শেষ আপডেট: 29th August 2023 18:12
"যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!"
কাজি নজরুল ইসলাম নিজের মা বাদেও আর এক জন নারীর মধ্যে নিজের মাকে খুঁজে পেয়েছিলেন, যে নারী মায়ের ভালোবাসায় সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন নির্বাক কবিকে। আজ কবির জন্মদিনে সেই মায়ের গল্প। ভালবাসা আর স্নেহ দিয়ে যে সমস্ত রকম ভেদাভেদ দূর করা যায়, তার উদাহরণ যেন সেই মানুষটি-- উমা কাজি (Uma Kazi)। নজরুলের বড়ছেলে কাজি সব্যসাচীর স্ত্রী, অর্থাৎ নজরুলের পুত্রবধূ।
আদতে তিনি ছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। হিন্দু ও বাহ্মণ পরিবারের কন্যা হয়েও মুসলিম পরিবারের পুত্রবধূ হয়েছিলেন সেই অত বছর আগে। কিন্তু এমন অনন্য ঘটনা কখনওই প্রচারের আলোয় আসেনি তাঁরই অনিচ্ছায়। উমার বাবা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং মা বাদলা মুখোপাধ্যায়। বর্ধমানের কাটোয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উমা।
লেখাপড়া শেষ করে কলকাতার 'লেডি ডাফরিন হাসপাতাল' থেকে ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়েছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। ছোট থেকেই সেবিকা হতে চাইচেন তিনি। লেডি ডাফরিনের নার্স হোস্টেলেই থাকতেন। সেখানকারই এক হেড নার্স ঊষাদি উমাকে এক নতুন পথের দিশা দেখান। উমাকে তিনি নিয়ে যান অসুস্থ কবি কাজি নজরুল ইসলামের বাড়ি। কবির সেবা করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক নার্সের। নির্বাক কবি তখন কলকাতার মাণিকতলায় ছিলেন। নানা অসুস্থতায় জর্জরিত হলেও, দুই বাংলাতেই তখন কবিকে নিয়ে উন্মাদনা কম নয়।
সেবা ও স্নেহের পথে ক্রমে উমাই হয়ে উঠলেন কবি নজরুলের প্রিয় মানুষ। তাঁকে স্নান করানো, খাওয়ানো, দেখভাল করা, গল্প শোনানো-- উমার হাতের স্পর্শ যেন কবির কাছে মায়ের আঁচলের মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল আর এক কান্ড। উমার সেবা দেখে, মিষ্টি ব্যবহার দেখে কবির বড় ছেলে কাজি সব্যসাচী পড়ে গেলেন উমার প্রেমে। উমাও সব্যসাচীকে মন দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভিন্ন ধর্মে অসম ভালবাসা কি সমাজ মেনে নেবে?
উমার বাড়ি থেকে এদিকে উমার বিয়ের পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। সরকারি কর্মচারী এক সুপাত্রকে খুঁজেও ফেলেছেন উমার জামাইবাবু। উমা (Uma Kazi) অনেক সাহস সঞ্চয় করে জানিয়ে দিলেন, "সব্যসাচীকে আমি ভালবাসি। ওকেই বিয়ে করব।" বাড়িতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সকলে এ কথা শুনে। পরিবারের তরফে উমাকে বলা হয়, "মুসলিম বিয়ে করে কোনও দিন যদি দুঃখ পাও, তখন আমরা কিন্তু আর তোমাকে ফেরত নেব না।" উমা বলেছিলেন, "দুঃখ করতে যদি নেমেই থাকি, দুঃখে পড়লেও কাউকে জানাব না।"
বিয়ে হল বামুনের মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের। সে সময়ে একরকম অসম্ভব একটা ব্যাপার। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রেখে উমা মুসলিম পরিবারকে আপন করে নিলেন। হয়ে উঠলেন উমা কাজি। কবি ও প্রমীলাদেবীও এমন এক মেয়েকে ঘরের বৌমা হিসেবে পেয়ে খুশি হলেন। উমা মুসলিম পদবী গ্রহণ করলেও, তাঁর নামে থেকে গেল মা দুর্গার নিশান।
