ঋতুপর্ণ চলে গেছেন অকালে, তাঁর হারিয়ে যাওয়া 'সানগ্লাস'টি আজও খোঁজেন দর্শকরা
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) হলেন সেই 'হীরের আংটি', যিনি নব্বই দশকের ক্ষয়িষ্ণু বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে (Film Industry) সুস্থ, শিক্ষিত রুচির বাণিজ্যিক আর্ট ফিল্ম নিয়ে আসেন যা সাদরে গ্রহণ করে দর্শককুল। অনেকেই মনে করেন,
ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) হলেন সেই 'হীরের আংটি', যিনি নব্বই দশকের ক্ষয়িষ্ণু বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে (Film Industry) সুস্থ, শিক্ষিত রুচির বাণিজ্যিক আর্ট ফিল্ম নিয়ে আসেন যা সাদরে গ্রহণ করে দর্শককুল। অনেকেই মনে করেন, সত্যজিৎ রায়ের পর ঋতুপর্ণ ঘোষই ছিলেন সেই পরিচালক, যাঁর ছবি শৈল্পিক দিক থেকে যতটা উন্নত, ততটাই বাণিজ্যিক ভাবে সফল। তবে এ প্রসঙ্গে অজয় কর এবং তপন সিনহার নামও অবশ্য উল্লেখ্য। তাঁদের ছবি ভালবাসতেন ঋতুপর্ণ নিজেও। করের 'সাত পাকে বাঁধা' থেকে সিনহার 'গল্প হলেও সত্যি' ছিল ঋতুর প্রিয়। বাংলা ছবিতে যখন দক্ষিণী, তামিল, বাংলাদেশি ছবির হাওয়া ঢুকে পড়েছে, সেই সময় বাংলা ছবিকে ও বাঙালি দর্শকদের বিনোদনের একটা নতুন দিক খুলে দিলেন ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh)।
শুধু তাই নয়, কেন সিনেমা দেখব, কী বই পড়ব, কীভাবে ঘর সাজাব-- এই নন্দনবোধও মানুষের মধ্যে জাগ্রত করেছিলেন ঋতুই। ঋতুপর্ণ মানে শুধু তৃতীয় লিঙ্গের সফল মানুষের এক আইকন নন। ঋতুপর্ণ মানে নান্দনিক আরাম, রুচিবোধ আর মননে শিক্ষিত হওয়াও। ঋতুপর্ণ মোটেই শুধু সমপ্রেমের আইডল নন, বহু নারী পুরুষের প্রেম অপ্রেমের গল্পও বুনেছেন ঋতু স্বতন্ত্র আঙ্গিকে। সেই ছবিগুলোও (Film) যথেষ্ট সফল।
ঋতুর (Rituparno Ghosh) প্রথম ছবি ছিল ছোটদের জন্য, 'হীরের আংটি'। সেই ছবি কোনও দিন হলে রিলিজ করেনি। কিন্তু প্রথম কলকাতা দূরদর্শনে 'ছুটি ছুটি'তে দেখানো হয়। মহালয়া, পুজো কেন্দ্রিক, বনেদী বাড়ির ঘরানা নিয়ে প্রথম ছবি হল। সেভাবে বাণিজ্যিক সাফল্য না পেলেও, টেলিভিশন টিআরপি আজও বাড়ায় এই ছবিটি।
এর পরে ঋতুর 'উনিশে এপ্রিল' বাঁক বদল ঘটালো বাংলা ছবিতে। এই ছবি সে সময়ে মিনার, বিজলী, ছবিঘর, নন্দনে লোকে বিশাল লাইন দিয়ে টিকিট কেটে মাসের পর মাস ধরে দেখেছিল। সমসাময়িক অন্য কোনও বাংলা ছবি এত সাফল্য পায়নি, যা 'উনিশে এপ্রিল' পায়। এক দিনের গল্প, গান-নাচ নেই, বারবার পোশাক বদল নেই অথচ কী ভীষণ জনপ্রিয়! এমন ছবিও বক্সঅফিসে সুপারহিট (Box office Super hit) হয়! অন্য ভাবনার কাজ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ।
এর পরে তো আর ঋতুকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঋতুর একের পর এক ছবিতে বাংলার ঘরে এসছে জাতীয় পুরস্কার। একের পর এক কর্মাশিয়াল ছবির নায়ক-নায়িকাদের ঋতু দিয়েছেন অন্য পরিচয়। বলাই বাহুল্য, প্রতিটি ছবি সুপারহিট ও আলোচিত তো বটেই।
কিন্তু কীভাবে যেন ঋতুর প্রথম গল্প 'হীরের আংটি'-র পর থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ 'বড়দের সিরিয়াস ছবি'র নির্মাতা হয়ে গেলেন। সেখানে সবাই কড়া ভাষায় ঝগড়া করে। কষ্ট পায়, কষ্ট দেয়। পর্দার খসখস শব্দ, রুমালে কান্না মোছা কিংবা সাজানো ডাইনিং টেবিলে বসে মান অভিমান পালা কিংবা বড়দের জরুরি মিটিং, কিংবা সম্পর্কের জটিল আবর্ত। এভাবেই আমরা চিনে এসছি ঋতুপর্ণকে।
ঋতুর (Rituparno Ghosh) ছবিতে কমেডি কই? তাহলে কি ঋতুপর্ণ একজন পরিপূর্ণ পরিচালক নন?
