উল্কাগতিতে বাড়তে শুরু করেছিল সংগঠনের রোজগার। জাপানের বিভিন্ন দ্বীপে যাত্রা শুরু করেছিল আলাদা আলাদা ‘জাকুজা’ সংগঠন। আলাদা হলেও, উপস্থিত ছিল আত্মিক টান। কারণ প্রথম দিকে জাকুজাদের লড়াই ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। অত্যাচারের বদলা নেওয়াই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
জাকুজাদের সংগঠিত ও ক্ষুরধার আক্রমণের সামনে নাস্তানাবুদ হতে শুরু করেছিল জাপানের সামন্ত প্রভুরা। বাধ্য হয়ে শাসকেরা জাকুজা সংগঠনগুলির নেতাকে দিয়েছিল সামাজিক স্বীকৃতি। নেতাদের নামের পাশে বসেছিল ওয়াবান (প্রধান) পদবী। ওয়াকিজাশি ও সামুরাই তরবারি বহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ‘জাকুজা’ প্রধানদের। যে তরবারি বহনের একমাত্র অধিকারী ছিলেন সে যুগের সবথেকে অভিজাত সম্প্রদায় ও সামুরাই যোদ্ধারা। এভাবেই বুরাকুমিন সমাজের জন্য সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন অন্ধকার জগতের বাসিন্দা জাকুজা যুবকেরা। যে সমীহ মাথা খুঁড়েও মেলেনি শতাব্দীর পর শতাব্দী। এরপর মহাপরাক্রমশালী মাফিয়া গ্যাং হিসেবে গড়ে উঠতে জাকুজার বেশিদিন সময় লাগেনি।

জাকুজা সংগঠনের গঠনতন্ত্র জটিল
‘জাকুজা’ আজ কোনও একক মাফিয়া সংগঠন নয়। বিশ্বের সবথেকে ধনী ও শক্তিশালী মাফিয়া সংগঠন জাকুজার ছাতার নীচে আছে প্রায় চব্বিশটি মাফিয়া সিন্ডিকেট। সম্মিলিত সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। প্রধান সিন্ডিকেট চারটি। এগুলির হল ইয়ামাগুচি-গুমি, সুমিয়োশি-কাই, ইনাগাওয়া-কাই, আইজুকোটেৎসু-কাই। সিন্ডিকেটের নাম শুরু হয় সিন্ডিকেটের স্রষ্টার পদবী দিয়ে। ইয়ামাগুচি-গুমি হল সবথেকে বড় ‘জাকুজা’ গ্যাং। জাপানের বন্দর শহর কোবেতে, ১৯১৫ সালে, সিন্ডিকেটটি তৈরি করেছিলেন গডফাদার হারুকিচি ইয়ামাগুচি। আজ সদস্য সংখ্যা ৫৮০০০।
প্রতিটি ‘জাকুজা’ সংগঠনের সর্বোচ্চ পদে থাকেন গডফাদার ‘কুমিচো’। তাঁর এক কথায় হাসতে হাসতে জীবন দিতে ও নিতে পারেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কুমিচোর ঠিক পরবর্তী ধাপে আছে সাইকো-কোমোন (প্রবীন উপদেষ্টা) ও সো-হনবুচো (সদর দফতরের প্রধান) পদগুলি। যেগুলিতে রাখা হয় দলের সবথেকে পুরোনো ও পোড়খাওয়া জাকুজাদের।
পরবর্তী ধাপে আছেন অসংখ্য ‘ওয়াকাগাশি’। যাঁরা বিভিন্ন এলাকায় ‘গ্যাং’ চালান। তাঁদের সাহায্য করেন ফুলি-হনবুচোরা। যাঁদের হাতে থাকে অবৈধ কাজগুলি করানো মূল দায়িত্ব। এছাড়াও একটি ‘জাকুজা’ সিন্ডিকেটের অধীনে থাকে অসংখ্য ছোট ছোট মাফিয়া দল, স্থানীয়ভাবে দলগুলি চালান স্থানীয় প্রধান ‘শাতেইগাশি’ বসেরা।

