
ছিয়াশি বছর বয়েসেও, নিখুঁত ভাবে স্থির থাকা হাতের শক্ত মুঠোয় ধরা থাকে পিস্তল। বার্ধক্যেও তাঁর দৃষ্টিশক্তি, শিকারি বাজের মতো তীক্ষ্ণ। পরনে সাদা শার্ট, নীল স্কার্ট। আর মাথায় বাঁধা স্কার্ফ। লোকে বলে উড়ন্ত মাছিকে গুলি করে নামানোর মতো নির্ভুল নিশানা তাঁর। তিনি চন্দ্র তোমর। মিডিয়া ও খেলাধুলা জগতের পরিসংখ্যানবিদদের কথায়, তিনিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক (Revolver Dadi) মহিলা শার্প শ্যুটার (Sharpshooter)।
উত্তর প্রদেশের বাগপত জেলার জোহরি গ্রামের জাঠ, বৃদ্ধা চন্দ্র তোমর, উত্তর ভারতের যে কোনও গ্রামের আর পাঁচজন সাধারণ নানি বা দাদির মতোই দেখতে। কিন্তু, সারা গ্রাম, জেলা, রাজ্য ও দেশ তাঁকে চেনে ‘শ্যুটার দাদি’ বা ‘রিভলভার দাদি’ (Revolver Dadi) বলে।
প্রতিযোগিতায় লক্ষ্যে অবিচল রিভলভার দাদি (Revolver Dadi)
অথচ তিনি বন্দুক হাতে তুলেছেন ৬৫ বছর বয়েসে, ১৯৯৯ সালে। এখন তো তিনি একজন বিখ্যাত, জাতীয় পর্যায়ের শ্যুটার। এ পর্যন্ত জাতীয় স্তরে ১০ মিটার পিস্তল ইভেন্টে, ৩০টি পদক জিতেছেন চন্দ্র তোমর (Revolver Dadi)। রিভলভার দাদিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত সর্বভারতীয় মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বলিউড তারকারাও।
ভরা সংসার এই রিভলভার দাদির। ৮ ছেলে মেয়ে, ১৫ জন নাতি নাতনি নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটছিল প্রৌঢ়া চন্দ্র’র। কাছেই ছিল একটি রাইফেল ক্লাব। তিনি তাঁর এক নাতনিকে জোহরি রাইফেল ক্লাবে ভর্তি হতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কিশোরী নাতনি একা একা পুরুষদের ক্লাবে যেতে ভয় পাচ্ছিল। তাই ওই কিশোরী দাদিকেও সঙ্গে যেতে বলেন। রোজ, সংসারের সব কাজ সেরে আর পাঁচজন দাদি বা নানির মতোই নাতনিকে নিয়ে ক্লাবে যেতেন।
একদিন খেলার ছলেই পিস্তল তুলে টার্গেটে ফায়ার করেন, জীবনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে না তোলা দাদি (Revolver Dadi)। ক্লাবের অভিজ্ঞ কোচ ফারুখ পাঠানকে স্তম্ভিত করে, চন্দ্র তোমরের পিস্তল থেকে বেরিয়ে আসা গুলিগুলো নিখুঁত ভাবে লক্ষভেদ করে। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, হাততালি দিয়ে ওঠেন উপস্থিত অভিজ্ঞ শ্যুটাররাও।
সবাই দাদিকে (Revolver Dadi) অনুরোধ করেন রাইফেল ক্লাবে যোগ দিতে। সবার উৎসাহে ক্লাবে যোগ দেন ৬৫ বছরের দাদি। ক্লাবের কোচ পাঠান পরে বলেছিলেন, “দাদি জন্ম থেকেই শ্যুটিং স্কিল নিয়ে এসেছেন। কারণ তিনি স্থির হাত আর তীক্ষ্ণ চোখ নিয়ে জন্মেছেন”।
দু’বছর কোচ পাঠানের কাছে ট্রেনিং নিয়ে চন্দ্র তোমর একটি প্রতিযোগিতায় নামেন। যেখানে তাঁকে দিল্লি পুলিশের একজন ডিআইজি-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করতে হয়। সবাইকে অবাক করে ডিআইজি সাহেবকে পিস্তল ইভেন্টে হারিয়ে দেন দাদি। প্রতিযোগিতা জয়ের পরে সেই ডিআইজি সাহেব দাদির সঙ্গে ছবি তুলতে অস্বীকার করেন, লজ্জায় মুখ লাল করে বলেন “কিসের ফোটোগ্রাফ? আমি একজন মহিলার কাছে অপদস্থ হলাম”।
ইউক্রেন ফেরত ডাক্তারি পড়ুয়াদের বড় স্বস্তি! দেশেই ইন্টার্নশিপের সুযোগ
