
পরনে জলপাই রঙা পোশাক, কাঁধের উপর কার্ল-গুস্তভ এম৪। টাইট করে পনিটেল করা চুল। ছিপছিপে গড়নে বড় উজ্জ্বল আর আত্মবিশ্বাসী দুই চোখ (Seema Rao)। বাঁ হাতের কব্জি থেকে বেল্টে ঝুলছে একে-১০৩ অ্যাসল্ট রাইফেল। অস্ত্রসাজে সজ্জিতা এই নারীকে দেখে থমকে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। ঠিক যেন শক্তিরূপিনী দুর্গা। পাপ নাশ করতে চলেছেন।
সাংবাদিকদের বিহ্বল ভাব দেখে মৃদু হেসে সেই সাহসিনী (Seema Rao) বলেছিলেন, “৫০ মিটার দূর থেকে মানুষের মাথার উপর রাখা আপেলে নিখুঁত নিশানা লাগাতে পারি। একটা চুলেও আঁচড় পড়বে না। দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা বুলেট থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে পারি কয়েক সেকেন্ডের ক্ষিপ্রতায়।”
ভারতীয় বাহিনীর একমাত্র মহিলা কম্যান্ডো প্রশিক্ষক ডঃ সীমা রাও (Seema Rao)
খবরের কাগজ, সংবাদ মাধ্যম জুড়ে একসময় ঝড় তুলেছিলেন এই নারী। তখন তাঁর বয়স কম। এখন তিনি ৪৯। শরীরের গড়নে, লড়াকু মনে বয়সের ছাপ পড়েনি (Seema Rao)। ভারতীয় সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা, নৌসেনা, স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ, বিএসএফ, এনএসজি এক ডাকে চেনে এই মহিলাকে। ডঃ সীমা রাও। মার্শাল আর্টের সেভেন্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট হোল্ডার সীমা রাও কমব্যাট শ্যুটিং ইনস্ট্রাকটর, ভারতীয় সেনা বাহিনীর একমাত্র মহিলা কম্যান্ডার (Seema Rao)। তাঁর পরিচয় শেষ হয় না এখানেই। অভিজ্ঞতা আর দূরদর্শিতার তালিকাটা বড়ই লম্বা।
সীমা রাও (Seema Rao) অভিজ্ঞ ফায়ার-ফাইটার, স্কুবা ডাইভার, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ডিগ্রিধারী পর্বতারোহী। তিনি চিকিৎসক আবার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে এমবিএ। তিনি প্রাক্তন মডেল। মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগfতায় ফাইনালিস্ট। তিনি লেখিকা। তিনি নারীশক্তির এক অনন্য ব্যাখ্যা (Seema Rao)।
জনৈক গে রাইটার লিখেছিলেন, মেয়েরা ততখানি বুদ্ধি ধরে না, যতখানি তাদের লাস্য! সেই সংজ্ঞাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ভারতের ‘ওয়্যান্ডার ওম্যান’ ডঃ সীমা রাও (Seema Rao)। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে প্রশিক্ষকের কাজ করছেন গত ২০ বছর ধরে। এলিট আর্মড ফোর্সেস–পুলিশ, সেনা, প্যারামিলিটারি ও কম্যান্ডো মিলিয়ে ২০ হাজারের বেশি সেনাকে কমব্যাট ট্রেনিং দিয়েছেন।
আজও সেনাদের কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণের সেরা ‘মাস্টারনি’ সীমাই। বলেছেন, “জন্ম হওয়া থেকে দেশকে ভালোবাসার কথা শুনে আসছি। দেশপ্রেম আমার রক্তে। শেষ নিঃশ্বাস অবধি দেশের জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছি।”
স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবার থেকেই অস্ত্র চালনায় হাতেখড়ি (Seema Rao)
পর্তুগীজদের হাত থেকে গোয়াকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তখন আঁটঘাট বেঁধে নেমেছেন বিপ্লবীরা। গোয়া লিবারেশন মুভমেন্টের (১৯৪০-১৯৬১) প্রথম সারিতেই ছিল অধ্যাপক রমাকান্ত সিনারির নাম। অস্ত্র চালনায় পারদর্শী, তুখোড় তাঁর বুদ্ধি। রমাকান্তের মেয়ে সীমা (Seema Rao)। বাড়ির পরিবেশে দেশপ্রেমের ছোঁয়া। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়েই যেন জন্মেছিলেন সীমা। ছোট থেকেই শিখে গিয়েছিলেন পিস্তল চালনার কলা কৌশল। আত্মরক্ষার পাঠ দিয়েছিলেন বাবা রমাকান্ত। শত্রু দমন করে দেশকে রক্ষার ব্রত নিয়েছিলেন সেই কিশোরী বেলা থেকেই।