এভাবে হতে হয় জাকুজার সদস্য
‘জাকুজা’ সংগঠনের সদস্যদের বেছে নেওয়া হয় এক কঠিন ও গোপন পদ্ধতিতে। সেটির নাম ওয়াবুন-কবুন। একমাত্র পরিবার ও সমাজ পরিত্যক্ত সাহসী যুবকদেরই নেওয়া হয় এই ভয়ঙ্কর সংগঠনে। শারীরীক অত্যাচার সহ্য করার পরীক্ষায় নবাগত সদস্য উত্তীর্ণ হল পালিত হয় ওয়াবুন-কবুন প্রথা। এই গোপন অনুষ্ঠানে নবাগত সদস্য বা কবুনের সঙ্গে মিলিত হন ওয়াবুন ( পালক পিতা)। একই পেয়ালা থেকে সুরা পান করেন ওয়াবুন ও কবুন। সুরা পান করার পরের মুহূর্ত থেকেই নবাগত জাকুজা তাঁর মাফিয়া পিতার সন্তান হয়ে যান। পিতার যেকোনও আদেশ পালন করা নবাগত জাকুজার একমাত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: আটলান্টিকে ভাসছে অভিশপ্ত দ্বীপ, বুনো ঘোড়া ও তিনশো জাহাজের শব নিয়ে
দলের প্রবীন সদস্যরা হন নবাগত জাকুজার দাদা। যাঁরা পরবর্তীকালে গ্যাংয়ে যোগ দেবেন, তাঁরা হবেন নবাগত জাকুজার ভাই। পুরুষ শাসিত ‘জাকুজা’ সিন্ডিকেটে থাকেন অল্পসংখ্যক নারীও। তাঁরা সংগঠনের উচ্চপদস্থদের স্ত্রী। তাঁদের বলা হয় আনে-সান (বড় দিদি)। তাঁদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলে না, জাকুজারা। এভাবেই পৃথিবীর নৃশংসতম অপরাধ পরিবারের সদস্য হয়ে যান, সমাজ ও পরিবার হারিয়ে ফেলা কোনও অসহায় যুবক।

পালটে যায় চেহারা, পালটে যায় মন
জাকুজা হওয়ার পর বাধ্যতামূলকভাবে বদলে নিতে হয় চেহারা। গোঁফ দাড়ি রাখা নিষেধ। চুল হবে ‘কদম ছাঁট’। বাঁশের সূঁচালো ডগা দিয়ে সর্বাঙ্গে এঁকে দেওয়া হয় জাকুজাদের উল্কি ‘ইরেজুমি’। কিন্তু দেখানো চলবে না উল্কিগুলি। তাই নবাগত জাকুজাদের বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হয় ফুল হাতা জামা ও ফুল প্যান্ট।
এরপর নবাগত জাকুজাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনও অজ্ঞাতস্থানে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ধ্যান ও অস্ত্রচালনার। মগজে গেঁথে দেওয়া হয় জাকুজার নিজস্ব গোপন নীতি ‘জিনগি’ ও ‘নিনকিও কোড’। একসঙ্গে বাঁচা ও মরার শপথ নেয় নবাগত জাকুজা। প্রশিক্ষণে সফল হলে, কোনও গুপ্তহত্যা দিয়ে অপরাধ জীবন শুরু করে নবাগত জাকুজা।

ভুলের মাসুল ভয়ঙ্কর
নবাগত জাকুজার ভরণপোষণের সব দায়িত্ব নিয়ে নেয় সিন্ডিকেট। শুরু হয় বিলাসবহুল জীবন।পুলিশের হাতে ধরা পড়লে দেওয়া হয় উকিলের খরচ। মোটা ঘুষ দিয়ে জেলের ভেতর পাঠানো হয় ভাল খাবার, দামী মদ ও সিগারেট। প্রয়োজনে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় জেল থেকে পালানোরও। সে জন্য সমুদ্রবক্ষে সর্বদা প্রস্তুত থাকে জাকুজাদের দ্রুতগামী জাহাজ। প্রস্তুত থাকে অগুনতি জেট ও হেলিকপ্টারও।
তবে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পাশপাশি নবাগত সদস্যদের জানিয়ে দেওয়া হয়, দলের ভয়াবহ প্রথা ইউবিৎসুমির কথা। জাকুজাদের জগতে ভুলের মাসুল দেওয়ার প্রাথমিক শাস্তি হল ‘ইউবিৎসুমি’। ওয়াবান ডেকে পাঠান সংগঠনের নাম ডোবানো সদস্যকে। নিজের বাম হাতের কড়ে আঙুলের ডগা ছুরি দিয়ে কেটে প্লেটে করে ওয়াবুনকে উপহার দেন ভুল করে ফেলা সদস্য। এরপর যতবার ভুল হবে কেটে ফেলতে হবে ততগুলি আঙুলের ডগা। তবে বাঁচার সুযোগ পাওয়া যাবে মোট দশবার। তারপর চলে যাবে জীবনটাই।

কীভাবে বিশ্বের সবথেকে ধনী মাফিয়া সংগঠন হল ‘জাকুজা’!
কেবলমাত্র চোরাচালান ও জুয়া ব্যবসায় সীমাবদ্ধ নয় আজকের ‘জাকুজা’। সুদে টাকা খাটানো, অর্থের বিনিময়ে নিরাপত্তা দেওয়া, ব্ল্যাকমেল, জমি জবর দখল, তোলা আদায়, ড্রাগ ব্যবসা, নারী পাচার ও সুপারি নিয়ে বিশ্বজুড়ে খুন করা সহ, প্রায় সব ধরণের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত জাকুজা। এছাড়াও জাকুজাদের আছে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, জাহাজের ব্যবসা, তিমির তেল ও ডলফিনের মাংসের ব্যবসা, হোটেল, বার, ক্যাসিনো, ম্যাসেজ পার্লার ও নিষিদ্ধপল্লী।
বেনামে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে জাকুজার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি। তাই এই জাকুজাদের কথায় ওঠে বসে বিশ্বের অনান্য দেশের মাফিয়া সংগঠনগুলি। বিভিন্ন দুর্বল দেশে সরকার গড়া ও ফেলার কাজও বরাত নিয়ে করে জাকুজারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত আছে জাকুজাদের টাকায় চলা প্রায় পাঁচ হাজার কোম্পানি।

