
ব্লগ রোডহেড/৫ ওরকম মনে হয় মামু
(এই নিবন্ধের সব ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। পৃথিবী নামক গ্রহের কাহারও বা কাহাদেরও চরিত্রের সহিত মিলিয়া গেলে লেখক ও “দ্য ওয়াল” দায়ী নহে। তাহা নিছকই কাকতালীয় ঘটনা বলিয়া বিবেচিত হইবে। সুতরাং পাঠকরা লেখাটিকে গুল্প (হ্যাঁ, গল্প নয়। গল্প আর গুলের মিশেল, গুল্প) ভাবিয়া পাঠ করিলে প্রশান্তি লাভ করিব। আর ‘পড়ল কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে’ প্রবাদটি মানিয়া যদি কেহ যদি গায়ে মাখিয়া লহেন, তাহাতে এই শর্মার কিছুই করণীয় নাই।)
হিমালয়ের পীরপাঞ্জাল রেঞ্জের দেওটিব্বা (৬০০১ মি ) একটি জনপ্রিয় শৃঙ্গ। অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার টেকনিক্যাল শৃঙ্গ। মানালির কাছাকাছি হওয়ায় পর্বতাভিযান সংগঠনে সুবিধা অনেক। আবহমানকাল ধরে হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই দেওটিব্বা হলো দেবতাদের সভাগৃহ। দেবতারা সবসময় দেওটিব্বার চুড়ায় স্বশরীরে উপস্থিত থাকেন। এবং দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর মসনদ মাউন্ট ইন্দ্রাসনের (6220মি) শৃঙ্গে বসে দেবতাদের সভা পরিচালনা করেন। দেওটিব্বা ও ইন্দ্রাসন শৃঙ্গ দুটি কাছাকাছি হওয়ায় সামিটের পথ অনেকদূর পর্যন্ত এক।
এবার চলুন আপনাদের নিয়ে যাই কোনও এক সময়ের হিমাচলের দেওটিব্বা বেসক্যাম্পে। অ্যাক্লাম্যাটাইজেশন সেশন চলছে এই বিশ্বেরই কোনও একটি মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের। মানালির এজেন্সি থেকে কুক, গাইড ক্লাইম্বার, হ্যাপ ও বাদবাকি লজিস্টিক সাপোর্ট নেওয়া হয়েছে। মানালির এজেন্সি মালিক এই মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের পূর্ব পরিচিত। হিমাচলের প্রায় সব অভিযানের লজিস্টিক সাপোর্ট ক্লাবটিকে দিয়ে থাকে এজেন্সিটি। এজেন্সির মালিক আর মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সর্বময় কর্তার বহু পু্রনো বন্ধুত্ব। দুজনেই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মাউন্টেনিয়ার।তাই হিমাচলে এলে এজেন্সির মালিক আগে থেকে সব রেডি রাখেন। অফিসে গেলে খাতির আপ্যায়ন করেন। যাইহোক, রোড হেড থেকে দেওটিব্বা বেসক্যাম্প পর্যন্ত আসতে লিডার সবার শেষে হেঁটেছেন,বকবক করতে করতে। খুব কথা বলতে ভালবাসেন লিডার, বলতে দেন কম। টিমের সবার চোখে সেরা পর্বতারোহী এই মানুষটি সব অভিযানে জানিয়ে দেন, তিনি টিমের সবার খেয়াল রাখার জন্যই পিছনে হাঁটছেন। অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাকরণ মেনে। পাঠক,আপনি লিডারের দমে ঘাটতির কথাটা মাথায় আনবেন না,ওসব নিন্দুকে বলে।
