শেষ আপডেট: 7th January 2023 08:56
আন্দিজ পর্বতমালার বুকে ঢুকে আছে কলম্বিয়ার প্রদেশ 'অ্যান্টিওকুইয়া'। প্রদেশটিতে আছে ছবির মত সুন্দর 'আবুররা' উপত্যকা। সেই উপত্যকায় আছে 'অ্যান্টিওকুইয়া' প্রদেশের রাজধানী মেডেলিন সিটি। যার আর এক নাম, 'চির বসন্তের শহর'। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের এক বিকেল, আন্দিজ পর্বতমালার ওপারে সূর্য সদ্য মুখ লুকিয়েছিল। কড়া ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করেছিল মেডেলিন শহর।
ম্যানুয়েলার বাবার মুখ থমথমে। বিষন্ন মুখে বসে ছিলেন স্ত্রী মারিয়া ও ছেলে জুয়ান। গোপন আস্তানার গুদামে কয়েকশো প্যাকিং বাক্সে কোটি কোটি ডলারের নোট বন্দি হয়ে ছিল। কিন্তু খরচ করার উপায় ছিল না। কারণ, ম্যানুয়েলার বাবাকে ধরার জন্য কলম্বিয়া সরকার সারা দেশে নাকাবন্দি শুরু করেছিল। খ্যাপা হায়নার মতো ম্যানুয়েলার বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল কলম্বিয়ার কমান্ডোর দল। ফাঁকা ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই ম্যানুয়েলার বাবা উঠে পড়েছিলেন। তাঁর দেহরক্ষীদের কী যেন একটা বলেছিলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পাঁচটি প্যাকিং বাক্স নিয়ে ফিরে এসেছিল তারা। পাঁচটি প্যাকিং বাক্স উপুড় করে ফায়ার প্লেসের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছিল নোটের বান্ডিল। তারপর আগুন দেওয়া হয়েছিল নোটগুলিতে। পুড়তে শুরু করেছিল ডলার, বাড়তে শুরু করেছিল উষ্ণতা। হাসি ফিরেছিল ম্যানুয়েলার মুখে, বাবার কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ম্যানুয়েলা।ম্যানুয়েলাকে কোলে করে সারা রাত বসেছিলেন ম্যানুয়েলার বাবা। রাত যখন শেষ হয়েছিল, ততক্ষণে ফায়ার প্লেসে পুড়ে গিয়েছিল কুড়ি লক্ষ ডলারের নোট। পুড়তেই পারে টাকা, এ আর বেশি কথা কী! কারণ ম্যানুয়েলার বাবা ছিলেন কলম্বিয়ার বিভীষিকা, পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিত্তবান মাফিয়া পাবলো এসকোবার।
একসময় সারা বিশ্বে উৎপাদিত ও বিক্রি হওয়া কোকেনের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত এসকোবারের গ্যাং 'মেডেলিন কার্টেল'।। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রত্যেক দিন ১৫ টন কোকেন পাচার করত এসকোবারের 'মেডেলিন কার্টেল'। আশির দশকের মাঝামাঝি ‘কিং অফ কোকেন’ হয়ে গিয়েছিলেন এসকোবার, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে।
মাঝ সমুদ্রে হত কোকেনের লেনদেন। আমেরিকার ফ্লরিডা থেকে সমুদ্রপথে ছুটে যেত বিভিন্ন আকারের স্পিড বোট। একই সঙ্গে কলম্বিয়ার উত্তর তীর থেকে কোকেনের বস্তা নিয়ে টেক অফ করত এসকোবারের নিজস্ব বিমান। আমেরিকার সমুদ্রসীমার বাইরে, বিমান থেকে সমুদ্রে ফেলা হত কোকেন ভর্তি বস্তা। বস্তাগুলির সঙ্গে বাঁধা থাকত হাওয়া ভর্তি টিউব। ফলে কোকেন বোঝাই বস্তাগুলি সমুদ্রে ভাসত। আমেরিকার ড্রাগ মাফিয়াদের স্পিডবোটগুলি সমুদ্রের জল থেকে কোকেনের বস্তাগুলিকে তুলে নিয়ে ছুটে চলত আমেরিকার উপকূলের বিভিন্ন দিকে।
কখনও কখনও এসকোবারের বিমান দুঃসাহস দেখিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ত আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে। ফ্লরিডার নির্জন এলাকায় ফেলে দিয়ে আসত কোকেনের প্যাকেট। এছাড়া নর্থ অ্যাটলান্টিকের হিমশীতল জলেও কোকেন ফেলে আসত এসকোবারের বিমান বহর। মাঝ সমুদ্রে ভাসতে থাকা মাফিয়াদের জাহাজগুলি জল থেকে কোকেনের বস্তা তুলে নিয়ে ভিড়ত আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দরে। আফ্রিকা হয়ে চোরাই কোকেন ছড়িয়ে পড়ত এশিয়ার ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
