
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
“সেই পরনে শার্ট ও ধুতি
একই রকম বসন তো,
হেমন্ত নাম হলে কী হয়
কণ্ঠে আছে বসন্ত।”
স্বর্ণযুগের সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর এই কবিতার সহজ ভাষা ও সরল আঙ্গিকে যে মানুষটি লুকিয়ে আছেন, তাঁর আজ শততম জন্মদিন। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাঙালির চিরকালের নস্ট্যালজিয়া। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহুড়া গ্রামে তাঁর পৈতৃক ভিটে। মামারবাড়ি ছিল বারাণসী। তাই বারাণসীতেই ১৯২০ সালের এই দিনটিতে অর্থাৎ ১৬ জুন জন্ম তাঁর।
বাবা কালীদাস মুখোপাধ্যায় ভেবেছিলেন, তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ছেলে ভেবেছিল, সে সাহিত্যিক হবে। চলত লেখালেখি। কিন্তু পিতা-পুত্রের কারো ইচ্ছেই এগোল না, পরে ছেলের ধ্যানজ্ঞান হল সঙ্গীত। এবং গানই হল তাঁর নেশা, পেশা, জীবন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বারাণসীতে জন্মালেও তাঁর ছেলেবেলা কাটে পৈতৃক বাড়ি বহুড়াতে। কিন্তু এর পরে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন কালীদাস ও তাঁর পরিবার। ২৬/২ এ রূপনারায়ণ নন্দন লেন, ভবানীপুরের বাড়িতেই বসবাস শুরু। হেমন্ত প্রথমে ভর্তি হল বাড়ির কাছে নাসিরুদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে। তার পরে মিত্র ইনস্টিটিউশন। বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা ছিল সমরেশ রায়, পরিমল সেন, রমাকৃষ্ণ মৈত্র এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
বার্ষিক অনুষ্ঠানে স্কুল কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র সমরেশকে দিয়েই গান গাওয়াত। অথচ হেমন্ত এত ভাল গাওয়া সত্ত্বেও তাকে ডাকা হয় না। ব্যাপারটা ভাল লাগেনি বন্ধু সুভাষের। ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে তখন ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের দফতর। পরে যার নাম হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও। সুভাষের সঙ্গেই হেমন্ত যায় সেখানে অডিশন দিতে এবং পাশও করেন। কবিবন্ধু সুভাষের কথায় গান গাইলেন হেমন্ত রেডিওতে প্রথম। সেই শুরু। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রধান অবদান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শিল্পী হওয়ার পেছনে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেন হেমন্ত। সঙ্গে চলল সঙ্গীতশিক্ষা। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষে উঠেই পড়াশোনাতে ইতি দিলেন হেমন্ত। গানই হল তাঁর সাধনা, সঙ্গে কিছু টিউশনি হাতখরচের জন্য।
তখন পঙ্কজ কুমার মল্লিক মধ্যগগনে। হেমন্তর গায়কীতে ভাব ছিল পঙ্কজের কারণ তাঁকে অনুসরণ করতেন। তাই হেমন্তর গান শুনে থাঁকে লোকে ডাকত ‘ছোট পঙ্কজ’। কিন্তু একদিন এই ‘ছোট পঙ্কজ’ নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করলেন এবং হয়ে উঠলেন লেজেন্ড।