জানা যায়, শাশুড়ি প্রমীলাদেবী বৌমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। দুই ছেলেকে খাবার দিয়ে বৌমাকেও নিজে রান্না করে, বেড়ে খাওয়াতেন তিনি। এদিকে কবিও বৌমা অন্ত প্রাণ। বৌমা চন্দন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে না দিলে স্নান করবেন না নজরুল, দাড়ি বৌমাই কেটে দেবে, খাইয়ে দেবে বৌমা। আদরের বৌমার কাছে শিশুর মতো বায়না করতেন কবি। এমনকি স্নানের পরে জামাকাপড় পরিয়ে নীল বোতলের সুগন্ধীও বৌমাকেই লাগিয়ে দিতে হবে।
উমা একদিকে নিজের নতুন সংসার সামলাচ্ছেন অন্যদিকে কবিকেও সামলাচ্ছেন। ধীরে ধীরে এল সব্যসাচী-উমার তিন সন্তান, মিষ্টি কাজি, খিলখিল কাজি এবং বাবুল কাজি। তিন নাতি-নাতনি ঠার্কুদার কাছেই থাকত বেশি সময়। কবিও তো শিশুর মতোই। সন্তানদের সঙ্গেই কবিকেও আসন পেতে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিতে হতো উমাকেই।
পরে কাজি নজরুল ইসলামকে সুস্থ করতে দুটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়, যে বোর্ডের সদস্যদের কবির সমস্যাগুলির সমস্তটা বুঝিয়ে দিতে যেতেন উমাই। কীভাবে কবির স্মৃতিশক্তি ফেরানো যাবে, কথা বলানো যাবে-- এ সব ভাল করে শুনে সেবার ধরনও বুঝে নিতেন উমা। পাশাপাশি স্বামীর খেয়াল রাখা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা-- সবটাই দেখতেন উমা দেবী।
একবার তো উমা তাঁর ছোট ছেলে বাবুল কাজিকে শুইয়ে রেখে রান্না ঘরে গেছেন, এসে দেখেন ছেলে নেই। খোঁজ খোঁজ! শেষে দেখেন কবি বসে কাগজ ছিঁড়ছেন তার ঘরে, আর সেই স্তূপাকৃতি ছেঁড়া কাগজের মধ্যে নাতি বাবুল কাজিকে শুইয়ে রেখেছেন তিনি। তাকে দেখে পরমানন্দে হাততালি দিচ্ছেন বৃদ্ধ কবি। উমা দেবী তো হতবাক, বাবার কাণ্ড দেখে! শোনা যায়, উমা ছেলেমেয়েকে শাসন করলে তাঁকে হাততালি দিয়ে বতে দিতেন নজরুল। ওঁর নাতি-নাতনিকে কেন বকবেন উমা!
প্রমীলাদেবী এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শাশুড়ির সব দেখভালের দায়িত্বও নিলেন উমাই। কবির আগেই চলে গেলেন কবিপত্নী প্রমীলাদেবী। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সংসার জীবনের পর, ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর দেহ কলকাতা থেকে চুরুলিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। হাজি পাহালোয়ানের দরগার পাশে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে বাংলাদেশে আনা হয় সপরিবারে। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডে (বর্তমান নজরুল ইনস্টিটিউট সংলগ্ন) কবি ভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন। কাজি সব্যসাচী কর্মসূত্রে কলকাতায় থেকে গেলেও উমা কাজি কবিকে দেখার জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ধানমণ্ডির বাড়িতে নজরুল নাতি-নাতনি নিয়ে খেলা করতেন, বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।
শেষ দিকে শৌচাগারেও যেতে পারতেন না নজরুল। বিছানাতেই সব। মুখ বুজে পরিষ্কার করতেন উমা (Uma Kazi)। কোনও অভিযোগ নেই। তিনি যে সেবিকা, তিনি যে মা! তাই তো এত কিছুর মধ্যেও এতটুকু ফাঁক পড়েনি ছেলেমেয়েকে বড় করায় বা শাশুড়ির অবর্তমানে সমগ্র সংসার সামলানোয় বা কাজি সব্যসাচীর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে ওঠায়।