আরও পড়ুন : ব্লগ রোডহেড/৪ কুমায়ুনি আকাশে ভোরের সুবর্ণরেখা
বেসক্যাম্পে টিম এসে গেছে। বেসক্যাম্পে চলছে নতুন সদস্যদের নেট প্র্যাকটিস।দলে বেসিক বা অ্যাডভান্স করে আসা সদস্য গুটিকয়। তাই কয়েকশ ফুট পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং করা ছেলে মেয়েদের পাল্লা ভারি, তাই লিডার ক্র্যাশ কোর্স চালিয়ে দিয়েছেন এখানেই। অবশ্য এর আগেই মানালিতে হাফপ্যান্ট পরে, অল-ইন-ওয়ান বুটের তলায় ক্র্যাম্পন এঁটে, হাতে আইসঅ্যাক্স নিয়ে ডেমো দিয়েছেন। জুমার লক-আনলক হচ্ছে কিনা নিবিষ্ট মনে পরীক্ষা করেছেন। চার পাঁচটা ফু্ল-লেংথ রোপ খুলিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রতিটি ইকুইপমেন্ট পরীক্ষা এবং তার সঙ্গে বারবার চড়ানো গলার ভোকাল টনিক, কখনও সদস্যদের রাংঝালাই। বিষয়? পাহাড় কি সেটা আগে বুঝতে হবে, ক্লাবের ঐতিহ্য কি, অবদানই বা কি। আজ যারা ক্লাবে আছে তারা কি কি ফেসিলিটি পাচ্ছে, কোনও ক্লাব সেটা দেয় কিনা। সদস্যদের কেন ক্লাবের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। দেওটিব্বাই এবার কেন। এর সঙ্গে কবে কোন পিক চড়েছেন, কিভাবে চড়েছেন তার খতিয়ান। কোন কোন বিখ্যাত মানুষ কোথায় কোথায় চড়েননি তার পরিসংখ্যানও দিয়ে ছেড়েছেন। লিডারের সভাসদরা বলেন নিন্দে মন্দ করা স্বভাবে নেই দাদার । দাদা যা বলেন সোজা সাপ্টা, মুখের ওপর, ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে নয়। তাই ইগোর নামগন্ধ নেই এবং নির্ভুল দাদার শাসন মেনে নিয়ে থাকতে হলে থাকো, যেতে হলে যাও। দাদা যাই বলেন, পাস থেকে রব ওঠে “ঠিক”,”রাইট”,’যা বলেছ”। ফটাফট ছবি ওঠে। আহা আহা করে কেউ দৌড়ে এনে দেয় চিনি ছাড়া কফির কাপ। সঙ্গে দাদাকে খুশি করার জন্য লুকিয়ে রাখা সল্টেড কাজু।
আরও পড়ুন : ব্লগ রোডহেড/ ৩ – হাল্লা চলেছে যুদ্ধে
আসলে কী করবে বেচারা গুলো! লেখাপড়া নেই, দাদাকে ঘিরে, দাদার ছুঁড়ে দেওয়া টাকায় বাঁচা। সবার লক্ষ্য বছরভর ক্লাবের হরেক কিসিমের ক্যাম্পে ইনস্ট্রাক্টারের জন্য বরাদ্দ দিন প্রতি কয়েকশো টাকা,আর ফ্রিতে বছরে একটা অভিযান। অভিযান শেষে মানালিতে নেমে ফ্রিতে ঢালাও বিয়ার। আসলে সারা বছরের ক্ষিদেটা আর অভাব যে বড় বালাই। তাই সবাই ক্লাবের বড়দা, মেজদা, সেজদা, নদা, ফুলদা, জলদা, বেলদাকে তেল মেরে যায়। যার যেমন উচ্চতায় আসন,তার তেমন দামের তেল।