‘কিং অফ কোকেন’ এসকোবার প্রতিদিন প্রায় ছ’কোটি ডলার রোজগার করতেন তাঁর ড্রাগ ব্যবসা থেকে। বছরের শেষে সেই রোজগার গিয়ে দাঁড়াত ২০০০ কোটি ডলারে। ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রকাশিত বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায়, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত জ্বলজ্বল করত এসকোবারের নাম। এর মধ্যে ১৯৮৯ সালে, বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় সপ্তম স্থানে উঠে এসেছিলেন এসকোবারে। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ সঠিক ভাবে জানা না গেলেও, অনুমান করা হয় এসকোবারের সম্পত্তির মূল্য ছিল ৩০০০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
মেডেলিন কার্টেলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন পাবলোর ভাই রবার্টো এসকোবার। তিনি তাঁর লেখা ,'দ্য অ্যাকাউন্টেন্ট স্টোরি: ইনসাইড দ্য ভায়োলেন্ট ওয়ার্ল্ড অফ দ্য মেডেলিন কার্টেল' বইটিতে এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন এমন কিছু কথা, যা জানলে হতবাক হয়ে যেতে হয়। বিশাল পরিমাণ নগদ টাকা নিয়ে প্রতি মাসে সমস্যায় পড়তেন পাবলো এসকোবার। ব্যাঙ্কে টাকা রাখার প্রশ্নই ছিল না। আবার প্রত্যেক মাসে তাঁর আস্তানায় জমা হওয়া প্রায় ২০০ কোটি ডলারের নোট পুলিশের নজরদারির জন্য সরাতেও পারতেন না। ফলে কোটি কোটি ডলারের নোট বোঝাই পেটিগুলি কলম্বিয়ার বিভিন্ন কৃষি জমি, পরিত্যক্ত পাম্প ঘর, 'মেডেলিন কার্টেল' মেম্বারদের বাড়ির দেয়ালে গর্ত করে লুকিয়ে রাখতে হত।
মেডেলিন কার্টেলের বার্ষিক আয়ের ১০ ভাগ টাকার কোনও হিসাব পেতেন না মেডেলিন কার্টেলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট রবার্টো এসকোবার। কারণ বিভিন্ন জায়গায় অসুরক্ষিতভাবে টাকার পেটি লুকিয়ে রাখার জন্য, জল লেগে, পোকা ও ইঁদুরে কাটার ফলে নষ্ট হয়ে যেত সেই টাকা। আক্ষরিক অর্থেই জলে যাওয়া টাকার পরিমাণ নেহাত কম ছিল না, বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। রবার্টো এসকোবার জানিয়েছিলেন প্রতি মাসে ১০০০০ ডলারের রবারের ব্যান্ড কিনতে হত, টাকার বান্ডিল তৈরি করার জন্য।
১৯৮০ দশকের শেষে কলম্বিয়ার বৈদেশিক ঋণ ছিল ১০০০ কোটি ডলার। সেই দেনা কয়েক ঘন্টার মধ্যে মিটিয়ে দেবেন বলেছিলেন এসকোবার। শর্ত ছিল একটাই, তাকে কোনওদিন আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়া চলবেনা। কিন্তু রক্ত লেগে থাকা ১০০০ কোটি ডলার ডলার নিতে চায়নি কলম্বিয়া।
কারণ, প্রতি মাসে প্রচুর টাকা এসকোবার বিলিয়ে দিতেন গরিবদের মধ্যে। তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ কোনও দিন ফিরে যাননি। হাজার হাজার গৃহহীনকে বাড়ি করে দিয়েছিলেন। নিজের পয়সায় কয়েকশো জমি কিনে, ফুটবল মাঠ তৈরি করে কিশোরদের উপহার দিয়েছিলেন ফুটবল পাগল এসকোবার। তৈরি করেছিলেন একাধিক স্টেডিয়াম। স্পনসর করতেন কলম্বিয়ার কয়েকশো ফুটবল ক্লাবকে। তাদের মধ্যে একটাও নামী ক্লাব ছিল না।
তাই কলম্বিয়াতে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এসকোবার। ১৯৮২ সালে সে দেশের সাংসদ হিসেবেও নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও দুই বছরের মধ্যে ইস্তফা দিতে হয়েছিল অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগ থাকায়। যে আইনমন্ত্রীর জন্য এসেকোবার ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি খুন হয়ে গিয়েছিলেন কয়েকদিনের মধ্যেই। খুনের নেপথ্যে ছিলেন এসকোবার।
