শেষ আপডেট: 30th January 2024 17:34
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বিশ শতকের গোড়ার কথা। ১৯০৩ সাল। আরও অনেক বণিকের মতো সে সময়ে কলকাতায় এসেছিলেন এক স্কটিশ ব্যবসায়ী। সাহেবের সুন্দরবন পছন্দ হয়েছিল। এক লপ্তে ৯ হাজার একর জমি কিনে নিয়েছিলেন সেখানে। তবে একা থাকার জন্য নয়। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু গরিব ও প্রান্তিক মানুষকে পাণ্ডববর্জিত দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিলেন এই স্কট ভদ্রলোক। তাদের চাষ আবাদের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। স্কুল, হাসপাতাল, ধানের গোলা তৈরি করেছিলেন। সেই সঙ্গে সমবায় ব্যবস্থার অ-আ-ক-খ শিখিয়েছিলেন হাতে ধরে।
‘কো-অপারেটিভের’ সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় ব্রিটিশ ভারতের। সাহেবের এহেন কল্পরাজ্যের কথা শুনে উৎসাহ বোধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। সেই উৎসাহ ছিল এতটাই যে শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেনে চেপে, তারপর নৌকোয় করে পৌঁছে গেছিলেন গোসাবায়। তিন দিন ছিলেনও সাহেব কুঠিতে। মহাত্মা গান্ধীকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সাহেব। গান্ধীজি নিজে যেতে না পারলেও সাহেবের তৈরি পল্লীসমাজ দেখতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর সচিব মহাদেব দেশাইকে।
কিন্তু তারপর? সেই কল্পরাজ্যের কী হল? কেই বা ছিলেন সেই সাহেব। কল্পরাজ্য গড়ে তুলতে তাঁর দর্শন কী ছিল? অধুনা সুন্দরবন বা গোসাবায় কি তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়? সোমবার সন্ধেয় সেই বিস্মৃত সাহেব ও তাঁর কল্পরাজ্যের সন্ধান দিলেন প্রাক্তন মুখ্য সচিব তথা বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রাক্তন আমলা অনুপ মতিলাল।
স্কটিশ সাহেবের নাম ছিল স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন। জন্ম ১৮৬০ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়। স্কটল্যান্ডের এক দ্বীপে ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। ১২ বছরের বয়সেই পারিবারিক ব্যবসার কাজে নেমে পড়েন। তারপর বয়স যখন কুড়ি, তখন ম্যাকিনন ম্যাকেনজি কোম্পানির প্রতিনিধি করে তাঁকে পাঠানো হয় বম্বেতে। পরে ম্যাকিনন কোম্পানির কলকাতার ব্যবসার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হন তিনি।
এই সাহেবের বিক্ষিপ্ত ভাবে লেখা কিছু প্রবন্ধ, চিঠি এবং সমবায় ব্যবস্থা ও গ্রামীণ পুনর্গঠন নিয়ে তাঁর ধারণা ও ভাবনাকে এক জায়গায় করে তা সম্পাদনার কাজ করেছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনুপ মতিলাল। তাঁদের সম্পাদিত সেই বই প্রকাশ করেছে দীপ প্রকাশন। নাম ‘দ্য ফিলোজফার্স স্টোন’।
বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচারে সোমবার সন্ধেয় সেই বইয়ের পরিচয় ঘটিয়েছেন সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ। এই লেখকের প্রসঙ্গ উঠলেই সুন্দরবনের পটভূমিতে তাঁর লেখা বই ‘দ্য হাংরি টাইডের’ কথা এমনিই চলে আসে। এদিন তিনি নিজেই তোলেন সে কথা। গোসাবা হাইস্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাঁর কাকাবাবু। গোসাবায় হ্যামিলটনের বাংলো চিনেছিলেন সেই সূত্রে। সোম-সন্ধেয় কলকাতার অনেকেই হয়তো এই প্রথমবার শুনলেন ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের কথা। তারপর হ্যামিলটন সাহেবের কল্পরাজ্যের আরও সন্ধান দিতে আলাপন-অনুপকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্ত।
এদিন বইটির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে গিয়ে হ্যামিলটন সাহেবের দর্শনের মৌলিক ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছিলেন সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ। তিনি জানিয়েছিলেন, সাহেব যাদের চাষ আবাদের কাজের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের জমির মালিকানা দেননি। বর্গাদার বা ভাগচাষি করে রেখেছিলেন। সম্ভবত সেই কারণেই তেভাগা আন্দোলনে গোসাবার মানুষেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেননি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, গোসাবায় স্কটিশ সাহেবের সেই ইউটোপিয়া বা কল্পরাজ্য কেন চিরস্থায়ী হয়নি। কোন প্রেক্ষাপটে এবং কী কারণে তা ভেঙে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি তুলে আনেন ১৫১৬ সালে থমাস মোরের লেখা ইউটোপিয়া বইটির প্রসঙ্গ। নতুন বিশ্বের কাল্পনিক দ্বীপ-সমাজ কেমন হতে পারে সেই প্রথম অবতারণা করা হয়েছিল ইউটোপিয়ায়। আলাপনবাবুর মতে, হ্যামিলটনও হয়তো তেমনই একটা কল্পরাজ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন সুন্দরবনে। কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক, উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার ভাবনা থাকায় সেই কল্পরাজ্যের ধারণাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সেই কারণেই তা ভেঙে পড়েছিল।
