
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
হাড়ের দুরারোগ্য অসুখ নিয়ে জন্মেছিল মেয়েটি। হুইলচেয়ার-বন্দি জীবন। এমন মেয়ের কি আর পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করতে আছে! কিন্তু ইচ্ছে কবেই বা নিয়ম মেনে করে মানুষের? আর ভালবাসাও কি ইচ্ছের অধীনে থাকে? তাই নিজের পায়ে হাঁটতে না পেরেও পাহাড়ের প্রতি অদম্য টানে জড়িয়ে গেল সে। তাই বন্ধুরাই ভরসা। বাচ্চাদের প্যারামবুলেটরের মতো তার জন্য একটি কেরিয়ার বানিয়ে দিয়েছিল তারা। তাতে করেই আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় দিব্যি ঘুরে বেড়াত সেই মেয়ে। বলাই বাহুল্য, যে সব পাহাড়ি পথে প্র্যাম চলা সম্ভব, সে সব পথেই ছিল তার গতিবিধি। যেখানে পায়ে হেঁটে ছাড়া যাওয়া যায় না, সেখানে যাওয়ার খুব খুব ইচ্ছে থাকলেও… না, কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা।
কলোরাডোর ২৯ বছরের তরুণী মেলানিই নেচে-র এই পাহাড়ের প্রতি ভালবাসাই একটা আস্ত গল্প ছিল। কিন্তু গত বছর একটা বিশেষ ক্যাম্পে গিয়ে, সে গল্পের সব চেয়ে সুন্দর অধ্যায়টা যোগ হল। ক্যাম্পে গিয়ে আরও অনেক বন্ধুর মতোই আলাপ হয় ট্রেভর হ্যানমেটের সঙ্গে। ৪২ বছরের ট্রেভরও পাহাড় পাগল। চুটিয়ে ট্রেকিং করেন। কেবল গত পাঁচ বছর হল, এক জন সঙ্গী লাগছে ট্রেকিং করার সময়ে। যিনি ট্রেভরকে বলে দেন, সামনে কী আছে, এবার কোন দিকে যেতে হবে। কারণ বছর পাঁচেক হল, গ্লকোমা-তে ভুগে অন্ধ হয়ে গেছে তাঁর দু’টি চোখ। দেখতে পান না তিনি আর কিচ্ছু। কিন্তু পাহাড়ের প্রতি তীব্র ভালবাসা অবশ্য তাতে এতটুকু ফিকে হয়নি।
বন্ধুত্ব নয়, স্বপ্ন যেন
মেলানিই আর ট্রেভরের বন্ধুত্ব জমতে সময় লাগেনি বেশি। সময় লাগেনি, বন্ধু থেকে গভীর বন্ধু হয়ে উঠতে। দু’জনেই যে পাহাড় ভালবাসেন, দু’জনের মনেই চোরা কষ্ট রয়েছে, সে ভালবাসায় অন্য কারও সাহায্য নিতে হয় বলে। প্রায়ই পাহাড়, প্রকৃতি নিয়ে গল্প করতেন তাঁরা। ট্রেভর শোনাতেন দুর্গম জায়গাগুলোয় পৌঁছে যাওয়ার গল্প, আর মেলানিই বলতেন কী অপরূপ সৌন্দর্যে ভরে থাকে সে জায়গাগুলো।
