
রূপাঞ্জন গোস্বামী
গুয়াংঝাউ শহর থেকে গ্রামটিতে পৌঁছতে বেশ কষ্ট করতে হয়। কর্দমাক্ত রাস্তা আর পাথুরে সেকেলে বাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো গ্রাম, চেরিয়ান। ঝুম চাষই গ্রামের মানুষদের জীবন ধারণের একমাত্র উপায়। পাহাড়ের ঢালে গ্রামবাসীরা চাষ করেন, ধান, বাজরা, ফুলকপি, শালগম। ধর্মভীরু কয়েকশো পরিবারের বাস এই গ্রামে। ধর্মে সবাই বৌদ্ধ। কিন্তু এই গ্রামকে শত শত বছর ধরে বরাভয় দিয়ে চলেছেন এক হিন্দু দেবী (Hindu Deity)।
প্রস্তর নির্মিত ছোট্ট মন্দিরে পদ্মাসনে বসে আছেন দেবী। চারটি হাত, মুখে স্মিত হাসি। দুদিকে দুই রক্ষী, দেবীর পায়ের নীচে পড়ে আছে এক দৈত্য। এই আকৃতির বিগ্রহের সঙ্গে চিনের অন্য কোনও মন্দিরের বিগ্রহের আকৃতি মেলে না। গ্রামবাসীরা এই হিন্দুদেবীকে ভগবান বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বর মহিলা রূপ গুয়ানাইনের মূর্তি হিসেবে পুজো করেন।

দেবী গুয়ানাইন (Hindu Deity)
স্থানীয় লোকেরা ভীষণ শ্রদ্ধা করেন এই দেবীকে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা পূজা করেন। চিনের অন্যান্য দেবতার আরাধনার চেয়ে এই দেবতার আরাধনা পদ্বতি একেবারে আলাদা। হাত-ঘণ্টা বাজানো হয়। ধূপ, ফল, ফুলের অর্ঘ্য দেওয়া হয়। চিনা ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, যে মন্ত্র বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রর চেয়ে কিছুটা আলাদা। বরং এই মন্ত্রের সঙ্গে প্রচুর মিল সংস্কৃত মন্ত্রের। চিন দেশের মানুষের মুখে ভাঙা ভাঙা সংস্কৃত শুনে চমকে যেতে হয়।
“এটা সম্ভবত চিনের একমাত্র মন্দির, যেখানে হিন্দু দেবতার পূজা করা হয়”, বলেছিলেন চেরিয়ান গ্রামের বাসিন্দা লি সাং লং।

লি জানিয়েছিলেন, প্রায় পাঁচশো বছর আগে ভূমিকম্পে মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়েছিল। গ্রামবাসীরা ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে বিগ্রহটি উদ্ধার করেছিলেন। নিজেদের শ্রম ও অর্থ দিয়ে পুনরায় মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন এই হিন্দুদেবীই তাঁদের সৌভাগ্যের উৎস। সেই বিশ্বাস এত শতাব্দী পরেও অটুট আছে।

এই গুয়ানাইন দেবী যে কোনও এক হিন্দুদেবীর পরিবর্তিত রূপ, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ গুয়াংঝাউ মেরিটাইম মিউজিয়ামের সহকারী কিউরেটর ওয়াং লিমিং। তিনি বিশ্বাস করেন, এই সুপ্রাচীন মন্দিরটি ছাড়াও অতীতে অনেক হিন্দু মন্দির গুয়াংঝাউ সংলগ্ন অঞ্চলে অবস্থান করত। তবে এটা বলা কঠিন যে, সে যুগে এই অঞ্চলে ঠিক কতগুলি মন্দির ছিল। তার মধ্যেই কতগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে, বা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় গবেষকরা এখনও দেবীর পরিচয় সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনও ধারণায় আসতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা একটি ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। চেরিয়ানের মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর সঙ্গে চিনের কোনও সম্পর্কই নেই। সম্পর্ক আছে হাজার হাজার কিমি দূরের দেশ ভারতবর্ষের। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দক্ষিণ ভারতের।

তাঁদের মতে এই বিগ্রহের পাথর দক্ষিণ ভারত থেকে জাহাজে করে প্রথমে বন্দরনগরী গুয়াংঝাউতে আনা হয়েছিল। কারণ কয়েক শতাব্দী আগে গুয়াংঝাউ ছিলো চিনের নৌ বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। এই বন্দরে প্রায় আটশো বছর আগে ব্যবসা করতেন কিছু তামিল ব্যবসায়ী। তাঁদের অনেকে বাস করতেন এই চেরিয়ান গ্রামে। তাঁরাই তাঁদের আরাধনার জন্য স্থানীয় ভাস্করকে দিয়ে এই প্রস্তর নির্মিত বিগ্রহ বানিয়ে নিয়েছিলেন।
অপরদিকে চিনের ঐতিহাসিকরা মনে করেন চেরিয়ান মন্দির হলো প্রাচীন চিনের ডজন খানেক হিন্দু মন্দিরের মালার একটি অংশ! এই মালার মধ্যে ছিল গুয়াংঝাউ সংলগ্ন দুটি অতিকায় হিন্দু মন্দির! যে মন্দির গুলো সং ও ইউয়ান সাম্রাজ্যে চিনে ব্যবসা করতে এসে চিনের বাসিন্দা হয়ে যাওয়া তামিল ধনপতি সওদাগররা বানিয়েছিলেন। যার প্রায় সব কটিই হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। হয়তো কালের নিয়মে বা বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপ্তির কারণে।

কিন্তু চিনে হিন্দুধর্মের শেষ চিহ্নটুকু হারাতে দেননি চেরিয়ান গ্রামের বাসিন্দারা। অবিশ্বাস্য ভাবে এবং কিছুটা নিজেদের অজান্তেই চিনের হিন্দুধর্মের নিভু নিভু বাতিটি এখনও প্রজ্বলিত রেখেছেন তাঁরা। বিগ্রহটি কে বানিয়েছিলেন, কে নিয়ে এসেছিলেন, কোন ধর্মের বিগ্রহ, এ নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই গ্রামবাসীদের।
ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ধ্বস, ভূমিকম্প, বন্যাতেও তাঁরা বুকে আগলে রাখেন বিগ্রহরূপী হিন্দু দেবীকে। কারণ গ্রামবাসীরা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনে আসছেন, এই দেবীর কল্যাণেই তো মাঠে ফসল ফলে। ঘরে আসে সন্তান। সংসারে আসে সুখ, গ্রামে আসে সমৃদ্ধি। তাই সুদূর চিনের চেরিয়ান গ্রামে ভরা সংসার নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটিয়ে দিচ্ছেন এক হিন্দুদেবী।
ধ্বংস হওয়া মন্দিরে বিগ্রহ নেই, তবুও নীলম উপত্যকা জুড়ে আছেন নীল সরস্বতী