তবে আজ আমরা জানব, গায়ক হেমন্ত নয়, মানুষ হেমন্তর গল্প। কীভাবে বিভিন্ন বিখ্যাত ছবির বিখ্যাত সব গানের নেপথ্যে জড়িয়ে আছেন হেমন্ত, কত মানুষকে কতরকম ভাবে সাহায্য করেছেন তিনি, তাঁর মন কতটা উচ্চতায় ছিল– এসবই জানব আজ ওঁর শতবর্ষের জন্মদিনে।
মনেরও কথাটি ওগো বলিতে পারিনি মুখে
রেডিও স্টেশনে গেছেন দুই বোন বেলা আর আভা। বাণীকুমারের একটা ফিচারে গান গাইতে। গিয়ে বসে আছেন আর শুনছেন, বাণীদার কে একজন বড় খোকা না এলে রিহার্সাল শুরু হবেনা। বেলা ভাবছেন বড় খোকা কত বড় গাইয়ে যার এত দর! শেষ অবধি একটা ঢ্যাঙা লম্বা ছেলে ঢুকতেই বাণীকুমার চেঁচিয়ে উঠলেন এই তো বড় খোকা এসে গেছে। ‘এই তাহলে বড় খোকা’! বলে আভা আর বেলা দুজনে হেসে উঠেছেন। বাণীকুমার বললেন ‘এই চুপ করো অসভ্যতা করবে না। আমাদের বড় খোকা কে জানো? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সেই প্রথম দেখা হেমন্ত-বেলার। শুরুতে হেমন্তদা বলে ডাকতেন বেলা।
হাসি থেকে প্রেম, প্রেম থেকে বিয়ে। বিয়ের পর পাড়ার কারা সব এসেছে হেমন্তর সঙ্গে দেখা করতে। নতুন বৌ শাশুড়িমা কে বলল, “মা ওঁরা এসছেন বাড়িতে তো হেমন্তদা নেই।” শাশুড়ি বললেন “তুমি চুপ কর তো!” স্বামীকে ভুল করে দাদা ডেকে ফেলেছেন অভ্যাসমতো। তাও পাড়ার লোকের সামনে। যাই হোক শাশুড়ি সেদিন আর বেশি কিছু ধমক দেননি।
কলকাতা থেকে বম্বের স্ট্রাগলের দিন গুলোতে নুন আনতে পান্তা ফুরতো হেমন্ত-বেলার। এত অভাবের মধ্যেও কোনও দিন ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি হেমন্তর। সবসময় অপেক্ষা করেছেন ভালো সময়ের। বেলা মুখোপাধ্যায় পরে বলেছেন “ধৈর্য্য আর অধ্যবসায়ের আর এক নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।” হেমন্ত কন্যা রাণু মুখোপাধ্যায় বাংলা গানে পপ সিঙ্গার রূপে বেশ সুনাম অর্জন করেন। বাবার সুর থেকে এ আর রহমানের সুরেও রাণু গান গেয়েছিলেন। যদিও আজ তিনি অন্তরালে।
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের ‘বালিকা বধূ’, ‘পরিণীতা’ সব হিট ছবি। তার পরে তাঁকেই ছেলে জয়ন্তর বউ করে আনেন হেমন্ত। ইন্দু ওরফে মৌসুমীকে নিয়ে নিজের প্রোডাকশানে বানালেন ‘অনিন্দিতা’। বম্বেতেও বউমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। কখনও বাড়ির বউ অভিনয় করবে না– এ সব রক্ষণশীলতা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছিল না।
হেমন্তর জন্যই কোরাসে একসঙ্গে গাইলেন গীতা-লতা
বিকাশ রায় পরিচালিত ও অভিনীত কালজয়ী ছবি ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ র মরুভূমির শ্যুটগুলো হয়েছিল দিঘার বালিয়াড়িতে। উট ভাড়া করে নিয়ে আসতে অনেক খরচ হয়। কিন্তু রোজকার শ্যুটিং হয় না, অনেক বিপত্তি। ঝড়বৃষ্টিতে শ্যুটিং বন্ধ ছিল অনেকদিন।
এদিকে ছবির গানগুলো কলকাতায় রের্কড করে হেমন্তর মন ভরল না। বিকাশ রায়কে বললেন, “মরুভূমি প্রান্তরে আদিগন্ত বিস্তৃত মরুপ্রান্তরে ছড়িয়ে পড়বে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ , সেই আবহটা পেলামনা গানে। গানগুলো বম্বে থেকে রেকর্ড করিয়ে আনলে হয় না?”