কবির জন্মদিন পালন হতো বেশ বড় করে। অতিথিরা আসতেন, সবাই মালা পরাতেন কবিকে। কবি সেইসব মালা পরে খিলখিল করে হাসতেন। হারমোনিয়াম দেখিয়ে সবাইকে বলতেন গান করতে। নাতি-নাতনিরাও নজরুলসঙ্গীত গাইতেন। নির্বাক কবিই কখনও হেসে উঠতেন আবার কখনও নির্বাক হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে যেতেন একটার পর একটা নিজের সৃষ্টি শুনে। সব যন্ত্রণা যেন গানেগানে ঝরে পড়ত কবির চোখের জলে।
২৯ আগস্ট ১৯৭৬ কবি প্রয়াত হন। শেষ মুহূর্ত অবধি সমস্ত সেবা একা হাতে করে গেছেন উমা। শেষ সজ্জায় কবিকে সাজিয়েও দিয়েছেন নিরুচ্চার সাধনায়। বছর তিনেক পরে ১৯৭৯ সালের ২ মার্চ কলকাতায় মারা যান আবৃত্তিকার কাজি সব্যসাচী। অকালেই চলে যান অসুখে। ফলে জীবনযুদ্ধের আরও কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে উমার উপর। তখন ভগ্ন হয়ে আসছে কাজি পরিবারের যশ-খ্যাতি। একা হাতে বিখ্যাত কবি পরিবারকে কঠিন লড়াইয়ের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেন উমা। তিনি না থাকলে কাজি পরিবার আজ খ্যাতির জায়গাটা হয়তো ধরেই রাখত পারতনা। বিখ্যাত পরিবারে বিখ্যাত সদস্যদের পেছনে কাণ্ডারী কমলার মতো শক্তির উৎস হয়ে উঠেছিলেন এই উমা (Uma Kazi)।
তবে উমা কাজি কি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন মিডিয়ার সামনে? কেন? কাজি পরিবারের অন্য সদস্যরা যেখানে প্রচার আলোতেই বেশিরভাগ থাকেন সেখানে উমা আজীবন নিজেকে অন্তরালে রাখলেন কেন? কোথাও কি চারুকলায় সে অর্থে উমা পারদর্শী ছিলেননা বলেই এই অন্তরাল! এই বিভাজন! উমা নার্স থেকে কাজি পরিবারের বউ হন। কাজি পরিবারের অন্য মেয়ে-বৌদের মতো উমা গানে বা বাচিকশিল্পে পারদর্শী ছিলেননা। একজন সেবিকা, আরেকজন গায়িকার মধ্যে সেবিকাকে আমরা কোনকালেই বা সেলেব তকমা দিয়েছি? অথচ উমা আগলে রেখেছিলেন একটি তারকা পরিবারকে।
উমা যখন ঠাকুমা-দিদিমা হলেন, তখন তিনিও কবির মতোই তাঁর নাতি-নাতনিদের গল্প বলতেন। কাজি নজরুল, প্রমীলাদেবী, কাজি সব্যসাচী সকলের কথা তিনি বলতেন নাতি-নাতনিদের। তারাও কাজি নজরুলকে ছুঁতে পারত উমার গল্পে। উমা জানতেন, উত্তরাধিকারী নবীন প্রজন্মকে কবির কাজে আগ্রহী করলে কবির কাজ বেঁচে থাকবে, আরও এগোবে তাঁর সৃষ্টি। উমা যেন সারাজীবন শ্রীকৃষ্ণ সাধিকা মীরা বাইয়ের মতোই কবির সেবিকা ও সাধিকা হয়ে রইলেন।
এইভাবেই ৮০টি বসন্ত পেরিয়ে প্রয়াত হলেন উমা (Uma Kazi)। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শেষ দিকে স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছিলেন, কবির মতোই। এ বছর ১৫ জানুয়ারি ঢাকার বনানীতে প্রয়াত হন ভালবাসা, মনুষ্যত্ব ও সেবার ধর্ম সারাজীবন ধরে পালন করা মানুষ উমা কাজি। বনানীতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
কাজি বংশের শ্রেষ্ঠ মাকে বর্ণনা করা যায় নজরুলের কবিতা দিয়েই!
"হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আবদার দিন রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।"
‘অপরাজিত’ ছবিতে কয়েক মিনিটের ছোট্ট রোল ছিল জিতুর! লুক টেস্টে ম্যাজিক, শুরু এক ইতিহাস