শেষ আপডেট: 24th August 2022 16:20
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: পাথরমানবী অহল্যার গল্প জানেন তো! রামায়ণের এই আশ্চর্য নারী ব্রহ্মার মানসকন্যা। প্রজাপতির মেয়ে অপরূপা অহল্যার সঙ্গে বিবাহ হয় প্রায় বুড়ো ঋষি গৌতমের। অহল্যা ছিলেন যেমনি রূপসী তেমনি বিদূষী। স্বামীর চোখ এড়িয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এরপর গৌতমের অভিশাপে পাথরে পরিণত হন অহল্যা। পরবর্তীকালে রামচন্দ্রের চরণস্পর্শে শাপমোচন হয়। ফের প্রাণ ফিরে পান অহল্যা।
ভারতীয় পুরাণের অহল্যার গল্পের মতোই এক অভিশপ্ত গল্পের খোঁজ পাওয়া গেছে ইউরোপের নেয়ার্সবরো (Knaresborough) টাউনে। ইংল্যান্ডের উত্তর ইয়র্কশায়ারের এক শহর এই নেয়ার্সবরো। তবে সেখানে কোনও মুনি-ঋষির অভিশাপে নয়, শুধুমাত্র জলের ছোঁয়াতেই পাথর হয়ে যায় সবকিছু। সেই অদ্ভুত মন্ত্রপূত জল জমে আছে ততধিক অদ্ভুত এক রহস্যজনক কুয়োতে। স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করেন, এই কুয়ো না কি ভয়ংকর অভিশপ্ত। যেখানে কিছু পড়ে গেলে, বা কোনওভাবে কুয়োর জলের সংস্পর্শে আসামাত্র যেকোনও জীবিত প্রাণীই ধীরে ধীরে পাথরে পরিণত হয়।মানুষ হোক, বা জীবজন্তু কেউই এর ব্যতিক্রম নয়। পুরাণের গল্পে যা হয়েছে হোক, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে এমন এক অবাস্তব কথা কি আদপেও বিশ্বাস করা সম্ভব? সত্যিই কি কোনও গোপন জাদুকরী ক্ষমতা আছে সেই কুয়োর জলের, যা প্রাণকে নিমেষে পাথর বানিয়ে দিতে পারে? কোনো অভিশাপ কি সত্যিই রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ অনেকগুলো বছর… (The Cursed Well)
আজ থেকে ৪০০ বছর আগের কথা... উত্তর ইয়র্কশায়ারের নিদ (Nidd) নদীর তীরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছিল এই কুয়ো। আশেপাশের মানুষজন বিশ্বাস করত মাদার শিপটন নামে এক ডাইনির অভিশাপ আছে এই কুয়োর উপর। এই মাদার শিপটন ছিলেন স্থানীয় এক পতিতার মেয়ে। পতিতা বলেই তার মায়ের স্থান হয়নি এলাকায়। তাকে একরকম জোর করেই এলাকাছাড়া করা হয়। সমাজচ্যুত হয়ে এই কুয়োর কাছাকাছি (The Cursed Well) জঙ্গলের মধ্যে এক গুহায় আশ্রয় নেয় মা-মেয়ে। মা আগাথার বয়স যখন ১৫ তখন তাঁর মেয়ে শিপটনের জন্ম। পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ছাড়াই একা অসহায় মায়ের কোলে বড় হতে থাকে শিপটন। কিন্তু জন্ম থেকেই দুর্ভাগ্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। জন্মের পর মাত্র ২ বছর বয়সে মা আগাথাও মারা যায়।
এলাকাবাসীর কেউই এই অনাথ অসহায় শিশু কন্যার দায়িত্ব নিতে চায়নি। তার অবশ্য একটি কারণও ছিল। আসলে মায়ের মৃত্যুর পর অনাদর অযত্নে শিপটনের চেহারা এমন বিদঘুটে হয়েছিল যে তাকে দেখতে অনেকটা ডাইনির মত লাগত। তেল চিরুনি না দিতে দিতে জটা পড়ে গিয়েছিল চুলে। নিয়মিত স্নান খাওয়া শরীরের পরিচর্যা কিছুই না থাকায় খড়ি উড়ত শরীরে। ফলে শিপটনের চেহারা ছোট বয়স থেকে সকলের কাছে ভীতিকর মনে হত। এছাড়াও শিপটনের জন্মগত কিছু ত্রুটিও ছিল। তার নাকখানা ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ লম্বা আর বাঁকা। পা দুটোও জন্মগতভাবে একটু বাঁকা ছিল। ফলে বাধ্যত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হত তাকে। সবমিলিয়ে এলাকার লোকেরা একরকম ভয়ই পেত শিপটনকে। তাকে এড়িয়ে যেতে চাইত।
শিপটন যেখানে জন্মেছিল সেই গুহা আর কুয়োর আশেপাশেই দিন কাটত তার। কিশোরীবেলা থেকেই তার সঙ্গী ছিল বনের গাছপালা, ফুল-ফল, ঔষধি লতাগুল্ম গাছ। ভেষজ গাছের পাতা, শিকড়-বাকড় নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত সে। এভাবে মনুষ্য সংস্পর্শবিহীন বনের নিভৃত পরিবেশে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল শিপটনের। কুয়োর আশ-পাশের বন থেকে ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে নানারকম ওষুধপত্র তৈরি করত সে। শিপটনকে পছন্দ না করলেও তার ভেষজ ওষুধে কিন্তু দিব্যি ভরসা ছিল গ্রামবাসীর। সেই ওষুধ খেয়ে দূরারোগ্য অসুখ থেকে সেরে উঠত গ্রামের অনেক মানুষ।
এই মাদার শিপটনেরই প্রকৃতিগতভাবে আর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ভবিষ্যৎ বলার। কাউকে একবার একঝলক দেখেই তার ভবিষ্যৎ বলতে পারত সে। তার এই ভবিষ্যৎবাণী এবং দূরারোগ্য অসুখের চিকিৎসার ক্ষমতার কারণে এলাকার মানুষের মধ্যে একধরনের ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম কাজ করত। ভবিষ্যৎ জানার জন্য দূরদূরান্ত থেকেও অনেক মানুষ ছুটে আসত তার কাছে। শিপটনের গুহার সামনে ক্রমশ এভাবেই মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। এই অলৌকিক ক্ষমতার কারণে এলাকার কেউ কেউ তো ঈশ্বরের অবতার হিসেবেও ভাবতে শুরু করে তাকে। (The Cursed Well)