তবুও চুপ কেন শান্তির দেশ জাপান!
জাপান ১৯৯১ সালে জাকুজা বিরোধী আইন তৈরি হয়েছিল। আমেরিকার চাপে ২০১৩ সালে বাজেয়াপ্ত করেছিল জাকুজার কিছু সম্পদ। কিন্তু তা মোট সম্পদের কণামাত্র। আসলে জাপানের করণীয় নেই কিছুই। কারণ একসময় জাকুজার পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়েছিল খোদ জাপান। আধুনিকীকরণের সময় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, রেল লাইন, বিমান বন্দর ও নতুন শহর গড়ার জন্য জাপান সরকারের দরকার ছিল প্রচুর জমি। পেশিশক্তির সাহায্যে সে জমি আদায় করে দিয়েছিল জাকুজারাই।
এখনও গোপনে জাকুজাদের সাহায্য নেয় জাপান। বিভিন্ন সেনা অভিযানে জাপানি সেনার পাশাপাশি লড়ে জাকুজারাও। জাকুজাদের ওপর কতটা নির্ভরশীল ছিল জাপান তা একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার জাপানে এসেছিলেন ১৯৬০ সালে। জাপানে থাকা কালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার ভার জাপান দেয়নি তার সেনাবাহিনীকে। তুলে দিয়েছিল জাকুজাদের হাতে।
এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সহ দেশের যেকোনও বিপর্যয়ে বার বার গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসেছে জাকুজারা। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য। তাই জাপানের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই জাকুজারা আজ পায় রবিনহুডের মর্যাদা ।

এক মসৃণ ‘জাকুজা’ অপারেশন
অনেক বছর ধরে চেষ্টা করার জাকুজার অন্দরমহলে পর ঢুকতে পেরেছিলেন বেলজিয়ামের চিত্রগ্রাহক অ্যান্টন কাস্টার। তিনি জানিয়েছিলেন হাড়হিম করে দেওয়া এক ‘জাকুজা’ অপারেশনের কথা। এক সন্ধ্যায় টোকিওর একটি বারে বসেছিলেন অ্যান্টন। বারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল একদল যুবক। সংখ্যায় তারা ছিল জনা পনেরো। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, অপরাধ জগতের সঙ্গে আছে তাদের যোগাযোগ। বারের মহিলা কর্মীদের সঙ্গে অশোভনীয় আচরণ করছিল তারা। ভাঙচুর করছিল মদের বোতল ও গেলাস। তবুও চুপ ছিলেন বারের কর্মীরা। কারণ পুলিশকে বলেও লাভ হয়নি।
কোনার টেবিলে বসেছিলেন এক প্রৌঢ় জাপানি। ধবধবে সাদা ফুল হাতা জামা। বোতামগুলি সোনার। জেল লাগানো চুল। পায়ে দামী লেদারের শু। চোখে দামি রোদ চশমা পরা। অনামিকায় হিরের আংটি। বারের নারকীয় পরিবেশের মধ্যেও শান্তভাবে চুমুক দিয়ে যাচ্ছিলেন দামি সুরার গেলাসে। মুখে ছিল মিষ্টি হাসি। একসময় তিনি মোবাইলে কী যেন টাইপ করেছিলেন। তারপর তাকিয়েছিলেন দরজার দিকে।

সেই মুহূর্তেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করেছিল জনা কুড়ি জাপানি যুবক। পরণে সাদা শার্ট, ছাই রঙের কোট ও প্যান্ট।গলায় টাই, জেল লাগানো চুল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, কুড়িটি সাইলেন্সার লাগানো অটোমেটিক রিভলভারের ম্যাগাজিন খালি হয়ে গিয়েছিল। পরিবেশকে নরক করে তোলা যুবকগুলির তাজা রক্তে ভেসে গিয়েছিল বারের মেঝে।’
কাঁপতে থাকা দেহগুলি নিথর হওয়ার পর, সুবেশ ও সুদর্শন যুবকগুলি একসাথে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল তখনও টেবিলে বসে হাসতে থাকা প্রৌঢ় মানুষটিকে। হাত তুলে তাদের অভিবাদন জানিয়েছিলেন প্রৌঢ়। তারপর গেলাসের নীচে কয়েকশ ডলার রেখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বার থেকে। উল্কাগতিতে বারের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ঝাঁ চকচকে লিমুজিন। তারপর গডফাদারকে নিয়ে উল্কাগতিতেই গাড়িটি হারিয়ে গিয়েছিল ভিড়ে ঠাসা টোকিও শহরের কোনও অন্ধকার গলিতে।