মা চেয়েছিলেন মেয়ে ডাক্তার হোক। এমবিবিএসের পড়াশোনা চলছিলই। কিন্তু, মেয়ের ঝোঁক নানা দিকে। কলেজ থেকে ফিরে ডাক্তারির স্টেথো গলা থেকে নামিয়েই সে ছুটে যায় পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিতে। খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে অবলীলায়। বন্দুক-পিস্তলেও অব্যর্থ লক্ষ্য। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখলে মেয়ের মুখে হাসি ফোটে। যে হাতে পিস্তল চালাতে পারে, সেই হাতে আবার সুন্দর করে চুলও বাঁধতে পারে। মডেলিং-এও মেয়ের ঝোঁক। মা বুঝলেন, এই মেয়ে ইতিহাস গড়বে একদিন (Seema Rao)।
মার্শাল আর্ট থেকে রাইফেল শ্যুটিং- সীমা রপ্ত করেছিলেন কম বয়সেই
ভালবাসার মানুষের সঙ্গে প্রথম দেখা, বদলে যায় জীবন…
সীমা (Seema Rao) তখন ১৬। প্রথম দেখা মেজর দীপক রাওয়ের সঙ্গে। দীপক তখন মার্শাল আর্টের ট্রেনিং নিচ্ছেন। সীমা সবে কলেজে। দীপকের থেকে একটু একটু করে মার্শাল আর্টের কায়দা শিখছেন। ডাক্তারি পড়ার সময় গাঢ় হয় প্রেম। সীমা এবং দীপক দু’জনেই বুঝেছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য এক। মার্শাল আর্ট, অস্ত্র চালাতে ভালোবাসেন দু’জনেই। আবার পড়াশোনাতেও আগ্রহ। চার হাত এক হতে দেরি হয় না।

সীমা (Seema Rao) জানিয়েছেন, বিয়ের পরেই তাঁর জীবনে এক অভূতপূর্ব বদল আসে। মেজর রাও তখন ভারতীয় সেনা দলের ক্যাপ্টেন। মার্শাল আর্টে ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন সীমাও। ‘ল এনফোর্সমেন্ট সার্টিফিকেশন’ (CLET) কোর্সে ভর্তি হন, মেজর দীপক রাও। ওয়েস্টমিনস্টার বিজ়নেস স্কুল থেকে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে এমবিএ করে ফেলেন সীমা। এর পর দু’জনেই শুরু করেন এক নতুন জার্নি। ভারতীয় সেনা দলের প্রশিক্ষক হিসেবে শুরু হয় সীমা-দীপকের পথ চলা।

ব্রুস লি’র ছাত্রের কাছ থেকে Jeet Kune Do-র ট্রেনিং সীমার (Seema Rao)
১৯৬৭ সালে ইলেকটিক ও হাইব্রিড মার্শাল আর্টের এই বিশেষ ঘরানা তৈরি করেছিলেন ব্রুস লি। বিশ্বে মাত্র ২০ জন মহিলা জানেন মার্শাল আর্টের এই বিশেষ ধরন। প্রতিপক্ষকে সহজেই ধরাশায়ী করার এই কঠিন প্রক্রিয়া সীমা রপ্ত করেছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার রিচার্ড বুস্টলিও-র থেকে। রিচার্ড ব্রুস লি’র ছাত্র ছিলেন। Jeet Kune Do বা ব্রুস লি ঘরানার Jun Fan Jeet Kune Do মার্শাল আর্টের জনপ্রিয় প্রশিক্ষক।

২০ বছর ধরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষক ডঃ সীমা রাও (Seema Rao)
সেনার প্যারা স্পেশাল ফোর্সের কম্যান্ডো উইং, নৌবাহিনীর মার্কোস মেরিন কম্যান্ডো, বায়ুসেনার গরুড় কম্যান্ডো ও এনএসজি ব্ল্যাক ক্যাটকে প্রশিক্ষণ দেন সীমা। পাশাপাশি, আইটিবিপি-সহ নানা রেজিমেন্টের আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশের স্পেশাল ফোর্স, কুইক রেসপন্স টিম, বিএসএফকেও ট্রেনিং দেন তিনি। প্রায় ১৬ রাজ্যের পুলিশ, কোর ব্যাটেল স্কুল ও আর্মি অফিসার ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সীমা (Seema Rao)।
বলেছেন, “আমি শুধু নিয়ম শৃঙ্খলা শেখাই না, আমি সেনাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহাস্য করি। নারীদের সম্মান দিতেও শেখাই। আমি চাই যুদ্ধক্ষেত্রে সাহস ও গর্বের সঙ্গে তাঁরা দেশকে রক্ষা করুক।”
বায়ু সেনার গরুড় কম্যান্ডোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময়েই ২০০৯ সালে বায়ুসেনা প্রধানের নিমন্ত্রণ পান সীমা। সেখানে তাঁকে আইএএফ প্যারা জাম্প শেখানো হয়। বর্তমানে আইএফের প্যারা উইং বিভাগেও প্রশিক্ষকের কাজ করছেন তিনি। ভারতীয় বাহিনীর নানা বিভাগের প্রায় ২০ হাজার সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ২০১১ সালে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন সীমা রাও (Seema Rao)।