এক দিন গল্প করতে করতেই হঠাৎই মনে হয়, সমতলে বসে যে গল্পগুলো তাঁরা করছেন, সেগুলোই যদি পাহাড়ে করা যেত! ট্রেভর তো হাঁটতে পারেন, মেলানিইকে পিঠে নিয়ে হাঁটলেন না হয়! আর কোন পথে হাঁটতে হবে, সেটা ট্রেভরকে তো বলে দিতে পারেন মেলানিই! বিয়েটা হতে সময় লাগেনি তাঁদের।
“আমাদের জুটি বাঁধাটা যেন ভবিতব্য ছিল। প্রেম নয়, ভালবাসা নয়। পাহাড়ে যাওয়ার খিদেই আমাদের মিলিয়ে দিল। আমি কোনও দিনও ভাবিনি, এমন এক জন বন্ধু পাব, জীবনসঙ্গী পাব, যে আমায় পিঠে করে পাহাড়ের দুর্গম ও প্রিয় জায়গাগুলো দেখাবে! এটা আমার কাছে স্বপ্ন!”– বলছেন মেলানিই। আর ট্রেভর বলছেন, “খুব কষ্ট হতো দৃষ্টি চলে যাওয়ার পরে। নিজের চোখে দেখতে না পারার যন্ত্রণা কুরে কুরে খেত। খালি মনে হতো, এমন কেউ যদি সঙ্গে থাকত, যে আমার মতো করেই পাহাড়টা ভালবাসে! আমি ভাবিনি, এমন কাউকে আমি পাব, যে ট্রেকিংয়ের প্রতিটা মুহূর্ত তেমন করেই বর্ণনা করবে, যেমন করে আমি দেখতাম। মেলানিই আমার কাছে আশীর্বাদের মতো।”
ও আমার পা, আমি ওর চোখ
মেলানিই-র জন্য পছন্দমতো একটা কেরিয়ার বানিয়ে নিয়েছেন ট্রেভর। কেরিয়ারটা পিঠে নেওয়া যায়। তাতে চড়ে বসেন মেলানিই। মেলানিইকে ব্যাকপ্যাকের মতো পিঠে তুলে নেন ট্রেভর। মেলানিই এক জন দুর্দান্ত গাইড, স্বভাবগত ভাবেই। নিজে চলতে না পারলেও, কোথায় কেমন করে কোন দিক দিয়ে চলতে হবে– এটা বুঝতে পারা যেন তাঁর সহজাত ক্ষমতা।
“ও আমার পা, আমি ওর চোখ। আমরা একসঙ্গে একেবারে সেরা জুটি কিন্তু!”– বলছিলেন মেলানিই। আর মেলানিই-র বর্ণনায় পাহাড় যেন আরও সুন্দর করে ধরা দেয় ট্রেভরের চোখে। ট্রেভর বলেন, “সব চেয়ে ভাল ব্যাপার হচ্ছে, আমি যখন মেলানিইকে নিয়ে কোথাও পৌঁছয়, কোনও কঠিন জায়গা পার করে একটা অপরূপ ভ্যালিতে গিয়ে ওকে নামাই, বাচ্চাদের মতো হাসে ও। ওই হাসি আমায় বলে দেয়, ও কতটা আনন্দ পাচ্ছে। এটা যে কী ভীষণ তৃপ্তি!” মেলানিই জানান, হুইল চেয়ার থেকে মুক্তির আনন্দে তিনি হাসেন, যে জায়গায় কখনও পা ফেলতে পারবেন না ভেবেছিলেন, সেখানে পৌঁছতে পেরে তিনি হাসেন। এ হাসি মুক্তির, এ আনন্দ স্বাধীনতার!
দেখুন, কেমন করে ট্রেক করেন ট্রেভর আর মেলানিই।
One step at a time… ???