অনেকেই জানেন না হয়তো, অমলিন হাস্যরসের কৌতুক ছবিও বানিয়েছেন ঋতুপর্ণ। কমেডি-থ্রিলার সে মুভির নাম 'সানগ্লাস' (Sunglass)। কিন্তু সেই ছবি আজও আলোর মুখ দেখেনি। হলে রিলিজও হয়নি। প্রিন্টও প্রায় পাওয়াই যায় না। বলতে গেলে, হারিয়ে যেতে বসেছে ঋতুপর্ণর একমাত্র বাংলা কমেডি ছবি 'সানগ্লাস'। সে ছবি সম্বন্ধে জানার কৌতূহল আজও দর্শক মহলের একাংশে প্রবল।
২০০৬-০৭ সালে ঋতুপর্ণ 'সানগ্লাস' ছবির (Sunglass) কাজ শেষ হয়। 'সানগ্লাস' ছিল দ্বিভাষিক ছবি। ঋতুপর্ণ এই প্রথম বাংলা ও হিন্দি দুটি ভার্সনে তৈরী করেন ছবি। হিন্দি ভার্সনের নাম 'তাক ঝাঁক' বা 'তক্ ঝক্'।
যে ঋতু চিরকাল সিরিয়াস ছবি দর্শকদের দিয়েছেন, তিনিই বানিয়েছিলেন এমন একটি কমেডি ছবি। ছবিটা ছিল পরকীয়া সন্দেহে কৌতুক রসের ছবি (Comedy Film)। একদম নতুন ও ফ্রেশ আইডিয়া। ছবির শ্যুট, পোস্ট প্রোডাকশান শেষ হয় অনেক আগেই। অল্প বাজেটের ছবি হওয়ায় বড় বলিউড শিল্পীরাও কম পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন কেবল ঋতুপর্ণর ছবি বলেই। কিন্তু সানগ্লাসের বা তাক ঝাঁকের শুভমুক্তি ঋতুপর্ণ তাঁর জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি।
২০১৩ সালের ৩০ মে ঋতুপর্ণ ঘোষ চলে যান। ঋতুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০১৩-র নভেম্বরে একটা শোতে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রদর্শিত করে এই 'সানগ্লাস' ছবির হিন্দি ভার্সন 'তাক ঝাঁক' ছবিটি। সেদিন হল হাউসফুল ছিল। কিন্তু সেই প্রথম, সেই শেষ। কোথায় হারিয়ে গেল ঋতুর সানগ্লাস! হিন্দি ভার্সনে একবার মাত্র দেখানো হলেও, বাংলা ভাষায় ঋতুর কৌতুক ছবিটি কখনও দেখানো হয়নি। চিরকালই বঞ্চিত রয়ে গেছি আমরা ঋতুপর্ণর লেখা চিত্রনাট্যে বাংলা কমেডি ছবি দেখার থেকে। চলচ্চিত্র উৎসবের সময় এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, কমল হাসান থেকে শাহরুখ খানও।
ছবির কাস্টিং ছিল তারকা খচিত। প্রথম বারের জন্য নাসিরুদ্দিন শাহ আর জয়া বচ্চন এই ছবিতে কাজ করেন। দুজনের সঙ্গে কাজ করা ঋতুপর্ণর কাছে ছিল একটা স্বপ্ন, যেটা বাস্তবায়িত হয়েছিল এই ছবিতে। ছবির মূল চরিত্রে ছিলেন কঙ্কনা সেনশর্মা ও টোটা রায়চৌধুরী। একটি ক্যামিও রোলে ছিলেন রাইমা সেন। তবে হিন্দি ভার্সন 'তাক ঝাঁক' ছবিতে ঋতুপর্ণ নায়ককে বদল করেন। টোটার জায়গায় সঞ্জয় সুরীকে নেবেন ভেবেছিলেন ঋতু। কিন্তু সঞ্জয়ের কোনও কারণে করা হয়নি ছবিটি, তাই এই চরিত্রটি করেন মাধবন।
[caption id="attachment_255328" align="aligncenter" width="820"] সানগ্লাসের চিত্রনাট্য পড়া ঋতু, টোটা, মাধবন ও কঙ্কনা। সঙ্গে অর্ঘ্যকমল মিত্র।[/caption]
কেমন ছিল 'সানগ্লাস'-এর কাহিনি বিন্যাস?