বিকাশ রায় বললেন “ঝড়-বৃষ্টিতে শ্যুটিং বন্ধ ছিল উত্তম, সাবিত্রী সহ সবাইকে বসিয়ে বসিয়ে পয়সা দিতে হয়েছে আর পারবনা টানতে।” হেমন্ত চুপ। ক’দিন পরে বম্বে ফেরত বিমানবন্দরে নেমে হেমন্ত সোজা বিকাশ রায়ের কাছে। দুটো স্পুল হাতে তুলে দিয়ে বললেন “এ নিন আপনার মরুতীর্থ হিংলাজের গান, বম্বে থেকে রেকর্ড করিয়ে আনলাম।”
বিকাশ রায় বললেন “কিন্তু কোরাস? আপনার সঙ্গে বম্বের শিল্পীরা কোরাস বাংলায় করতে পারল? যা আছে চন্দ্রাবতী, সাবিত্রীর লিপে!” হেমন্ত বললেন অবিচল ভাবে, “ধুর ওখানকার শিল্পীরা বাংলা বলতে পারে নাকি। কিছুতেই পারে না ঠিক উচ্চারণ। তখন গীতা আর লতাকে ডেকে কোরাসে আমার সঙ্গে গাইয়ে নিলাম।”
বিকাশ রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়! যেন পাড়ার শ্যামলী-মাধবীকে দিয়ে কোরাস গাইয়ে নিয়েছেন এমন সহজ ভাবে বললেন হেমন্ত। এত দামী শিল্পী, তাঁরা কিনা এমনি এমনি হেমন্তর কথায় কোরাস গেয়ে দিল। তাও কিনা যাঁরা পরস্পরের সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দী গায়িকা। হেমন্তর বন্ধুত্বে এতটাই সম্মান দিতেন লতা ও গীতা।
বিকাশ রায় বললেন “নামগুলো বললেন ভাগ্যিস। মরুতীর্থ হিংলাজ এর টাইটেল কার্ডে নামগুলো থাক।”
সুচিত্রা সেন-অসিত সেন জুটির নেপথ্যে হেমন্ত
‘জীবন তৃষ্ণা’ য় অসিত সেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বললেন ‘সাগর সঙ্গমে’ গান উত্তমের লিপে আপনি গাইবেন। হেমন্ত বললেন, “আমি বম্বেতে ব্যস্ত সময় দিতে পারবনা ভূপেন হাজারিকা সুরারোপ করুক ওঁর প্রথম কাজ উত্তমের গান ঐ গাক।”
সে উত্তমের লিপে ভূপেন না মানালেও হেমন্তর জেদে পরোপকার ব্রতে তাই করলেন অসিত সেন। কিন্তু ঝামেলা অন্যখানে। ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবির কাস্টিং ঠিক হল উত্তম, অরুন্ধতী দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, বিকাশ, পাহাড়ী, দীপ্তি রায়। হেমন্ত ফোন করে বললেন অসিত সেনকে “ও মশাই আপনার ছবির নায়িকা অরুন্ধতী তো বার্লিন চলে গেছে। এবার শ্যুটিং করবেন কাকে নিয়ে?”
অসিত সেনের মাথায় হাত। ভাবতেও পারেননি তাঁর আগের দুই হিট ছবি ‘পঞ্চতপা’, ‘চলাচল’-এর নায়িকা না বলে-কয়ে এমন কাজ করবেন। এদিকে উত্তম, বিকাশদের ডেট ফাইনাল। সেই সময়েও হাল ধরলেন হেমন্ত। অসিত সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন সুচিত্রা সেনের। সুচিত্রা রাজি হলেন। উত্তম-সুচিত্রার আইকনিক ছবি হয়ে থাকল ‘জীবন তৃষ্ণা’। তার পরে সুচিত্রা-অসিত জুটি ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’। একক ভাবে উত্তমহীন ছবিতে সুচিত্রা সেনকে নায়িকার ক্ষমতা কতখানি তা প্রমাণ করার জায়গা এনে দিল। হেমন্ত না থাকলে এই ঐতিহাসিক পরিচালক-নায়িকা জুটিই ক্লিক করত না।
আজও সব নায়িকারা চায় যদি রাধা কিংবা দেবযানী পান্নাবাঈয়ের মতো একটা স্বপ্নের চরিত্র পেতাম।
হেমন্তদা দেখালেন একটা আঙুল তুলে… বললেন সুপ্রিয়া দেবী
