
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ডেস্ক: কালো ও নীল পোশাকে দেখা যায় তাঁকে। শকুন ও কাক তাঁর বাহন। তাঁর লোহার রথ টানে আটটি ঘোড়া। চারটি হাতের মধ্যে তিনটিতে থাকে তীর, ধনুক ও ত্রিশুল। একটি হাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়। তাঁকে দেখলে কাঁপতে থাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কিন্তু তাঁকে এড়িয়ে চলার ক্ষমতা নেই কারও। কারণ তাঁর বক্রদৃষ্টি যার ওপর পড়বে তার জীবনে নেমে আসবে প্রাণান্তকর দুর্দশা। তিনি হলেন শনি মহারাজ (Shani Dev)। নবগ্রহের অন্যতম গ্রহ শনির দেবরূপ। যাঁর গায়ের রঙ অমাবস্যার রাত্রির মত কালো।

শনি কেন কৃষ্ণবর্ণ
সূর্যের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল বিশ্বকর্মার অতীব সুন্দরী কন্যা সঞ্জনার। সূর্যের ঔরসে সঞ্জনার গর্ভে একে একে জন্ম নিয়েছিলেন বৈবস্বত মনু,যম ও যমুনা। কিন্তু সূর্যের বিশ্বগ্রাসী তেজ সহ্য করতে না পারায়, নিজের অবিকল প্রতিমূর্তি তৈরি করে সূর্যের প্রাসাদ ত্যাগ করেছিলেন সঞ্জনা। সূর্যের স্ত্রী হয়ে সংসার করতে শুরু করেছিলেন সঞ্জনার প্রতিমূর্তি ‘ছায়া’।
সূর্যের ঔরসে ছায়ার গর্ভে এসেছিলেন এক পুত্র সন্তান। তারপরেও সূর্য মিলিত হয়েছিলেন গর্ভবতী ছায়ার সঙ্গে। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে গর্ভস্থ সন্তানের দেহের রঙ হয়ে গিয়েছিল কুচকুচে কালো। জৈষ্ঠ্য অমাবস্যায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শনিদেব। সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন সূর্য। কিন্তু কাঠকয়লার মত কালো শনিদেবকে দেখে ঘৃণাভরে নামিয়ে দিয়েছিলেন কোল থেকে। সূর্যদেবের মনে হয়েছিল শনিদেব অন্য কোনও পুরুষের সন্তান।
পিতার এই ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন শনিদেব। পিতাকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন,”আপনার বর্ণ এই মুহূর্তে আমার মত হয়ে যাক।” সূর্যের গলানো সোনার মত গায়ের রঙ হয়ে গিয়েছিল কুচকুচে কালো। নিমেষের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল বিপুল তেজরাশি। জগতে নেমে এসেছিল আঁধার। ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। পরিত্রাতা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং মহাদেব। সূর্যকে বলেছিলেন সত্য ঘটনা। মহাদেবের অনুরোধে শনি মহারাজ সূর্যকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তেজ ও বর্ণ।

নাম কেন শনি (Shani Dev)
শনি শব্দটি এসেছে ‘শনৈঃ ক্রমতি সাঃ’ শব্দবন্ধ থেকে। যেটির অর্থ “যে ধীরগতিতে পরিক্রমা করে”। শনি মহারাজের এই নামের পিছনেও একটি উপাখ্যান আছে। সূর্যের প্রথম স্ত্রী সঞ্জনা তপস্যা করে স্বামীর তেজ কমিয়ে, সন্ধ্যা নাম নিয়ে ফিরে এসেছিলেন সূর্যের কাছে। ধ্বংস করে ফেলেছিলেন ছায়াকে। শনি ও তাঁর বোন তপতীর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন বিমাতা সঞ্জনা।
মায়ের স্নেহ হারিয়ে শনি হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত বদমেজাজি। একবার সঞ্জনা ইচ্ছে করেই খাবার দিতে দেরি করায়, ক্রুদ্ধ শনি পদাঘাত করেছিলেন বিমাতাকে। শনিকে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার শাপ দিয়েছিলেন সঞ্জনা। শনিদেবের একটি পা পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত চলার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন শনি মহারাজ। তাই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে শনিগ্রহের সময় লাগে ২৯.৫ বছর।
শিবভক্ত শনি মহারাজ
শনির মা ছায়া গর্ভাবস্থাতেও শিবের (Lord Shiva) পূজো করতেন ও ব্রত রাখতেন। মা ছায়ার উচ্চারণ করা শিবের স্ত্রোত্র, গর্ভের ভেতরে শুয়ে আবৃত্তি করতেন শনিদেব। ছায়ার গর্ভস্থ সন্তানের ভক্তি দেখে তুষ্ট হয়েছিলেন শিব। পরবর্তীকালে শনি মহারাজ ভয়ঙ্কর বদরাগী হয়ে ওঠায়, পুত্রকে শান্ত করে দেওয়ার জন্য শিবকে অনুরোধ করেছিলেন সূর্যদেব।
শনিদেবকে কৈলাসে নিয়ে আসার জন্য ভুত প্রেত পিশাচদের পাঠিয়েছিলেন শিব। কুপিত শনি শিবসেনাদের চরম প্রহার করে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শনিদেবকে আনতে গিয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে শিবকেই আক্রমণ করে বসেছিলেন শনি। মহাদেব তখন তাঁর রুদ্ররূপ ধারণ করে, ভক্ত শনিকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন অশ্বত্থ গাছের ডাল থেকে।