ছবির মূল চরিত্র মুন্নি, যার ভূমিকায় কঙ্কনা সেনশর্মা। মুন্নির স্বামীর চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরী। হিন্দিতে মাধবন। মুন্নির মায়ের ভূমিকায় জয়া বচ্চন। আর মুন্নির স্বামীর অফিস কলিগের রোলে রাইমা সেন। এবং পুরনো অ্যান্টিক জিনিসের দোকানের মালিক নাসিরুদ্দিন। এমনই একটি দোকান থেকে কঙ্কনা পান একটি সানগ্লাস, যেটি চোখে পরলে অন্যের মন পড়তে পারা যায়।
[caption id="attachment_255330" align="aligncenter" width="545"] সানগ্লাসের শ্যুটে জয়া।[/caption]
কঙ্কনা সেই চশমা পরে, তাঁর স্বামী অফিস কলিগের সঙ্গে প্রেম করছে কিনা সেটা দেখে ফেলতে পারেন, আবার জুতো ব্যবসায়ী জুতো দেখাতে গিয়ে নগ্ন নারীর পায়ে হাত দিতে চায় কিনা, সেই গুপ্ত রহস্যও ফাঁস করে দেয় এই মায়াচশমা। কিন্তু অন্যকে সন্দেহ করার পাশাপাশি এই সানগ্লাস দিয়েই নিজের গোপন গল্পও খুলে যায়। কমেডি, পরকীয়া, হাস্যরসের মোড়কে যৌনতাকে ব্যবহার করে এক অন্যরকম মন ভাল করা ছবি ছিল 'সানগ্লাস'।
দেখুন সে ছবির ট্রেলার।
https://youtu.be/fdz9ZcflYuU
ছবিতে কম পারিশ্রমিকেই গান গেয়েছিলেন ঊষা উত্থুপ, শান, সুনিধি চৌহান। ছবির এডিটর অর্ঘ্যকমল মিত্র ও সিনেমাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায়। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা রাজা নারায়ণ দেব ও ২১ গ্রামস-এর। 'প্ল্যানম্যান মোশন পিকচার্স'-এর কর্ণধার অরিন্দম চৌধুরী, যিনি এই ছবির প্রযোজক, তিনি বলেছিলেন ২০১৫তে ছবিটির হলে রিলিজ করা হবে। কিন্তু সেখানেও কাজ এগোয় না।
আজ, ২০২০তে সে 'সানগ্লাস' খুঁজে পাওয়াই দায়। ছবির পুরনো ট্রেলার ঘিরে আজও রয়েছে দর্শক মহলে উন্মাদনা। কিন্তু প্রযোজক গোষ্ঠীর মুখে কুলুপ। প্রশ্ন একন একটাই। ঋতুপর্ণর অগণিত ভক্ত-অনুরাগী কি সেই বিশেষ সানগ্লাসে চোখে রেখে আর একটি বার ঋতুপর্ণর ম্যাজিক দেখতে পাবেন না? এ উত্তর সময়ের হাতেই হয়তো ছেড়ে দিতে হবে।
গৌরী ঘোষ যেন ঋতুপর্ণর মা ছিলেন ‘অসুখ’ ছবিতে, একজন অভিনেত্রীকেও হারাল শিল্পীমহল