উত্তম-হেমন্ত জুটি যেমন আইকনিক, তেমন উত্তম-হেমন্ত বম্বেতে ছবি করা নিয়ে বিবাদও অন্দরে অন্দরে কান পাতলে শোনা যেত। কিন্তু এই বিবাদ নস্যাৎ করে সুপ্রিয়া দেবী জানিয়েছিলেন “এসব বাজে কথা। কিছু মানুষ এসব রটিয়ে আনন্দ পায়। আসলে ‘বিশ সাল বাদ’ হিট হওয়ার পরে হেমন্তদা উত্তমকে হিরো করে বম্বেতে ছবি করার কথা ভাবেন। পাবলিসিটিও হয়ে যায়। কিন্তু উত্তম পিছিয়ে আসে শেষমেষ। ওঁর কিছু পরম উপকারী বন্ধুবান্ধবের পরামর্শ এর জন্য দায়ী। যারা সারাজীবন উত্তমের ক্ষতি করে গেছে।
উত্তম যখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ করতে গেল তখনও হেমন্তদা ওঁকে কতগুলো ব্যাপারে সাবধান করেছিল। উত্তম শোনেনি। এখানেও সেই উপকারী স্তাবকের দল। শুনলে হয়তো উত্তমের জীবনের পরের ঘটনা অন্যরকম হত।”
উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর সুপ্রিয়া দেবী একটা ছবি নিজের প্রোডাকশানে প্রযোজনা করেন। ‘উত্তর মেলেনি’। দীপঙ্কর দের হিরোইন সুপ্রিয়া। তবু ছবিটা একজন একা নারীর মেয়েকে নিয়ে লড়াইয়ের গল্প। রঞ্জিত মল্লিকও ছিল। তখন উত্তম চলে গেছে, সুপ্রিয়াকে সমাজ-ইন্ডাস্ট্রি দায়ী করছে। সেসময় সুপ্রিয়াও দিশাহীন। হেমন্তকে বললেন সুপ্রিয়া, “হেমন্তদা আপনি এ ছবির সুরকার। আপনাকে কত টাকা দিতে হবে যদি আগেভাগে এই বেলা বলে দেন?”
হেমন্ত একটা আঙুল দেখালেন। সুপ্রিয়া ভাবলেন এক লাখ টাকা। বললেন “বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থা। শেষ সম্বল দিয়ে ছবিটা করছি। একটু কম হয় না?” হেমন্ত হেসে ফেললেন বললেন, “এক টাকা দিবি। বেণু, তোর প্রোডাকশন মানেই তো আমারই ঘরের ছবি। কিন্তু বউনি তো করতে হবে তাই একটা টাকা দিয়ে যা।”
এই হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
হেমন্ত দিলেন গানে সুর, পুরস্কার নিচ্ছেন অন্য কেউ
‘বাঘবন্দি খেলা’ মাল্টিস্টারার ছবি প্রযোজনা করলেন অসীমা মুখোপাধ্যায়। উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবী, পার্থ, মহুয়া অভিনীত ছবি। সঙ্গীত পরিচালনাও অসীমা মুখোপাধ্যায় করবেন ঠিক করলেন। কিন্তু মাঝরাস্তায় গেল অসীমা দেবীর টাকা ফুরিয়ে। অত বড় বাজেটের ছবি। প্রত্যেকের কাজ বাকি। দিশাহীন অসীমাকে ভরসা দিতে এগিয়ে এলেন একজন অধ্যাপক, কিন্তু বিনা স্বার্থে নয় বরং নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই। দিলেন অসীমাকে দশ হাজার টাকা। ঐ সময় দশ হাজার মানে এখন সেটা বিরাট অঙ্কের টাকা। কিন্তু সেই অধ্যাপক প্রযোজক শর্তারোপ করলেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর নাম থাকবে। তাই মানতে হল অসীমা দেবীকে।
অসীমা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “টাকার গরমে অধ্যাপক তখন ফুটছেন। না করলেন কোনও গানে সুর, না এলেন টেকিংয়ের দিন। রেকর্ডিংর দিন হেমন্তদা হাজির অথচ সেই অধ্যাপক ভদ্রলোকের দেখা নেই। শেষে হেমন্তদা এগিয়ে এলেন। নিজেই উত্তম কুমারের লিপের গান ‘আয় আয় আশমানি কবুতর’ গানে সুর বসিয়ে গাইলেন। মান্নাদার ‘টুকরো হাসির তোল ফোয়ারা’ আমি সুর করলাম। সেই অধ্যাপকের আর দেখা মিলল না রেকর্ডিংয়ে।”