তা লিডার, দেওটিব্বা অভিযানে ধরাধামে পাওয়া যায় এরকম মোটামুটি সব ইকুইপমেন্টই নিয়ে এসেছেন ,বাড়ি খালি করে। অভিযানে ত্রুটি রাখা চলবেনা। দেওটিব্বা বেসক্যাম্পে টানা আলোচনার পর আলোচনা চলছে। সঙ্গে অতীতের অভিজ্ঞতার চর্বিত চর্বনে কুপোকাত নতুন কচি কাঁচারা। অনেকের এই প্রথম আইসলাইনে আসা। অনেকের হিমালয় বলতে খান দুয়েক ট্রেক। তারা হাঁ হয়ে দেখছে কীভাবে অভিযান সংগঠিত হয়। এদিকে, রোডহেড থেকে বেসক্যাম্প পর্যন্ত হেঁটেছেন লিডার।জগৎসুখের প্রজেক্ট ১২০০০ থেকে পাইনবনের মধ্যে দিয়ে ছিকা, পরের দিন ছিকা থেকে সেরি (৩৬০০মি),তার পরের দিন সেরি থেকে ছোটা চন্দ্রালতালের (৪২০০মি) বেসক্যাম্পে উঠে এসেছেন লিডার। এসেছে টিমের সবাই, কিন্তু পায়ে, পিঠে ব্যাথা হতে হবে ওঁর। অন্য কারোর হলেই কেলো। টিমে বাছা দু’তিনজন ম্যাসেজ মাস্টার আছেন (ম্যানেজ মাস্টারও) গা হাত টিপতে বসে যান। দলাইমলাইয়ের ফাঁকে ঠিক ঠাক কথা লিডারের কানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত এঁরা। কারণ মাঝে মধ্যেই ক্লাবে বিদ্রোহ দেখা দেয়, ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। এঁদের ফুসমন্তরে নেমে আসে খাঁড়া, বিক্ষুব্ধদের ওপর। সাইডলাইনে বসে থাকতে হয় দিনের পর দিন। শুধু ক্যাম্পের সময় খোলা মাঠে গুড়-ছোলা, লুচি ছোলার ডাল দিতে ডাক পড়ে।ইন্সট্রাকটরের টুপিও জোটেনা।
আরও পড়ুন : ব্লগ: রোড হেড / ২ অদৃশ্য সিগন্যাল ধরতেন নিমা তাসি স্যার
যাক গত তিনদিন বেসক্যাম্প যেন কোচিং ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে । দিনে তিনবার ইকুইপমেন্ট গুলো নীল ড্রাম থেকে বের করা হচ্ছে l টেনেটুনে আরেকপ্রস্থ পরীক্ষা করা হচ্ছে। অনেক ইকুইপমেন্ট চকচক করছে, প্রায় নতুন। হয় ব্যবহার করা হয়না বা খু্ব তোয়াজে রাখা হয়।সবচেয়ে অবস্থা খারাপ ফুল লেংথ রোপগুলো শেষ বরফ কবে ছুঁয়েছে কে জানে। কয়েকশ ফুট পাথুরে পাহাড়ের তলায়, গাছে বাঁধা অবস্থায়, কচিকাঁচাদের রিভার-ক্রসিং,মাংকি ক্রলিং, খেলা করিয়েই জীবন শেষ রোপ গুলোর। বড় জোর তিরিশ ফুটের ওয়ালে পড়ে থেকে চড়া রোদের ছ্যাঁকা খাওয়া। আর কচিকাঁচাদের ওঠা নামা দেখা। কয়েল হিসেবে আসা পূর্বসূরি রোপের দল উত্তেজনাহীন জীবনের শেষে স্লিং আর লাইন হয়ে ঘুরছে আজকাল। তাই কয়েল করা সেকেন্ড জেনারেশনের রোপগুলোও একটু বরফ ছোঁয়ার তালে আছে, শেষ পরিনতির আগে। বরফ ছোঁয়ার তালে আছে আইসঅ্যাক্স, জুমার, হিবলার, ফিফি, ক্যারাবিনার, আইসপিটন, ডিসেণ্ডার, ডেড ম্যান সহ আরও কত ইকুইপমেন্টের দলও। কারণ রক ক্লাইম্বিং কোর্সের সান্ধ্যকালীন থিওরিটিক্যাল ক্লাসের মেঝেয়, নীল প্ল্যাস্টিকে শুয়ে থাকা ছাড়া আর নিজেদের কোনও ভুমিকা তারা খুঁজে পায়নি।
যাহোক,বেস ক্যাম্প ছেড়ে টিম যাবে ক্যাম্প-১ এর দিকে। বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১-এ লোড ফেরি হয়ে গেছে। আনকোরা ছেলে মেয়েরা বেসক্যাম্পে রয়ে গেলো। থামস আপ দেখিয়ে,গোটা পঞ্চাশ ছবি বিভিন্ন কায়দায় তুলে ক্যাম্প-১ এর পথে এগিয়ে গেলো বেসিক ও অ্যাডভান্স করা কয়েকজন অসমবয়সী পর্বতারোহী। ওদের মধ্যে সদ্য কিশোর থেকে যুবক হওয়া ছেলে দুটো এখনও একটাও সামিট করেনি।