Hiking with Sight এতে পোস্ট করেছেন রবিবার, 14 জুলাই, 2019
দয়া নয়, দায়িত্ব
মেলানিই বা ট্রেভর দু’জনেই তাঁদের বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ, পরস্পরকে খুঁজে পাওয়ার আগে যাঁদের সাহায্যে তাঁরা পাহাড়ে যেতেন। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলছেন, তাঁরা পরস্পরের কাছে যতটা সহজ, যতটা কৃতজ্ঞ, যতটা ভরসাযোগ্য, তা এত দিন কখনওই হয়ে উঠতে পারেননি অন্য কারও সঙ্গে। “সেটাই স্বাভাবিক,”– বলছেন ট্রেভর। তাঁর কথায়, “হাজার ভাল বন্ধুর সঙ্গে গেলেও আমাদের মধ্যে এত দিন কাজ করত, কেউ না কেউ আমায় সাহায্য করছে। কিন্তু আমাদের এই ট্রেকিংয়ে কেউ কাউকে সাহায্য করার ব্যাপার নেই, আমরা দু’জনেই দু’জনের ‘দায়িত্ব’। ও যেমনটা বলে আমি তেমনটাই শুনি, আর আমি যেমনটা চলি ও সেখানেই পৌঁছয়।”
মেলানিই সহমত জানিয়ে বলেন, “অন্য কারও সাহায্যে কিছু করছি, এই বোঝাটা থেকে আমরা দু’জনেই এখন মুক্ত। আবার এরকম কোনও অনুভূতিও নেই, যে আমি ট্রেভরকে সাহায্য করছি কিংবা ট্রেভর আমার জন্য অতিরিক্ত কিছু করছি। আমরা যেন একটাই মানুষ, স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটাই যেন সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক।”
অনুপ্রেরণা হতে চাই না, উদাহরণ হতে চাই
মেলানিই এবং ট্রেভর এখন তাঁদের এই গল্প শেয়ার করতে চান বাকি দুনিয়ার সঙ্গে। সে জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পেজও খুলেছেন তাঁরা। সে পেজের নাম, ‘হাইকিং উইথ সাইট’। মেলানিইর কথায়, “আমার মনে হয়, আমাদের গল্প মানুষকে সাহস জোগাবে করবে। অনেকেই হয়তো এমন অনেক কিছুই চান, যে প্রতিবন্ধকতার কারণে করে উঠতে পারেন না। আমরা তাঁদের বলব, বন্ধুর হাত ধরলে যে কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা জয় করা যায়।”
তবে একই সঙ্গে তাঁরা কারও দয়ার বা অনুগ্রহের পাত্র বা পাত্রী হতে চান না বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন মেলানিই এবং ট্রেভর। তাঁদের কথায়, “এটা খুবই বিরক্তিকর, যখন কেউ প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, যে আমাদের পা নেই অথবা চোখ নেই। আমরা তো এই নেইগুলোকেই জয় করতে চাইছি। তা হলে এটা বলার মানে কী, যে ‘ও চলতে পারে না, তবু পাহাড়ে চড়ছে!’ অথবা, ‘ও দেখতে পায় না তবু এত কঠিন পথে হাঁটছে!’ আমরা চাই, সকলে আমাদের পারা-টা দেখেই অনুপ্রাণিত হোক। আমাদের কমতি বা খামতি যেন অতিরিক্ত কোনও সহানুভূতির জন্ম না দেয়। আমাদের লড়াইটা সেখানেই।”
তাই অনুপ্রেরণা নয়, জগতের কাছে উদাহরণ হতে চান মেলানিই এবং ট্রেভর। কারণ তাঁরা দু’জনেই কোনও না কোনও দিক থেকে দুর্বল হলেও, দু’জনেই আবার কোনও না কোনও দিক থেকে সবলও। সেই সবলতা বা শক্তিটাই সকলের সামনে তুলে ধরতে চান তাঁরা। তাঁদের কথায়, “দুর্বলতা প্রত্যেকটা মানুষের থাকে। আমরা চাই না, কেউ তাদের দুর্বলতা আমাদের সঙ্গে তুলনা করুক। আমরা শুধু এটাই দেখাতে চাই, আমরা দুর্বলতাগুলো জয় করে ফেলেছি যৌথ লড়াইয়ে।”
এবং এই জয় শুধু প্রতিবন্ধকতার জয় নয়, বরং মনুষ্যত্বের জয়। দু’টি খুব ভাল মানুষের একসঙ্গে লড়াই করা জয়।