ভারতীয় সেনাদের আধুনিক ‘ক্লোজ় কোয়ার্টার ব্যাটেল‘ (CQB) ট্রেনিং দেন সীমা-দীপক
আধুনিক কম্যান্ডো কমব্যাট সিস্টেম বা বাইসন সিস্টেমে ‘ক্লোজ় কোয়ার্টার ব্যাটেল’-এর প্রশিক্ষণ দেন সীমা ও তাঁর স্বামী দীপক রাও। নিরস্ত্র অবস্থায়তেও শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম দাওয়াই শেখান তাঁরা। সীমা জানিয়েছেন, এই কম্যান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য শারীরিক শক্তির পাশাপাশি, উপস্থিত বুদ্ধি ও অসাধারণ ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন হয়। রাইফেল দিয়ে রিফ্লেক্স শ্যুটিং, কুইক শ্যুটিং, শত্রুপক্ষ আচমকা সামনে পড়ে গেলে পিস্তল ছাড়া লড়াই সবই শেখানো হয়। অ্যান্টি-হাইজ্যাক অপারেশনের সময়, রুম কমব্যাট ও স্পেস কমব্যাটের সময় প্রয়োজন হয় এই ‘ক্লোজ় কোয়ার্টার ব্যাটেল’-এর ট্রেনিং।
উন্নতমানের কম্যান্ডো প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিজেদের ‘Unarmed Commando Combat Academy (UCCA)’ খুলেছেন সীমা-দীপক। সেখানে Jeet Kune Do থেকে ক্লোজ় কোয়ার্টার ব্যাটেল সব কিছুই শেখানো হয়।
সীমার কথায়, “রিফ্লেক্স শ্যুটিং-এর নতুন ঘরানা বানিয়েছি আমরা। সাধারণত দেখা যায়, শত্রুপক্ষ যখন ৩০০ ইয়ার্ড দূরে, তখন যে কোনও আড়াল থেকে গুলিযুদ্ধ চালানো যায়। কিন্তু, শত্রুপক্ষ যদি ২০ ইয়ার্ডের মধ্যে এসে পড়ে তাহলে অনেক সময় বেকায়দায় পড়তে হয় সেনাদের। এর জন্যই এই রিফ্লেক্স শ্যুটিং।” ইদানীং কালে রিফ্লেক্স শ্যুটিং-এর এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সেনারা অনেক উপকৃত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সীমা (Seema Rao)।

ভারতীয় সেনার চারটে Army Chief Citations পুরস্কার পেয়েছেন সীমা, যা অবিশ্বাস্য। মার্কিন প্রেসিডেন্টের থেকে পেয়েছেন Volunteer Service Award এবং World Peace Diplomat Award। চলতি বছরে পেয়েছেন ‘নারী শক্তি পুরস্কার ২০১৯’। ভারতীয় বায়ুসেনার স্কাই ডাইভিং কোর্স করে পেয়েছেন প্যারা উইংস। ক্লোজ় কোয়ার্টার ব্যাটেল নিয়ে তাঁর বই Encyclopedia of Close Combat Ops বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছে।
কম্যান্ডো ট্রেনিং ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও আরও অনেক বই লখেছেন সীমা, যেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, Balidan: Essential Commando Skills for Anti Terror Ops, Handbook of World Terrorism, The Art of Success, Mind Range, Terrorism: A Comprehensive Analysis of World Terrorism, Commando Manual of Unarmed Combat।
তাঁকে ভারতীয় নারীশক্তির প্রতীক বলা হয়, কিন্তু লিঙ্গবিভাজনের বিরুদ্ধে ডঃ সীমা রাও। তাঁর মতে, মেয়েরা নিজেদের রক্ষার বর্ম নিজেরাই গড়ে তুলুক। DARE (Defence Against Rape and Eve Teasing) এর বিরুদ্ধে প্রচার চালান সীমা। তাঁর কথায়, “আমরা এগোচ্ছি। প্রগতির বার্তা সমেত আমাদের নিশান নমিত হবে না কখনও।”