ক্যাম্প-১ এস্ট্যাব্লিশড হয়ে গেছে । দুদিন অ্যাক্লাম্যাটাইজেশন চলেছে । রুট নিয়ে মুহুর্মুহু আলোচনাও হয়ে চলেছে। রেকি হয়ে গেছে। পাওয়ারফুল বাইনোকুলার দিয়ে দেখার পর লিডার ও ডেপুটি লিডারের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞর মতামত আসছে ঘন ঘন । অনেকটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বিতে অজয় বসু আর পুস্পেন সরকারের যুগলবন্দীর স্টাইলে। পিক পুজা হয়ে গেছে। গালিতে রোপ ফিক্সড করে ফিরে এসেছে এজেন্সির লোক।
পরের দিন ভোর সাড়ে তিনটে। শুভক্ষণ আগত। টিম রেডি, পিটন রিজ, গালি হয়ে সোজা ইন্দ্রাসন পিকের ক্যাম্প-১। সেখান থেকে আরও দুতিন ঘণ্টা টানলেই দেওটিব্বা সামিট। রাতের অন্ধকারে ছবিও উঠলো আরেকপ্রস্থ। নতুন ছেলে দুটি উত্তেজনায় ফুটছে।কতো ক্লাবের কতো ছেলে রাস্তা ঘাটে অনুষ্ঠানে ঘ্যাম দেখায় , কলার তুলে হাঁটে তাদের সামনে।এবার তারাও জবাব দেবে দেওটিব্বা সামিট করে। এই দিনটার জন্য নয় মাস ধরে তৈরি হয়েছে l আর ভয়ই বা কী, দুই কিংবদন্তি দাদা সঙ্গে থাকতে।
আরও পড়ুন : ব্লগ: রোড হেড / ১ হাঁড়কাপানো রাতে বিচার বসায় হিমালয়
কথা হয়েছে দুটি রোপ সামিট করবে। প্রত্যেক রোপে তিনজন করে ক্লাইম্বার। প্রথম রোপের শুরুতে এজেন্সির লোক গাইডম্যান, মিডলম্যান তরুন ক্লাইম্বার, এন্ডম্যান অভিজ্ঞ লিডার। দ্বিতীয় রোপেও একই কম্বিনেশন, এখানে এন্ডম্যান থাকবেন ডেপুটি লিডার। লিডারের অভিন্নহৃদয় বন্ধু, যিনি আড়ালে লিডারের বাপ বাপান্ত করেন।
তরুণ ক্লাইম্বার দুটি আবেগের বশে ঢিপ করে প্রণাম করে নিলো লিডার আর ডেপুটি লিডারকে।
প্রথম তরুণ – তাহলে এগোনো যাক দাদা?
লিডার -হ্যাঁ যা, তোরা সামিট করে আয়, বেস্ট অফ লাক।
দ্বিতীয় তরুণ -সেকি,তোমরা!!! তোমরাও তো রেডি (বিস্ময়ে চোখ কপালে)
লিডার -আমরা ক্লাইম্ব করব, তোদের কবে বলেছি? দেখছিস না পা ফুলে আছে (শোনা যায় প্রায় সব অভিযানেই পা ফোলে)।
প্রথম তরুণ -এত দিন তাই তো কথা ছিলো দাদা। কাল বিকেলে নিজেদের রেখেই তো রোপ ফরমেশন করলে।
দ্বিতীয় তরুণ – ও দাদা প্লিজ এটা কোরোনা।প্লিজ দাদা প্লিজ।
লিডার – লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে টিম এনেছি তোদের ব্রেক দিতে, যা করে আয়। বিনিপয়সায় কেউ এটা দেবেনা। আমি আগেই বলেছি আমি ক্লাইম্ব করবনা।
ডেপুটি লিডার – আমারও ফ্রস্ট বাইট হয়ে যাওয়া (কুড়ি বছর আগে) আঙুলটা জ্বালাচ্ছে,আমি তো পারবনা বলেই দিয়েছিলাম।না হলে এটা করে আসা কোনও ব্যাপার?