যে গ্রামে মেয়েরা স্কুলে যায় না। বাড়ির বাইরে কাজ বা চাকরি করার অনুমতি নেই। সেখানে একজন বৃদ্ধার পক্ষে পিস্তল ধরা সত্যিই খুব কঠিন ছিলো। তাঁর পরিবারের লোকেরা রেগে যাবে বলে রিভলভার দাদি লুকিয়ে শ্যুটিং প্র্যাকটিস করতেন। হাতের ব্যালান্সের উন্নতি করার জন্য, ভর্তি জলের জাগ হাত সোজা অবস্থায় ধরে থাকতেন প্রায় আধ ঘন্টা। একদিন কাগজে নিজের ছবি দেখে প্রচন্ড ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলেন চন্দ্র (Revolver Dadi)। কাগজের ছবির অংশটি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, যাতে সেটি তাঁর স্বামী দেখতে না পান।
রিভলভার দাদির (Revolver Dadi) খ্যাতির ভয় ছিল
কিন্তু এত চেষ্টা করেও তাঁর খ্যাতি লুকাতে পারেননি দাদি (Revolver Dadi)। পরে মিডিয়াকে বলেছিলেন, “আমার আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা প্রথমে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন। তারপর আমি জাতীয় স্তরে পুরস্কার পেতে শুরু করলাম। মিডিয়া আমার নামে লিখতে শুরু করল। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জানতে পারলেন । তখন তাঁরা গর্বিত ও খুশি হলেন, আমার ভয় কাটল। তাঁরা এখনও হাসেন, তবে গর্বের হাসি”।
এখনও চন্দ্র সপ্তাহে একদিন, জোহরি রাইফেল ক্লাবে প্র্যাকটিসে আসেন। বাকি ছয়দিন কাটে বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারের হেঁসেল, কাচাকাচি, গরু বাছুর, খাটাল নিয়ে। দিনের কাজের শেষে, নিজের প্রাইভেট শ্যুটিং রেঞ্জে রিভলবার দাদি (Revolver Dadi) শ্যুটিং প্র্যাকটিস করেন। শয়ে শয়ে নতুন ছেলেমেয়েদের নিজের প্র্যাকটিস রেঞ্জে ট্রেনিং দেন। তাঁর অনেক ছাত্রীই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পেরেছেন, রিভলবার দাদির কাছে শেখা শ্যুটিং স্কিলের দৌলতে।
তাঁর নাতনি সীমাও একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শার্প শ্যুটার। ২০১০ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রাইফেল ও পিস্তল ইভেন্টে, তাঁর বিভাগে ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে সোনা পান চন্দ্র’র আর এক নাতনি শেফালী। হাঙ্গেরি আর জার্মানির বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্যুটারের খ্যাতি অর্জন করেছেন শেফালী। তাঁদের সব সাফল্যের জন্য নাতনিরা সর্বাগ্রে কৃতিত্ব দিয়েছেন আদরের দাদিকে।
‘রিভলবার দাদি’ চন্দ্র তোমর (Revolver Dadi) চান, মহিলারা স্বনির্ভর হোন এবং নিজের সুরক্ষা নিজেরাই করুন। তিনি ভবিষ্যতে তাঁর গ্রাম জোহরিতে একটি হস্টেলও করতে চান। যেখানে অন্য প্রদেশ থেকেও ছেলেমেয়েরা এসে থাকতে পারবেন এবং তাঁর কাছে ট্রেনিং নিতে পারবেন।
ভাবলেই অবাক হতে হয়, উত্তর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক অখ্যাত দাদি, শুধুমাত্র অধ্যাবসায় আর জেদের জোরে আজ সেলিব্রেটি। তিনি নিয়মিত সর্বভারতীয় টিভি শোতে আসেন। অনেক বলিউড তারকা তাঁর গ্রামে গিয়ে দাদির (Revolver Dadi) পা ছুঁয়ে এসেছেন।
সবচেয়ে মজার কথা হল, তাঁর গ্রামের মেয়ের বিয়েতে এখন আর পণ লাগে না। রিভলভার দাদির (Revolver Dadi) গ্রামে ছেলের বিয়ে দিতে পেরে ধন্য হন ছেলের আত্মীয়স্বজন। ভুট্টা ক্ষেতের ওপার থেকে দাদির নিজস্ব শ্যুটিং রেঞ্জ থেকে ভেসে আসা পিস্তলের গগনভেদী আওয়াজও, পণ না নেওয়ার আরেকটা কারণ হতে পারে।