Latest News

‘সবচেয়ে অসুখী বোধ করছিলাম, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় পুকুর চুরির মতো ব্যাপার ঘটছিল বলে’

অমল সরকার

‘প্রচুর যোগ্যতাহীনকে এখানে-ওখানে ঢোকানোর উৎসাহে অন্ত নেই। শিক্ষায়, পরিবহণে, স্বাস্থ্য বিভাগে, সংস্কৃতি দপ্তরে আরও নানা জায়গায়। সবচেয়ে অসুখী বোধ করছিলাম, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় পুকুর চুরির মতো ব্যাপার ঘটছিল বলে।’– এটুকু লিখেই তিনি থামেননি। বরং বামফ্রন্ট সরকারের অনিয়মের ঝাঁপি খুলে দিয়ে বেআব্রু করে দিয়েছিলেন তিনি।

sot montri

তিনি এও লিখেছিলেন যে, ‘শিক্ষক নিয়োগে প্রতিভাবান, মেধাবী, পরীক্ষায় চমৎকার ফল দেখানো প্রার্থীদের দূরে সরিয়ে পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত মানুষজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া, নির্বাচকমণ্ডলীতে পছন্দমত লোক মনোনয়ন করে তাঁদের দিয়ে পছন্দের প্রার্থী বাছাই, কখনও কখনও নির্বাচকমণ্ডলীর রায় পছন্দ না হলে নিয়োগের ব্যাপারটি মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা, পুরনো নির্বাচকমণ্ডলীর মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে নির্বাচকবৃন্দ বাছাই, তাঁদের সাহায্যে পছন্দের মানুষকে এবার কাজ পাইয়ে দেওয়া। কংগ্রেস আমলে যে জিনিস আকছার হত বলে আমাদেরও তা অনুসরণ করতে হবে, কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।’

স্মৃতিকথা ‘আপিলা-চাপিলা’-তে এমনই সব বিস্ফোরক কথা লিখে গিয়েছেন বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী সিপিএমের অশোক মিত্র (Ashok Mitra)। বই হয়ে বেরোনোর আগে একটি সাময়িকীতে প্রকাশের সময় বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্বের বয়স কুড়ি পেরিয়ে গিয়েছিল।

সেই বইয়ের এক জায়গায় বোলপুর থেকে ট্রেনে কলকাতায় ফেরার পথে বর্ধমান বা গুসকরা থেকে ওঠা এক কিশোরের সঙ্গে আলাপচারিতার বিবরণ দিয়েছিলেন অশোকবাবু। তাতেও বাম জমানার এক প্রচলিত দুষ্কর্মের অনবদ্য বর্ণনা ছিল। অশোক মিত্র লিখেছিলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়নরত, পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ। ছেলেটি আমাকে চেনে না। নামও শোনেনি কোনওদিন। জিজ্ঞাসা করলাম, কলেজে কেমন পড়ানো হয় পদার্থ বিজ্ঞান। ম্লান মুখে, পৃথিবীর সঞ্চিত বিষন্নতা নিয়ে সে জানাল, এতদিন অমুকদা পড়াতেন। ওঁর প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি। বোঝানও চমৎকার। কিন্তু উনি তো পার্টির সদস্য নন। পাকা চাকরি পাবেন না। পাকা কাজে যিনি আসছেন তাঁকেও তারা চেনে— তমুকদা। কিছু পড়াতে পারেন না, ছাত্রও ভাল ছিলেন না।

