শেষ আপডেট: 7th June 2023 07:43
স্টাইলিশ দেবতা প্রভু জগন্নাথ, তাঁর বারো মাসে তেরো বেশ
সোমা লাহিড়ী
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
ওই যে তিনি ওই যে বাহির পথে
কেতায় তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন। অথচ ডিজাইনার মনীশ মালহোত্রা বা রোহিত বাল তাঁর পোশাকের ডিজাইন করেন না। সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ও সাজান না তাঁর ধুতি উত্তরীয়। তবু সাজসজ্জায় যে দেবতা আমাদের সব থেকে বেশি মুগ্ধ করেন তিনি প্রভু জগন্নাথ (Shree Jagannath)। তিনি আমাদের সব থেকে সাজ সচেতন দেবতা। এক একটি উৎসবে তাঁর সাজ এক এক রকম। উৎসবের ধরন অনুযায়ী বদলায় তাঁর সাজপোশাক। শুধু কি তাই? প্রভুর প্রতিদিনের সাজেও বৈচিত্র কম নয়। তাঁর সাজকাহনে চোখ রাখা যাক।

• প্রভুর রোজের সাজ স্বাস্থ্য মেনে
স্বাস্থ্যের অন্য নাম পরিচ্ছন্নতা। শ্রীজগন্নাথ (Shree Jagannath) স্বামী দিনে যতবার ভোগ গ্রহণ করেন ততবার বেশ বদল করেন। সকালে দন্তমঞ্জন ও স্নানের পর হালকা আহার গ্রহণ করেন তিন দেবতা -জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা। এই সময়ে পরণে থাকে 'অবকাশ বেশ'' মানে আমাদের ক্যাজুয়াল লিজার ওয়ার আর কি। মেটে গেরুয়া পাড়ের পাটের বস্ত্র পরেন তিনজনে।বেশ ব্রাইট দেখায় তাঁদের। এই সময় চলে অগণিত ভক্তের দর্শন। এরপর মধ্যাহ্নভোগ , অপরাহং ভোগ প্রতিটার পরেই চলে সাজবদল। তবে রাতে শয়নের সময় প্রভু অঙ্গে ধারণ করেন 'মহাশৃঙ্গার বেশ'। সিল্কের ফিনফিনে বস্ত্র আর ফুলের সাজে শয়নে যান প্রভু। শুধু তাইই নয় প্রভুর রূপচর্চা ও অঙ্গরাগ চলে বছরভর। রোজদিন।
• গ্রীষ্মে গামছা পরিধান করে চন্দনের প্রলেপ
ওড়িশায় গরম পড়ে খুব। শ্রীজগন্নাথদেবের (Shree Jagannath) বড্ড গরম লাগে যে। তাই বৈশাখে অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু হয় চন্দনযাত্রা। চলে স্নানযাত্রা পর্যন্ত। এই সময় দুপুরে ও রাতে জগন্নাথদেব , সুভদ্রা দেবী ও বলরামদেব সারা গায়ে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে গামছা পরিধান করে বিশ্রাম নেন। এই সময় পুরোহিতরাও তাঁদের ডিস্টার্ব করেন না। দুপুর ও রাত্রি ছাড়া অন্য সময়ে যখন ভক্তদের সামনে আসেন প্রভু তখনও পরণে থাকে আরামপ্রদ বস্ত্র।

• জ্যৈষ্ঠমাসে ১০৮ কলস জলে স্নান
জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে খুব কষ্ট হয় প্রভুর। তাই আসে স্নানযাত্রা পর্ব। এই সময়ে জগন্নাদেবকে সিংহাসন থেকে নামানো হয়। প্রভুকে স্নান মণ্ডপে বসিয়ে ১০৮ কলস জল দিয়ে স্নান করানো হয়। এই জল আসে সোনা কুয়ো থেকে। সারা বছর এই কুয়োর জল ব্যবহার করা হয় না।নতাই স্নান যাত্রার আগে প্রচুর কর্পূর দিয়ে পুজো করে কুয়োর জল শুদ্ধ (স্যানিটাইজ ) করে নেওয়া হয়। সেই কর্পূর জলে প্রাণ ভরে স্নান করেন প্রভু।
এত জলে স্নান করলে জ্বর তো আসবেই। প্রতি স্নানযাত্রাতেই প্রভু স্নানও করেন ,জ্বরও আসে।নব্যাস পনেরো দিন পাথরের বালিশ মাথায় দিয়ে বিশ্রাম নেন ঠাকুর। ভক্তরা তাঁর দর্শন পায় না এই সময়।