কোথায় কত সম্পত্তি ছিল, এসকোবার হয়ত তা নিজেই জানতেন না। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্পত্তিটি ছিল বোগোটা ও মেডেলিনের মাঝখানে ৭০০০ একরের 'হাসিয়েন্ডা নাপোলেস' এস্টেট। যেটি বানাতে এসকোবার খরচ করেছিলেন ৬৩০ কোটি ডলার। এস্টেটের প্রবেশ দ্বারের মাথায় বসানো ছিল সেই বিমানটি, যেটিতে চড়ে এসকোবার ড্রাগ পাচার করতেন আমেরিকায়। 'হাসিয়েন্ডা নাপোলেস' এস্টেটের ভেতরে ছিল আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল মাঠ, ডাইনোসর স্ট্যাচু, কৃত্রিম হ্রদ, বুলফাইটিং এরিনা, টেনিস কোর্ট।
বিশাল গ্যারেজে রাখা থাকত শয়ে শয়ে বিলাসবহুল গাড়ি। এস্টেটের ভেতরে ছিল এসকোবারের নিজস্ব বিমানবন্দর। এত কিছুর মধ্যে এসকোবারের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস ছিল একটি চিড়িয়াখানা। যে চিড়িয়াখানাটিতে ছিল প্রায় ২০০ টি পশু। যাদের মধ্যে ছিল বাঘ, সিংহ, হাতি, জেব্রা, জলহস্তী, উট, জিরাফ সহ নানান প্রজাতির পশুপাখি ও সরীসৃপ। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা হত পশুগুলিকে। ড্রাগ পাচারের জন্য ব্যবহৃত কার্গো বিমানগুলিতে করে।
পাবলো এসকোবারের প্রবাদ হয়ে যাওয়া উক্তিটি ছিল “হয় ঘুষ নাও নয় বুলেট, সিদ্ধান্ত তোমার”। রোজগার ও নৃশংসতায় এসকোবার ছাপিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বের প্রায় সব কুখ্যাত অপরাধীকে। তাঁর গ্যাং-এর হাতে খুন হয়েছিলেন প্রায় ৪০০০ মানুষ। যাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রচুর সরকারি অফিসার ও পুলিশ। ১৯৮৯ সালে, মাঝ আকাশে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন একটি বিমান, কারণ সেই বিমানে চড়ে আমেরিকার গুপ্তচর কলম্বিয়া আসছিল এসকোবারের সন্ধানে। বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন শতাধিক নিরপরাধ মানুষ।
১৯৯২ সালের মাঝামাঝি নিজের দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন এসকোবার। এরপরে ‘মেডেলিন কার্টেল’ কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভেঙে গিয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল। দিনে গড়ে দশ বারোটি খুন হতে শুরু করেছিল। কলম্বিয়া সরকার তখন সত্যিই এসকোবারকে 'এনকাউন্টার' করে মারবার প্ল্যান করে ফেলেছিল। কিন্তু সে খবর চলে এসেছিল এসকোবারের কাছে। ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে কলম্বিয়া সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করে ছিলেন এসকোবার।
১৯৯৩ সালের ২ ডিসেম্বর, সকালে এসকোবার ফোন করেছিলেন ছেলে জুয়ানকে। ফোন ট্যাপ করেছিল প্রতিদ্বন্দী মাফিয়া গোষ্ঠী 'লস পেপেস'-এর মাফিয়ারা। তারা আগেই চিহ্নিত করেছিল শহরতলিতে থাকা সাদা দোতলা বাড়িটিকে। যেখানে লুকিয়ে ছিলেন 'লস পেপেস' মাফিয়াদের চিরশত্রু এসকোবার। 'লস পেপেস'-এর সদস্যদের নিয়ে কলম্বিয়ার কমব্যাট ফোর্স হানা দিয়েছিল বাড়িটিতে।
এসকোবার ও তাঁর দেহরক্ষী জানলা দিয়ে উঠে পড়েছিলেন কমলা টালি দেওয়া ছাদে। পেছন পেছন উঠতে শুরু করেছিল কলম্বিয়ার কমব্যাট ফোর্স। গুলির লড়াই চলেছিল প্রায় এক ঘন্টা। তারপর হঠাৎই গোলাগুলির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মিনিট পাঁচেক পরেই পরপর দুটি গুলির আওয়াজ ভেসে এসেছিল। টালির ছাদ থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছিলেন, রক্তাক্ত এসকোবার, কানের ভেতরে গুলির গভীর ক্ষত নিয়ে। বয়েস হয়েছিল মাত্র ৪৪।
সত্যিই এনকাউন্টারে মারা গিয়েছিলেন এসকোবার! নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন ‘কিং অফ কোকেন’ ! প্রশ্নটির উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। যেমন সন্ধান পাওয়া যায়নি ইঁদুরে ও পোকায় কাটতে থাকা হাজার হাজার কোটি ডলার মূল্যের নোটের বান্ডিলগুলির। যা কলম্বিয়ার গোপন স্থানে নিজের হাতে লুকিয়ে রেখেছিলেন পাবলো এসকোবার।