প্রথম তরুণ -কিন্তু দাদা এতো দিনের এতো আলোচনা, প্লিজ চলো।
লিডার -শোন, অভিযানে তো এক পয়সাও দিস নি, একটাও স্পন্সর আনতে পারিসনি। ক্লাবে নতুন ঢুকেছিস, ফোকোটে ক্লাইম্ব করার সু্যোগ দিচ্ছি , করে আয়।আমার ইচ্ছা আমি যাবোনা। হিম্মত থাকলে যা,না হলে টেন্টে ফের।
হিমাচলি ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সূর্যাস্ত হয়ে গেলো তরুন দুটির বুকের আকাশে।
ব্রাজিলের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা টিমে মেসি আর দি-মারিয়া না খেললে যা হয়, তাই হোলো। নার্ভফেল করল বাচ্চা ক্লাইম্বারগুলো। মওকা পেয়ে গেলো এজেন্সির গাইড। কিছুক্ষণ হাওয়া দেখে বললো,
-স্যার , এক্সপিডিশন কল্ড অফ কিজিয়ে। ইয়ে লোগকা মাইন্ড সেট ঠিক নেহি লাগতা (উদোর পিন্ডি ভুদোর ঘাড়ে চেপে গেলো)।
-হাঁ, তু লোগ সমঝ গিয়া না। ওহি করনা পড়েগা শায়েদ। দেখ তোদের (তরুণদের) জন্যই এক্সপিডিশন পোস্টপন্ড করছি। তোরা নিজেরা পিছিয়ে গেলি। তোদের মাইন্ডসেট গাইডরাও বুঝে ফেলেছে। ফিরে আমায় দোষ দিবিনা।
ক্যাম্পে ফিরে এলো ক্লাইম্বারেরা, দেওটিব্বাকে ওয়াকওভার দিয়ে। এজেন্সির লোকরা খুশিমনে রোপ খুলতে চলে গেলো। বিনা পরিশ্রমে পয়সা তাই খুব খুশি। এজেন্সির মালিক অবশ্য বলেই দিয়েছিল, চাপের ব্যাপার নেই। গেলেই বুঝবি। তবে এতটা আশা তারাও করেনি।
পরের দিন বিকেল, বেসক্যাম্পে টেন্টের বাইরে রুটি বেলছে টিমের আনকোরা এক তরুণী ও এক তরুণ। হঠাৎ টিমটাকে ফিরতে দেখে তরুণী। চেঁচিয়ে ডাকে সবাইকে। সবাই ছুটে টেন্টের বাইরে আসে।
-কি ব্যাপার দাদা,ফিরে এলে?
-আ-র-রে,ওপরের ওয়েদার ফল করেছে। ভয়ংকর অবস্থা, প্রায় সামিট থেকে ফিরতে হলো। এরা নার্ভফেল করলো। সামিট রিস্ক নিলোনা। আমিই বা কি করে রিস্ক নিতে বলি বল। আমরা দুজন করে দিতে পারতাম। কিন্তু ওদের নিয়ে নামতে হবে তাই সামিট বিড ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। কারণ আমিই তোদের সবসময় বলি পর্বতারোহণে সেফটি ফার্স্ট।
-একদম দাদা। একদম ঠিক করেছো। ওরে স্যুপ কর। হ্যাঁরে রুটি হোলো? ওরে একটা চিকেনের কৌটো কাটিস। কফি কই, দাদা কে দে, এতো টাইম লাগে কেনো রে ? চারিদিকে রব ওঠে।
নার্ভফেল করা তরুণ আরোহী দু’জন চুপ। ভিতু অপবাদ নিয়ে শহীদ হতেই হলো। সত্যিই যে তারা হিমালয়কে বড্ড ভালোবাসে, কিন্তু আসার পয়সা নেই। তাই মাথা নিচু করে লিডারের বাক্য, বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই ওদের। কিন্তু দুজনের মাথায় চলতে থাকা অংকের একই উত্তর বেরিয়েছে। অভিযানের চিত্রনাট্যে শেষ সিনটা পূর্বপরিকল্পিতই ছিলো। বছরে একবার অভিযান পাবলিককে দেখাতেই হবে ক্লাবের ব্যানারে। নইলে ক্যাম্প ব্যবসা খতম।পর্বতারোহণ ক্লাব অথচ পর্বত অভিযান করেনা, এটা পাবলিক জানলে ক্যাম্পে খদ্দের জুটবে? অ্যানসিলিয়ারি ব্যবসাপাতি চলবে ? ক্লাবের এবং ক্লাবের ভারী ভারী নামেদের কৌলিন্য থাকবে ? তাই সামিট হোলো কি না হোলো সেটা বড় কথা নয়, অভিযানে গেছে ক্লাব এটারই ফাটিয়ে প্রচার চাই।
যখন এসব চলছে , দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ক্লাবের এক বিক্ষুব্ধ মাঝবয়সী সদস্য।
এক আনকোরা ডেঁপো ছোকরা সদস্য কফি কাপ ধুতে ধুতে বললো “এরা নাকি অনেক পর্বত ক্লাইম্ব করেছে ?”
দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বিক্ষুব্ধ ডেপুটি কোয়ার্টার মাস্টার চোখ টিপে বলল “ওরম মনে হয় মামু, তুইও ঢপের চপটা সস দিয়ে খেয়ে নিলি!!”
লেখক নিজেকে বোহেমিয়ান,বাউন্ডুলে, উড়নচন্ডী এইসব বিশেষণে অভিহিত করতে ভালোবাসেন।হিমালয়কে হৃদয়ের গভীরতায় মাপেন, উচ্চতায় নয়।