শেষ আপডেট: 28th September 2022 21:15
গরিব কৈবর্তের ঘরে অমন রূপবতী মেয়েও জন্মায়! হালিশহরের লোকের মুখে মুখে ফিরত সেই জিজ্ঞাসা। গঙ্গাতীরবর্তী হালিশহর অবশ্য বেশ পুরোনো জনপদ। 'আইন-ই-আকবরি'তে সাতগাঁর অন্যতম পরগনা হিসাবে হাবেলিশহরের নাম পাওয়া যায়। এই 'হাবেলিশহর' থেকেই না কি হালিশহর। পলাশির যুদ্ধের পর প্রায় ৩৫ বছর কেটে গেছে ততদিনে৷ সুতানুটি গোবিন্দপুর কলিকাতায় জাঁকিয়ে বসেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ সাহেবেরা। গঙ্গার ওপারে হালিশহরে অবশ্য এসব পটবদলের আঁচ তেমন পড়েনি। আধ্যাত্মিক ছায়ায় মোড়া বাংলাদেশের সেই শান্ত জনপদে বৈষ্ণব হরেকৃষ্ণ দাসের মাটির কুঁড়ে আলো করে জন্মালো সেই মেয়ে।
দুই ছেলের পর এক মেয়ে। বাবা, মা, বিধবা পিসির নয়নের মণি। আর সে মেয়েও ভারি অদ্ভুত। ছেলেবেলা থেকেই ঠাকুর-দেবতায় ভারি বিশ্বাস মেয়েটির। গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মতো পুতুলখেলায় মন নেই তার। সংসারের কাজকর্মে মা রামপ্রিয়া দেবীকে সাহায্য করার পাশাপাশি দিনের বেশিরভাগ সময়টাই মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে পুজো-আচ্চায় কেটে যায় তার। তেমনই একবার কী একটা পার্বণ উপলক্ষে ১০ বছরের কিশোরী গঙ্গা-নাইতে গেছে ত্রিবেণির ঘাটে। বড় ঘাট। দূরে গঙ্গায় ভেসে বেড়াচ্ছে কত না পানসি, বজরা! বিশেষ তিথি উপলক্ষ্যে ভিড়ও যেন অন্যান্য দিনের থেকে বেশি। পুণ্যস্নানের জন্য দূর দূর থেকে ছুটে এসেছে মানুষজন। সেই লোকজন মুখরিত ঘাটে গ্রামের মেয়ে-বউদের ভিড়েও শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছে সেই অপরূপা কিশোরী। (Rani Rasmani)
সুদূর কোলকাতা থেকে বিরাট নৌকোযোগে সেদিন গঙ্গাস্নানে এসেছিলেন বাবু রাজচন্দ্র দাস। কলকাতার এক প্রাচীন মাহিষ্যবংশীয় ধনাঢ্য জমিদার প্রীতিরাম মাড় ওরফে প্রীতিরাম দাসের ছোটছেলে বাবু রাজচন্দ্র। বিয়ের বছরেই স্ত্রীবিয়োগ হওয়ায় সেসময় মনে মনে কিছুটা মুষড়ে ছিলেন তরুণ রাজচন্দ্র। মন ভালো করতেই ত্রিবেণী আসা। আর সেখানেই তাঁর চোখ আটকে গেল গঙ্গাতীরে স্নানরতা এক অপরূপা কিশোরীর মুখে। মনে মনে ঠিক করলেন, আবার বিয়ে করলে এ মেয়েকেই বিয়ে করবেন। (Rani Rasmani)
সেটা ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ। বৈশাখ মাসের এক পুণ্যলগ্নে দরিদ্র হরেকৃষ্ণ দাসের কনিষ্ঠা কন্যার বিয়ে হল কলকাতানিবাসী বাবু রাজচন্দ্রের সঙ্গে। রাজচন্দ্রের বয়স তখন ২১, নববধূর ১১। এত বড় ঘরে মেয়ের সম্বন্ধ হবে এ কথা কস্মিনকালেও ভাবেননি হরেকৃষ্ণ। ছেলের বউকে সোনা হিরে জহরতে মুড়িয়ে ঘরে তুললেন জমিদার প্রীতিরাম। সর্বগুণান্বিতা সুলক্ষণা কন্যা, রাসমণি দাসি, বিয়ের কিছু পরেই স্বামী যার নাম বদলে দিলেন। দাসি নয়, তাঁর নতুন পরিচয় হল 'রানি রাসমণি' (Rani Rasmani)। এই নামেই ইতিহাস মনে রেখেছে তাঁকে।
বিয়ের পরপরই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পুরোনো বাড়ির পাশে নতুন প্রাসাদ বানানোর হুকুম জারি করেন রাজচন্দ্র। আর সেই নতুন মহলের সর্বেশ্বরী হয়ে ওঠেন রানি রাসমণি। নিত্যপুজো থেকে রান্নাবান্না, ঘরকন্নার সব কাজেই কিশোরী রানির পারদর্শিতা ছিল অবাক করার মতো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু গৃহকর্মেই নয়, বিষয়সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের কাজেও রানির ভূমিকা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এ ব্যাপারে স্বামী রাজচন্দ্রের আগ্রহ আর প্রশ্রয়ও কম ছিল না! জমিসম্পত্তি থেকে মামলা-মোকদ্দমা- সব ব্যাপারেই স্ত্রীর মতামতকে গুরুত্ব দিতেন রাজচন্দ্র।
রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর জমিদারি দেখভালের সব দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রানি। শুধু রক্ষণাবেক্ষণই নয়, রানির বিচক্ষণতা আর সুশাসনে জমিদারির উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটে। এ ব্যাপারে তাঁকে পালা করে সাহায্য করত তাঁর তিন জামাতা।
সম্পত্তিও নেহাত কম ছিল না! রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পরে হিসেব করে দেখা গিয়েছিল বিপুল স্থাবর সম্পত্তি, জমিজায়গা, একাধিক বাড়ি ছাড়াও নগদ টাকাই ছিল ৬৮ লাখ। এছাড়া বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শেয়ার ৮ লাখ টাকা, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দেওয়া ঋণ ২ লাখ টাকা এবং সায়েব কোম্পানি হুক ডেভিডসনকে দেওয়া ঋণ ১ লাখ টাকার হিসেবও পাওয়া যায়। এক অসহায় বিধবার পক্ষে এই প্রভূত পরিমাণ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ যে মুখের কথা নয়, সে তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু রানির চরিত্রের তেজ, তাঁর ওজস্বিতা, দূরদর্শিতা এবং মধুর ব্যবহার সকলের প্রিয় করে তুলেছিল তাঁকে। (Rani Rasmani)
প্রশাসক হিসাবেও রানি রাসমণি ছিলেন সুনিপুণ। মিষ্টি কথায় তো জমিদারি চলেনা, সেক্ষেত্রে দরকারে বলপ্রয়োগ করাই ধর্ম। ক্ষেত্রবিশেষে রানিও সংহারমূর্তি ধরেছেন অনেকবার। তবে অত্যাচারী নয়, বরং প্রজাহিতৈষী শাসকরূপেই ইতিহাস মনে রেখেছে রানি রাসমণিকে। শোনা যায়, গঙ্গায় মাছ ধরার জন্য গরিব জেলেদের উপর একবার কর বসিয়েছিল ইংরেজ সরকার। অনাদায়ে জেল-জরিমানা তো ছিলই, এছাড়া জেলেদের রীতিমতো মারধোর শুরু করেছিল কোম্পানির সেনারা। নিরুপায় জেলেরা রানির কাছে এই অত্যাচারের বিহিত চেয়ে দরবার করলে রানি গঙ্গার ইজারা নিয়ে তার একূল থেকে ওকূল পর্যন্ত বিরাট এলাকা মোটা মোটা লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া সরকার পড়ে মহা ফাঁপড়ে। তাদের বড় বড় জাহাজ যাওয়া-আসার পথ বন্ধ। ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসাতেও৷ রানির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেও লাভ হয় না। অগত্যা রানির শর্তেই রাজি হতে হয় শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের। জেলেদের উপর চাপানো অন্যায় কর তুলে নিতে বাধ্য হন তাঁরা।
জানবাজারে রানি রাসমণি বাড়ির দুর্গাপূজা আজও কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ। আগের সেই জাঁকজমকের ছিটেফোঁটাও নেই, তবু বনেদি বাড়ির এই পুজো দেখতে আজও ভিড় করে রাজ্যের নানাপ্রান্তের মানুষ। ১৭৯০ সাল নাগাদ এই দুর্গাপুজোর সূচনা করেন রানি রাসমণির শ্বশুরমশাই প্রীতিরাম দাস মহাশয়। প্রীতিরামের মৃত্যুর পর ওঁর ছেলে রাসমণি দেবীর স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাস এই পুজো চালিয়ে নিয়ে যান। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও পুজো থামেনি। ১৮৩৬ সাল থেকে রানি রাসমণি এই পুজোর দায়িত্ব নেন। রানির আমলে জাঁকজমক অনেক বেড়ে গিয়েছিল পুজোর। বলিদানের প্রথাও ছিল। এই দুর্গাপুজোতেই সখী বেশে দেবীর সেবা করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
সেইবার রানি আর মথুরবাবুর অনুরোধে দুর্গাপুজোয় জানবাজারে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। পূজা চলছে। ধূপধুনোর গন্ধে ভরে গেছে ঠাকুরদালান। হঠাৎ মথুরবাবুর খেয়াল হল, দেবীমূর্তির পাশে বেনারসি পরা ওই সুরূপা যুবতিটি কে? এ বাড়িতে আগে দেখেছেন বলে তো মনে হয় না! ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও গা-ভর্তি দামি সোনার গয়না আর শাড়ি দেখে কোনও সম্ভ্রান্ত অভিজাত বাড়ির অন্তঃপুরিকা বলেই মনে হয়। সে নারী তখন ভাববিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন দেবী প্রতিমার দিকে। হাতে চামর। সেই চামর দুলিয়েই তিনি ব্যজন করছেন দশভুজাকে।