ছবির টাইটেল কার্ডে টাকার গরম এগিয়ে রইল, তাই সুরকার হিসেবে উক্ত অধ্যাপকের নাম গেল। সেই অধ্যাপক এবার বিভিন্ন ফাংশনে ‘আয় আয় আশমানি কবুতর’ আর ‘টুকরো হাসির তোল ফোয়ারা’ নিজের সুর বলে গেয়ে থাকেন। আরও আশ্চর্যের বিষয়, তিনি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পুরস্কারও নিলেন ‘বাঘবন্দি খেলা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে, উত্তম গানের সুরকার হিসেবেও। সব উত্তম-স্মরণ অনুষ্ঠানে তিনি ঐ গান দু’টি গাইবার সুযোগ আজও পান।
এই হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নীরবে ছোট মনের মানুষকে ক্ষমা করে দিতেন।
‘যা কিছু পেয়েছি কাছে
তাই সঞ্চয়
যা কিছু পেলাম নাকো’
সে আমার নয়
পাহাড় নিষেধগুলো পেরিয়ে দেখি
কী আছে আমার পথে পড়ে।’
নিজের গানের কথাই নিজের জীবনে প্রমাণ করে গেছেন তিনি।
দিনের শেষে ঘুমের দেশে
বহু সহপাঠী জীবনের বন্ধু থেকে কর্মজগতের সুহৃদদের অভাবের সংসার চালাতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নিজে যা আয় করতেন তাঁর প্রথম ভাগ পাঠাতেন ঐ পরিবারগুলিকে। নিজে অসুস্থ শেষ দিকে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “খামগুলো যেন সময় মতো জায়গায় জায়গায় পৌঁছে যায়।”
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকতেন লেকের ধারে মেনকা সিনেমা হলের বিপরীতে। চেয়েছিলেন অন্য জায়গায় চলে যেতে কোলাহল থেকে। গেলেনও তাই। কিন্তু সে তো শেষ যাওয়া। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯। কলকাতার সমস্ত বাঙালির সারা ভারতের কাছে সেদিন হেমন্তদা নেই। নেই মানে নেই।
‘আমি যাই চলে যাই!
আমায় খুঁজো না তুমি…
বন্ধু বুঝো না ভুল…
যেটুকু সুরভী ছিল, হৃদয় সবই তো দিল,
এবার খুঁজবে কাঁটা,তাই ছেড়ে যাই কূল…!
বিধাতার কাছে আমি ,জানিনা তো কি চেয়েছি…
হিসাব রাখিনি কিছু কতটুকু কি পেয়েছি…’
ফুলে ফুলে সব ঢাকা। বাজছে তাঁরই গাওয়া গান। ভেঙে পড়ল টালিগঞ্জের নামী-দামী লোকরা ঐ বাড়িতে। শেষ প্রণাম, শেষ দেখা। বিরাট শোক মিছিল বেরিয়েছিল। হেমন্তর পরেই তো শীত। কিন্তু তার পরেই তো আবার বসন্ত।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সকলের মনে চিরবসন্তে হয়ে রয়ে গেলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে।
স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় গানের চর্চা ছেড়ে দেন শেষদিকে। তাসের আসরে মেতে থাকতেন। সেই নিয়ে হেমন্তর খুবই আক্ষেপ ছিল। গানটাকে ধরে থাকলেন না বেলা। হেমন্তর গান ও তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও উদাসীন ছিলেন। বেলা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় ২৫ জুন ২০০৯।
বড় নাতনি পায়েল অকালেই প্রয়াত হলেন কয়েক দিন আগে। ছোট নাতনি মেঘা, যাঁকে আমরা অভিনয় করতে দেখেছিলাম তরুণ মজুমদারের ‘ভালোবাসার একটি নাম’ ছবিতে, উত্তম পৌত্রের বিপরীতে। হেমন্তের গানগুলি সংরক্ষণে হেমন্তের পরিবারের চেয়েও হেমন্তের শিষ্যরা, হেমন্তের ভক্তরা বেশি তৎপর। তাঁরাই শতবর্ষ পার করা হেমন্তগীতিগুলিকে আজও চিরআলোচ্য করে রেখেছেন।