কাহিনিটি আমি জ্যোতিবাবুকে বলেছিলাম। উনিও শুনে আতঙ্কিত। তবে ততদিনে ঘুণ অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। নেতারা তো বহুদিন বলে আসছিলেন, পার্টিতে প্রচুর বাজে লোক ঢুকেছে। অবিলম্বে তাড়াতে হবে। কিন্তু বছরের পর বছর গড়ায়, যে কে সেই। শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন ধারা নব ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে প্রায়, অন্য সর্বত্রও তাই। যাঁরা বিশ্বস্ত পেটোয়া, তাঁদের বাছা হবে। যাচ্ছেতাই বা অপদার্থ হলেও যায় আসে না। কে আর ভাববেন কোন একটি শিক্ষক পদে ভুল নির্বাচন হলে পুরো বিভাগটি বা বিদ্যালয়টি ধসে পড়ার আশঙ্কা; অপকৃষ্টরা অপকৃষ্টদেরই হাতছানি দেয়, উৎকৃষ্টরা টিকতে পারে না সেই পরিবেশে। গত কুড়ি বছরের ইতিহাস থেকে এন্তার উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।’

বুদ্ধবাবু চোখ দেখাতে কিউবা গিয়েছিলেন, শান্তিবাবুকে ঠেলে পাঠাতে পারেননি অনিল বিশ্বাস

এই ছিলেন অশোক মিত্র। ‘পাছে পার্টি কিছু বলে’, ‘নেতা রেগে যান’, এমনতর দুর্ভাবনা তাঁকে তাড়া করে বেড়াত না। তাঁকে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া পদস্থ আমলাকে ডেকে যেমন বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট।’ সেই কথার রেশ ধরে ‘ভদ্রতা ও কমিউনিস্ট পার্টি’ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধের বান ডেকেছিল বাংলায়। বেশিরভাগের অনুচ্চারিত অভিমত ছিল এই রকম, কমিউনিস্টরা একমাত্র মহাকাশে গেলে ভদ্রলোক হলেও হতে পারে। পৃথিবীতে নয়।

তবে যে ক’বার অশোকবাবুর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, উপলব্ধি করেছি, এক, তাঁর মতো খাঁটি ভদ্রলোক বিরল। বাড়িতে গেলে নিজে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করতেন। বিদায় জানানোর সময় এগিয়ে দিতেন লিফ্ট পর্যন্ত। বাড়িতে থাকলে নিজেই ফোন ধরতেন। স্ত্রী, কিংবা কাজের লোককে দিয়ে ফোন ধরিয়ে ‘বাড়ি নেই’ জাতীয় মিথ্যা বলা, কিংবা অপেক্ষা করিয়ে নিজের ব্যস্ততা জাহির করার মানুষ ছিলেন না।

সরকারি গাড়ির চালককে ছুটি দিয়ে রাইটার্স থেকে হাঁটা দিলেন মন্ত্রী

দুই, ভাল চাওয়া আর ভালমানুষির তফাতটা মেনে চলা ছিল জীবনের ব্রত। পার্টির ভাল চেয়ে মন্ত্রিত্ব ও দলত্যাগের বিষয়ে তৎক্ষণাৎ প্রকাশ্যে মুখ খুলে বুর্জোয়া কাগজের খোরাক হননি। পদত্যাগের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মুখে আলসার হয়েছে। কথা বলতে পারছি না।’

আবার নিপাট ভালমানুষি করে মুখ বুজেও থাকেননি। আলোচনা সভায়, লেখায় পার্টিকে বিদ্ধ করেছেন চাঁচাছোলা ভাষায়। সেগুলির বেশিরভাগই বলা চলে ক্ষমতাসীন সিপিএম ও তাদের সরকার সম্পর্কে ময়না তদন্ত রিপোর্ট।

সবচেয়ে সরব ছিলেন, প্রশাসনে অবিরাম দলতন্ত্র এবং পদে পদে দক্ষতার সঙ্গে পার্টির প্রতি বশ্যতা, আনুগত্যের উদ্দাম স্বীকৃতির বিরুদ্ধে। আদ্যোপান্ত সৎ বলেই প্রশাসন আর পার্টির ক্ষমতার জোরে সিপিএম যে সময় বাংলার ভাগ্যবিধাতা সেই দিনে কলম ধরেছিলেন অশোক মিত্র।