সে সময় এই কুয়োর কোন দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে কয়েকজন অনুসন্ধানী এই কুয়ো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পঞ্চদশ শতকের নানা তথ্যের সন্ধান পান যেখানে তারা খুঁজে পান যে, সে সময় এই কুয়োর জলে স্থানীয় মানুষজন স্নান-পান সবই করত। রান্নাবান্না, খাবার কাজেও ব্যবহার করত এই কুয়োর জল। এই কুয়োর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বলে এলাকার অনেক লোকই মনে করতো। শিপটনও এই কুয়োর জল তার চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করত বলে অনেক গ্রামবাসীরা মনে করত। পরবর্তীতে গ্রামবাসীর সাথে তার বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যা হতে থাকে। তার এই ভবিষ্যৎ দর্শন এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা গ্রামের অনেকেই ভালো চেখে দেখত না। এলাকার কিছু লোক নানাভাবে হেনস্তা করতে থাকে সেই নিঃসঙ্গ একলা মহিলাকে। এভাবেই ৭৩ বছর কেটে গেল। ভালোবাসার বদলে মানুষের ঘৃণা আর উপেক্ষা পেয়ে পেতে ক্লান্ত শিপটন ১৫৬১ সাল নাগাদ সেই গুহার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। (The Cursed Well)
এর কিছু দিন পরেই এই কুয়োর নানা অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ যেতে থাকে। এলাকার অনেকেই কুয়োর জল নিতে এসে দেখতে পায় কুয়োর মধ্যে পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, কাঠের টুকরো, ঝরে পড়া ফুল আশ্চর্যভাবে পাথরের আকৃতি নিয়েছে। প্রথমদিকে কারও মনেই তেমন সন্দেহ কাজ করেনি। অনেকে তো রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে পরীক্ষা করার জন্য কুয়োর জলে খেলনা, বল, পুতুল, লোহার পাত ফেলে দেখার চেষ্টা করত, আসলে ব্যাপারটা কী! আশ্চর্যজনকভাবে কুয়োর জলে যেকোনও জিনিস ফেলার কিছুক্ষণ পরেই তা জমে পাথর হয়ে যেত। চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটতে দেখে এক ধরণের চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে জনমানসে, আতঙ্ক গ্রাস করে গ্রামবাসীদের। মুখে মুখে ছড়াতে শুরু করে নানান গুঞ্জন, গল্প। এর পর থেকে চট করে এই কুয়োর ধারে কেউ উঁকি মারতেও সাহস করে না। কে বলতে পারে, যদি একবার অসচেতনে কেউ পড়ে যায় জলে! অন্ধ কূপের ভিতর অহল্যার জীবন কে আর চায়!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসীদের বদ্ধমূল ধারণা হতে লাগল মাদার শিপটনের অভিশাপেই কুয়োর জল সবকিছুকে পাথর করে দিচ্ছে। এলাকাবাসীরা কেউ পারতপক্ষে ঐ কুয়োর আশেপাশে যাওয়ার সাহস পেত না। এই ঘটনা এলাকার বাইরে আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন এলাকার সাহসী ও কৌতুহলী অনেকে এ কুয়ো দেখতে এসে উপর থেকে টুপি, জুতো, রুমাল সহ বিভিন্ন বস্তু কুয়োর জলে ফেলে দিয়ে পরীক্ষা করেছেন কী ঘটে তা দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই সেসব জিনিস সত্যিই পাথর হয়ে গিয়েছে। কেউ দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছেন টেডি বিয়ার, সাইকেল, কেটলি। দড়ির কিছু অংশ সহ ঝুলন্ত বস্তুগুলি সম্পূর্ণ পাথরে পরিণত হয়েছে। যেন কুয়োর জলে মিশে রয়েছে অহল্যাকে দেওয়া সেই অভিশাপ।
কেন এমন হয়? উত্তর মিলছে না। বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাচ্ছেন। তবে জলের ছোঁয়া লাগলেই পাথর হওয়ার ভয়ে কেউ নামতে চাইছেন না যে পরখ করে দেখবেন। তবে কিছুদিন আগে একদল সায়েন্টিস্ট এই কুয়োর জল আর মাটি পরীক্ষা করেছেন। তাদের ধারণা কুয়োর জলে এমন কিছু উচ্চমাত্রার খনিজ রয়েছে যার রাসায়নিক প্রভাবে সবকিছু পাথরে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু তাতেও রহস্যের যথাযথ সমাধান হয়নি। এখনও চলছে নানারকম পরীক্ষা। হয়তো বিজ্ঞানের এই যুগে একদিন এই রহস্যেরও সমাধান হবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত রহস্য, অভিশাপ, অবিশ্বাস আর ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে সবকিছু পাথর করে দেওয়ার নিঃশব্দ হুঙ্কার দিচ্ছে কুয়োটা। তাই সাবধান! অবিশ্বাসী হয়ে ভুলেও ভয়ঙ্কর এই কুয়োতে নামতে চেষ্টা করবেন না, নামলেই পাথুরে মানুষ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।