অনুতপ্ত শনি (Shani Dev) হেটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ অবস্থাতে শুরু করেছিলেন মহাদেবের কঠোর তপস্যা। টানা উনিশ বছর তপস্যা করার পর তুষ্ট হয়েছিলেন মহাদেব। ভক্ত শনিকে দান করেছিলেন বক্রদৃষ্টি। ভোলেনাথ বলেছিলেন, সৎপথে থাকা মানুষের ওপর পড়বে শনিদেবের কৃপাদৃষ্টি। কিন্তু যে মানুষ সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হবেন তার ওপর পড়বে শনির বক্রদৃষ্টি বা অভিশাপ। বিপথগামী মানুষের জীবন শনির অভিশাপে হয়ে উঠবে ভয়াবহ।

নাকাল করেছিলেন আরাধ্য দেবতা শিবকেও
শনিদেবকে বক্রদৃষ্টির বর দেওয়ার পর শিব পড়েছিলেন ভীষণ চিন্তায়। কারণ শনিদেবের বক্রদৃষ্টি তাঁর ওপরও পড়তে পারে। অন্তর্যামী শনিদেব শিবকে বলেছিলেন, “আমার বক্রদৃষ্টির প্রভাব আপনার ওপরেও পড়তে চলেছে প্রভু। তবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হবে আমার প্রভাব।” শনির বক্রদৃষ্টি থেকে বাঁচতে শিব পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা হাতির কলেবর ধারণ করে আত্মগোপন করেছিলেন হিমালয়ের অরণ্যে। তারপর ফিরে এসেছিলেন কৈলাশে। পুনরায় ধারণ করেছিলেন তাঁর নীলকণ্ঠ রূপ।
ঠিক সেই মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছিলেন শনি। স্মিত হেসে শিব বলেছিলেন, “তোমার বক্রদৃষ্টি কেউ এড়াতে না পারলেও, আমি কিন্তু এড়াতে পেরেছি।” শনিদেব বলেছিলেন, “না প্রভু আপনি পারেননি। আমার বক্রদৃষ্টির প্রভাবেই ধ্বংস, সংহার ও প্রলয়ের দেবতা শিবকে পশুর রূপ ধারণ করে মর্ত্যে ঘুরে বেড়াতে হল।”

শনিদেবই ধ্বংস করেছিলেন রাবণকে
রামায়ণের সুন্দরকাণ্ড থেকে জানা যায়, লঙ্কাধিপতি রাবণকে (Ravana) এক ঋষি বলেছিলেন, শনি মহারাজের বক্রদৃষ্টি তাঁর ওপর পড়তে চলেছে, তাই রাবণের বিনাশ আসন্ন। শনিদেবকে তাই কারাগারে বন্দি করেছিলেন রাবণ। তাঁর কাণ্ড দেখে জগত সংসার হেসে বলেছিল, “মূর্খ না হলে কেউ যেচে শনিকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। শনির ক্রুর দৃষ্টি থেকে এবার কেউ রাবণকে বাঁচাতে পারবে না।”
কুপিত শনির বক্রদৃষ্টির ফলাফল আমরা জানি। রামের হাতে বিনাশ হয়েছিল রাবণের। তার আগে শনিদেবকে রাবণের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন পবনপুত্র হনুমান। শনিদেব বর দিতে চেয়েছিলেন হনুমানকে। রামভক্ত হনুমান বলেছিলেন, “প্রভু রাম ও মাতা জানকী যেন দ্রুত পরস্পরকে ফিরে পান।” শনিদেব ব্রলেছিলেন, “তথাস্তু, আজ থেকে তোমার নাম হবে সংকটমোচন (Sankatmochan Hanuman)। যে তোমার নাম জপ করবে,আমার দৃষ্টি তার দিকে পড়বে না।”

শনিদেবের কৃপাদৃষ্টি লাভ করার সহজতম উপায়
শনি মহারাজ হলেন শনি গ্রহের ঐশ্বরিক কায়া। যাঁর দিকে তাঁর বক্র দৃষ্টি পড়বে, ‘সাড়ে সাতি’ নামক গ্রহদোষের কবলে পড়বেন তিনি। প্রায় সাড়ে সাত বছর মানুষটিকে কাটাতে হবে প্রবল দুর্দশা ও চরম ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে। আমরা জানি শিব ও পবনপুত্র হনুমানের ভক্তদের ওপর শনি মহারাজের বক্রদৃষ্টি পড়ে না। কিন্তু যাঁদের পক্ষে নিত্য শনি, শিব ও হনুমানের পুজো করা সম্ভব নয়, তাঁরা কীভাবে পাবেন শনি মহারাজের কৃপাদৃষ্টি!
তাঁদের জন্য আছে সহজতম উপায়। যার দ্বারা সহজেই তুষ্ট করা যাবে আশুতোষ শিবের পরমভক্ত, ক্রুদ্ধ দেবতা শনি মহারাজকে। সর্বদা থাকতে হবে সৎপথে। কোনওরকম অন্যায়ের সঙ্গে জড়ানো যাবে না নিজেকে। তবেই শনির কৃপা বর্ষিত হবে আপনার ওপর। শনি মহারাজকে এই আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং শিবশম্ভু।