সর্বশেষ খবর জানতে পড়ুন দ্য ওয়াল

বাংলার চলতি শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি কলঙ্ক যেমন আলকাতরা ছিটিয়ে মুছে ফেলা অসম্ভব, তেমনই অনিয়মের গোড়া ধরে টান মারলে অনেক মুখেই চুনকালি পড়বে সন্দেহ নেই।

কাউকে সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আশা করি, অনেকেই একমত হবেন, দু’চারজন, পাঁচজন, দশজন ব্যতিক্রম ছাড়া চাকরির বিনিময়ে সিপিএমের মন্ত্রীরা হাত পেতে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা নেননি। বাড়ি-গাড়িতে ডুবে থাকেননি। অতীতে কংগ্রেস জমানাও তাই। বামফ্রন্টের শেষের দিকে কয়েক বছর ছাড়া মন্ত্রীদের রক্ষী পরিবৃত হয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে চলাফেরাও ছিল বিরল দৃশ্য।

কিন্তু বলতেই হবে, অশোক মিত্রর মতো এক-দু’জন বাদে সেই তাঁদেরই বেশিরভাগেরা হাতে গ্লাভস পরে নোংরা ঘেঁটেছেন। দলের স্বার্থে সিস্টেম দূষিত করেছেন। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার নামে পার্টি পরিচালিত পার্টির স্বার্থে পার্টির প্রতি এই অন্ধ আনুগত্য মৌলবাদের আর এক মডেল।

ইতিহাসের অজানা কাহিনি জানতে পড়ুন দ্য ওয়াল ফিচার

তিন, আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন। ক্লাস সিক্সের আগে ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা বাদে দ্বিতীয় কোনও ভাষা শিক্ষা নিষ্প্রয়োজন এবং বড় কলকারখানা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, এই অভিমতের প্রশ্নে ছিলেন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যালঘু। তবু আমৃত্যু অবস্থান ছিল অপরিবর্তিত। চলমান রাজনীতিতে ‘অচল পয়সা’ হয়েই কাটিয়ে দেন শেষের দু-আড়াই দশক।

প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রীর ভার নেওয়ার আগে অশোক মিত্র ছিলেন দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। সেই সূত্রে আরও অনেক গুরুদায়িত্ব চাপিয়েছিলেন ইন্দিরা। দিল্লির মোটা মাইনের চাকরি কিংবা বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে ডলার উপার্জনের মোহ ছেড়ে এমন এক সরকারের মন্ত্রী হলেন যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

ফলে কলকাতায় ফিরে দিল্লি অভিমুখে কামান দাগাই ছিল সময়ের দাবি। রাজ্যের হাতে আর ক্ষমতা ও অর্থ দেওয়ার দাবিতে বামপন্থীদের আন্দোলনের জ্যোতি বসু শ্রীকৃষ্ণ, অশোক মিত্র অর্জুন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে ‘সহজপাঠ’ রচনা করে গিয়েছেন, তীব্র বাম বিরোধীর পক্ষেও তা দূরে ঠেলে রাখা কঠিন।

সেই পর্বে বামফ্রন্ট সরকার ছিল সংগ্রামের হাতিয়ার। দুধের শিশুকে বুক দিয়ে আগলে রাখার মতোই অশোকবাবুর সরকারকে নিয়ে বাড়তি উদ্দীপনা বাকিদের নজর কাড়ে। সকাল আটটা-সাড়ে আট’টার মধ্যে রাইটার্সে ঢুকে পড়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে, ফাইলে মুখ গুঁজে থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে বাড়ি ফেরা ছিল রুটিন। সিপিএমের নেতৃত্বে সরকার, তাঁর কাছে ছিল বিপ্লবের একটি স্তর স্পর্শ করার মতো।

সবরকম হেলথ টিপস ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খবরের জন্য পড়ুন দ্য ওয়াল গুড হেলথ