‘দ্য ফিলোজফার্স স্টোন’ থেকেই জানা যায় যে, স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন তাঁর জীবদ্দশাতেই উইল করে গেছিলেন। তাতে বলা ছিল, তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভারতে হ্যামিলটনের সমস্ত সম্পত্তি ও জমিজমা যৌথভাবে চার্চ অফ ইংল্যান্ড, চার্চ অফ স্কটল্যান্ড এবং লন্ডন মিশনারি সোসাইটির ভারতীয় শাখার কাছে চলে যাবে। অর্থাৎ এদেশের কাউকেই জমির ছিটেফোঁটাও দিয়ে যাননি তিনি। তবে দুই চার্চ ও মিশনারি জমি ও সম্পত্তির দায়িত্ব নেয়নি। কারণ তারা মনে করছিল, যৌথ ভাবে তিন পক্ষকে দায়িত্ব দিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়।
এদিন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, হ্যামিলটনের মধ্যে আদর্শের সন্ধান করার উদ্দেশ্যে এই বই প্রকাশ করা হয়েছে এমন নয়। আমলা জীবনের গোড়ায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অতিরিক্ত জেলাশাসক ছিলেন তিনি। তখনই হ্যামিলটন এস্টেটের কথা প্রথম জানতে পারেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই হ্যামিলটন পাবলিক ট্রাস্ট তৈরি হয়। তখনই তাঁর মনে হয়, সাহেবের যা কর্মকাণ্ড ছিল তা ইতিহাসের দলিল হতে পারে।
তবে সাহেবের চরিত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা সোম-সন্ধেয় যে হল না তাও নয়। আলাপনবাবুর কথায়,“হ্যামিলটনের মধ্যে বড় আদর্শ দেখিনি। বরং বলা যেতে পারে তাঁর মধ্যে বহুমুখী ভাবনার এক অদ্ভূত মিশ্রণ ছিল। একদিকে তিনি খ্রীষ্টান ধর্মপরায়ণ, প্রাচ্য নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল- কারণ তাঁর লেখায় আকবর বা অশোকের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়, আবার লেনিনের কমিউনিজম ঘোর অপছন্দ ছিল তাঁর।”
এহেন হ্যামিলটন সাহেবের মধ্যে কেন এমন কল্পরাজ্য গড়ার ভাবনা এসেছিল, তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন অনুপ মতিলাল। তিনি বলেন, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ্বে স্কটল্যান্ডে ছিল প্রবল দারিদ্র। তদানীন্তন স্কটিশ সরকার মনে করছিল, সমবায়ই একমাত্র সর্বরোগহর হতে পারে। সেই ব্যবস্থা নিয়ে ছোট থেকে ধারণা ছিল হ্যামিলটন সাহেবের। দারিদ্রক্লিষ্ট ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে মানুষের কষ্ট দূর করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি।
অনুপ জানান, এ দেশে সমবায় ব্যবস্থা শুরু করতে প্রায় দেড় দশক সময় নেন হ্যামিলটন সাহেব। তাঁকে এদেশে সমবায়ের জনক বলা যেতে পারে। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাঁর ভাল যোগাযোগ ছিল। ১৯০৪ সালে কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি আইন প্রবর্তনের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে তিনিই প্রভাবিত করেন। বলতে গেলে, গোসাবায় সমবায় ব্যবস্থা শুরু করা ও এই আইন প্রণয়ন ছিল প্রায় সমসাময়িক ঘটনা। শুধু গ্রামীণ পুনর্গঠন নয়, চরিত্রগঠনেও গোড়া থেকে জোর দিয়েছিলেন তিনি। সেই কারণেই গোসাবায় স্কুলও খুলেছিলেন।
এমন এক সাহেবের গল্প শুনতে রোমাঞ্চকর। বেশ টানটান। সোমবার সন্ধেয় দর্শকদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতই। তাই অনুপ মতিলালও সময়ের হিসাব রাখতে চাননি। তিনি আরও জানান, খাতায়কলমে সাহেব ৯ হাজার একর জমি নিলেও শেষপর্যন্ত প্রায় ২২-২৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন। সাহেব কীভাবে জমিটা পেয়েছিলেন তাও জানা যায় অনুপের থেকেই।
যশোরের প্রথম ইংলিশ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন টিলম্যান হেঙ্কেল। যাঁর নামে সম্ভবত হিঙ্গলগঞ্জের নামকরণ হয়েছে। সেই হেঙ্কেল সাহেবই প্রথম ওয়ারেন হেস্টিংসকে বলেছিলেন, সুন্দরবনের জমি লিজ দেওয়া যেতে পারে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় সুন্দরবন কখনওই ছিল না। সেখানে কোনও জমিদারও ছিল না। ওয়ারেন হেস্টিংসকে দেওয়া হেঙ্কেলের সেই চিঠির একশ বছর পর ১৮৭৯ সালে গ্রেট ক্যাপিটালিস্ট রুল তৈরি হয়। তার ফলে সুন্দরবনে জমি লিজ দেওয়া শুরু হয়। হ্যামিলটনকে স্পেশাল লিজ দেওয়া হয় ১৯০৩ সালে।
তবে অনুপ জানিয়েছেন, হ্যামিলটনের কোঅপারেটিভ ব্যবস্থার যে ত্রুটি ছিল সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এক সেমিনারে সে প্রসঙ্গ তুলেছিলেন তিনি। আবার হ্যামিলটন চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনেও কোঅপারেটিভ ব্যবস্থা চালু হোক। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ, তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও একটা হস্তক্ষেপ থাকবে।
সোম সন্ধেয় এভাবেই কলকাতা চিনল হ্যামিলটন সাহেবকে। নতুন করে চিনল গোসাবা, সুন্দরবনকেও।