• আষাঢ়ে রথযাত্রায় জমকালো সাজ প্রভুর
আষাঢ়ে রথযাত্রার সময় তিন দেবতাই সাজেন উজ্জ্বল রঙের সিল্ক বস্ত্রে। মাসির বাড়ি বেড়াতে যাবেন বলে কথা , সাজুগুজু করে না গেলে কি চলে? ঝলমলে বেশে সেজে উঠে পড়েন রথে। পুরীর রাজা সোনার ঝাঁটা দিয়ে পথ পরিস্কার করে দেন। শুরু হয় যাত্রা। এই প্রসঙ্গে বলি প্রভু জগন্নাথদেবের (Shree Jagannath) গয়নাগাটির ভাণ্ডার কিন্তু বিপুল। বিভিন্ন দেশের রাজা মহারাজারা উপহারে উপহারে ভরিয়ে দিয়েছেন প্রভুকে। আজও ধনী ভক্তকুল প্রভুকে মণিরত্ন সুবর্ণ নিবেদন করেন।
তা যাই হোক,মাসির বাড়ি থেকে ফিরে মন খারাপ হয়ে যায় জগন্নাথদেবের। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। উল্টোরথের পরের দিন পর্যন্ত মন্দিরের বাইরে রথেই থাকেন তিন দেবতা। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই সময় তাঁদের দর্শন করতে পারেন। উল্টোরথের পরের দিন একদশী। প্রভুর মন ভাল করার জন্য এদিন রাজবেশে সাজানো হয় তাঁকে ( ভেবে দেখুন সাজলে প্রভুর মন ভালো হয়)। সোনার হাত পা চুল লাগানো হয়,বেনারসি বস্ত্র পরানো হয়,আর প্রচুর অলংকারে সাজানো হয় তাঁদের। এই সময় জগন্নাথদেবের হাতে থাকে শঙ্খ ও চক্র,বলরামের হাতে থাকে লাঙল। মন্দিরের সামনে রথের ওপরই এই বেশ বদল হয়।

• শ্রাবণে ঝুলনযাত্রায় সোনার সাজ
শ্রাবণে শুক্লপক্ষের একদশী থেকে রাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে ঝুলন।এই সময় জগন্নাথদেবের (Shree Jagannath) প্রতিমূর্তি অষ্টধাতুর মদনমোহন বের হন স্ত্রী লক্ষ্মী সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে। মন্দিরের ঝুলন মণ্ডপে সোনার দোলনায় বসে দোল খান তাঁরা। ওদিকে মন্দিরের ভেতরে জগন্নাথদেব করেন স্বর্ণবেশ। সোনার সাজে তাঁকে দেখায় ভারী সুন্দর। সোনার হাত, গলায় অসংখ্য মালা হার,কানে কুণ্ডল আর ঝলমলে পট্টবস্ত্রে প্রভুর রূপ মায়াময় হয়ে ওঠে।
• শরতে বনভোজী (বনভোজন ) বেশ
তিনি জগন্নাথ। জগতের নাথ। আমাদের প্রতিপালন করেন সারা বছর। তাই বলে কি তাঁর স্বাদ আহ্লাদ কিছু থাকবে না ! তাঁরও তো ইচ্ছে করে বনভোজনে যেতে। যানও এই ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমীর পরের দিন। এই সময় বেশভূষা হয় শোলার। এছাড়াও ভাদ্র মাসে পাঁচরকম বিশেষ সাজ হয় প্রভুর -জন্মাষ্টমীতে রাম-বলরাম সাজ, একাদশীতে কালীয়দমন বেশ , পলম্বাসুরবধ বেশ, বামন বেশ।

• বিজয়া দশমীতে ৬০ মণ গয়না পরেন
বিজয়া দশমীর তিথিতে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার রাজবেশ হয়। জগন্নাথের হাতে থাকে শঙ্খ চক্র ,বলরামের হাতে হাল আর লাঙল। সুভদ্রা সিংহাসনে বসেন আরাম করে। শঙ্খ চক্র হাল লাঙলকে পুরীর মন্দির পরিক্রমা করিয়ে দেবতার হাতে দেওয়া হয়। এই দিন প্রত্যেকে ৬০ মণ সোনার গয়না পরেন এবং সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত দর্শন দেন প্রভু।
• হেমন্তে সাতরকম মালা পাঁচরকম বেশ
কার্তিক মাসে জগন্নাথদেবের (Shree Jagannath) পাঁচ রকম সাজ বদল হয়। সব থেকে উল্লেখযোগ্য রাধাদামোদর বেশ। সাত রকম মালা পরেন প্রভু জগন্নাথ। এছাড়াও নাগার্জুন বেশ ,পুষ্যাভিষেক বেশ,গজোদ্ধারণ বেশ ও পদ্মবেশ হয় এই মাসেই।
• বসন্তে প্রভুর বেশে রঙের খেলা
ফাল্গুন চৈত্র বসন্ত কাল। দু'মাসে জগন্নাথদেবের বেশবাসে থাকে রঙের বৈচিত্র। ফাল্গুন মাসের দশমী থেকে চতুর্দশী প্রভুর কুণ্ডল বেশ। রঙিন পট্টবস্ত্রের সঙ্গে তিনজনের কানে থাকে বড় বড় কুণ্ডল। এরপর দোল পূর্ণিমা। প্রভুর এদিন রাজবেশ। রঙিন পট্টবস্ত্র আর সোনা মোতির গয়নায় সাজেন তিন দেবতা। চৈত্রমাসে রামনবমী। এই দিন প্রভু জগন্নাথের রামরাজা বেশ বা রঘুপতি বেশ। মাথায় রাজার মতো মণিখচিত পাগড়ি থাকে জগন্নাথদেবের মাথায়।
• প্রভুর লন্ড্রি বেন্টপুকুর
একবার পরিধান করার পরই তিন দেবতার পরনের বস্ত্র কাচতে চলে যায় বেন্টপুকুরে। এখানে পান্ডাদের তত্ত্বাবধানে কাচা হয়,ইস্ত্রি করা হয় প্রভুর বস্ত্র। তারপর আলমারিতে তুলে রাখা হয়। নবকলেবরের পর এই কাপড় আর পরেন না প্রভু। ভক্তরা মূল্য দিয়ে কিনে নেন প্রভুর প্রসাদী বস্ত্র। এই ট্রাডিশন আজও চলছে।