প্রথম বাজেট ভাষণ এই বলে শেষ করলেন, ‘আমরা বিনীত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একটি নীরব বিপ্লব ঘটাতে চাই, নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব, যে বিপ্লবের উপান্তে যুগ যুগ ধরে যে মানুষেরা নিপীড়িত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত হয়ে আসছিলেন, তাঁরা জীবনের অন্য একটি ভাষা খুঁজে পাবেন। আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকর্মের একমাত্র অভীষ্ট সাধারণ মানুষ, সম্মান নিয়ে, গর্ব নিয়ে সাধারণ মানুষ যেন একটু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’

সেই অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল বেকার ভাতা, দেশের মধ্যে প্রথম। বিরোধীরা যদিও দেওয়ালে লিখল, ‘ভাতা দেয় ভাত, ভাত দেয় ভাত ঘুম।’ যদিও অশোকবাবুর ভাবনায় ভাত ঘুম তাড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। সরকারি অনুকম্পা নয়, তিনি চেয়েছিলেন, ভাতার বিনিময়ে সরকারি প্রকল্পে সপ্তাহে দু’ঘণ্টা কাজ করুন বেকাররা। তাতে খানিক কাজও শেখা হবে। সেই পরিকল্পনা যদিও তেমন বাস্তবায়িত হয়নি।

সৎ বলেই রাজনীতিক, মন্ত্রী অশোক মিত্রর অভিধানে দু’টি শব্দ ছিল না। এক, প্রতিশ্রুতি। দুই, আমি। অনুষ্ঠানে, সভা-সমিতিতে গিয়ে ‘এই করে দেব, সেই করে দেব, রাইটার্সে ফিরে গিয়েই ফাইলে সই করব’– এই জাতীয় কথা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করতেন না। আমিত্ব ফলানোকে মনে করতেন অপসংস্কৃতি।

গরিব কল্যাণে নিবিষ্ট অশোক মিত্র বিশ্বাস করতেন, সরকার চলবে পারস্পরিক ভর্তুকির নীতিতে। অর্থাৎ বড়লোকের করের টাকায় গরিব মানুষের ভরনপোষণ। তাই রঙিন সিনেমার উপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে করমুক্ত করে দিয়েছিলেন সাদাকালো ছবি। যুক্তি ছিল, গরিব মানুষ সাদাকালো ছবি বেশি দেখে।

একই কারণে বিলিতি মদের উপরও চড়া হারে শুল্ক চাপান। আর ভিআইপি কালচারে এতটাই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন যে গড়ের মাঠে কাঠের গ্যালারিতে মন্ত্রী, আমলাদের বসার পৃথক ব্যবস্থা এবং টিকিটের কোটাও মানতে চাননি।

দু’দফা মিলিয়ে কম-বেশি বছর সাত অর্থমন্ত্রী ছিলেন অশোক মিত্র। অজান্তে থেকে থাকলে আলাদা কথা, তবে রাজ্যের কোথাও কোনও প্রকল্পে, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ কিংবা সরকারি ঘর-বাড়িতে শিল্যান্যাস, উদ্বোধনের ফলকে তাঁর নাম খোদাই করতে দেননি অশোক মিত্র।

আটের দশকের গোড়ায় টানাটানির দিনে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের জন্য টাকার সংস্থান করতে দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করেছেন, খরচ কমানোর রাস্তা খুঁজেছেন। ফলকে না থাক, কোনও আলোচনাতেও কখনও তাঁর এই ভূমিকা আলোচনায় আসেনি।

এক-দু’বার ব্যতিক্রম ছাড়া কখনও গাড়ির মাথায় লালবাতিটি জ্বালাতে দিতেন না। সাইরেন বাজানোতেও ছিল ততটাই আপত্তি। বিশেষ পরিস্থিতিতে মাস ছয়েক সময় বাদে মন্ত্রিত্বের বাকি দিনগুলি দেহরক্ষীও নেননি।

চেম্বারের বাইরে লালবাতি জ্বালিয়ে রেখে ছেঁড়া পাঞ্জাবি সেলাই করলেন মন্ত্রী

You might also like