পুজো শেষ হতেই প্রায় কর্পূরের মতো উবে যান সেই রহস্যময় নারীও। অবশ্য কিছু পরেই সেই সালঙ্কারা রমণীর রহস্য ভেদ হয়। জানা যায়, স্বয়ং গদাধর ঠাকুরই যুবতির বেশে হাজির হয়েছিলেন ঠাকুরদালানে৷ মিটিয়ে নিয়েছিলেন সখীরূপে মা জগদম্বাকে সেবা করার বহুলালিত ইচ্ছে। সেবার প্রায় একমাস রাসমণি ভবনে বাস করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। দুর্গা পুজোর পর কালী পুজো কাটিয়ে রানির বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো সেরে ফিরে যান দক্ষিণেশ্বরে।
এই দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়েও গল্প কম না। কথিত আছে, নৌকোযোগে কাশীতে তীর্থ করতে যাওয়ার পথে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন রানি। দেবীর আদেশ অনুসারেই কলকাতা থেকে চার মাইল দূরে গঙ্গার পূর্বতীরে দক্ষিণেশ্বরে তিনি দেবী 'ভবতারিণী' মন্দির স্থাপন করবেন বলে মনস্থ করেন। মন্দিরের ২০ একরের প্লটটি জন হেস্টি নামে এক ইংরেজের কাছ থেকে কেনা হয়। কিন্তু তখনকার নজরে রাসমণি ছিলেন একে নারী, তায় নীচু জাতের বিধবা। যতই টাকার জোর থাকুক না কেন, তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে তখনকার ব্রাহ্মণদের কাছে অনেকটা 'বাঁদর হয়ে চাঁদে হাত' দেবার মতো ছিল।
মন্দিরের জন্য জমি কিনতে সেসময় বিস্তর হাঙ্গামা পোহাতে হয় রানিকে। জোট বেঁধে গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টাও করেন কয়েকজন জমিদার। এমনকি রানিকে আটকাবার জন্যে কোর্টে মোট ১৬ বার কেস করেছিলেন এক পয়সাওয়ালা ব্যক্তি। অবশ্য কোনওবারই সুবিধে করতে পারেননি। মন্দিরের কাজে বাধা আসছে দেখে রানি নিজেই নাকি প্রতিপক্ষের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন সটান। কিন্তু কাজ হয়নি। (Rani Rasmani)
মন্দির প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে সেসময় একাধিক মামলা চলেছিল। টাকাপয়সার হিসেবে গরমিল হওয়ায় মন্দির নির্মাণের দায়িত্বে থাকা বড়জামাই রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে সেসময় অর্থ তছরুপের মামলা করেন রানি। এমনকি ছোটজামাই মথুরামোহনের বিরুদ্ধেও বিষয়সংক্রান্ত মামলা ঠোকেন আদালতে।
মজার ব্যাপার, প্রতিক্ষেত্রেই পারিবারিক বিবাদের জল বেশিদূর গড়ায়নি। কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েজামাইদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নেন রানি। এইসব টুকরো ঝামেলায় মন্দিরের কাজও ব্যাহত হয়। ১৮৪৭ এ শুরু হলেও সমগ্র মন্দির কমপ্লেক্স নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ৮ বছর। খরচ হয়েছিল তখনকার দিনের হিসেবে প্রায় নয় লক্ষ টাকা। এই মন্দিরেই পুজোর সময় বিষয়চিন্তা করার অপরাধে ছোট পুরোহিত গদাধর ঠাকুর চড় মারেন রানির গালে। সেও এক গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের সময় রানির বয়স ছিল ৬১। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর আর মাত্র পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন রাসমণি। শেষের কয়েক বছর দক্ষিণেশ্বরে প্রায় যেতেনই না। কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত ছোটজামাই মথুরবাবুর উপর। জানবাজার থেকে সেসময় মাঝেমধ্যেই রানি চলে আসতেন আদিগঙ্গার পাড়ে কালিঘাট এলাকায় তাঁর স্বামীর তৈরি দো-মহলা বাড়িতে। এখানেই ধুমধাম করে কালীপুজো করতেন, থাকতেন মাসের পর মাস।
এই বাড়িতেই জীবনের শেষ ক'টি দিন কাটিয়ে গেছেন রানি রাসমণি। ১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই বাড়ির উত্তর দিকের একটা ঘরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও রানির নানা পুণ্যকর্ম, দান-ধ্যানের গল্প আজও মুখে মুখে ফেরে মানুষের৷ মহাপুরুষদের ইতিহাসে নিজের চরিত্রমহিমাতেই উজ্জ্বল হয়ে আছেন এই বাঙালি মহীয়সী।