শেষ আপডেট: 10th April 2024 12:50
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এসো হে বৈশাখ..
বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। তার মধ্যেই অন্যতম পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। নতুন বঙ্গাব্দকে আবাহন করার দিন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই দিনটির সঙ্গে বাঙালির আবেগ, ভাবনা ও উচ্ছ্বাস জড়িয়ে। আকবরের আমলের কর আদায়ের একটি ক্যালেন্ডারেই রমরমা শুরু পয়লা বৈশাখের। বাঙালির নতুন বছর সেই তারিখপঞ্জিরই উদযাপন। ইতিহাসবিদেরা বেশির ভাগই এক মত, বাঙালি যতই দুই দেশে ভেঙে আলাদা হোক, পয়লা বৈশাখের আবেদনে অন্তত হিন্দু, মুসলিমে ভেদ নেই।
২০২৪ সালের পয়লা বৈশাখ কবে ১৪ না ১৫ এপ্রিল?
পয়লা বৈশাখ সাধারণত ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল পড়ে। এ বছর পয়লা বৈশাখ পড়েছে ১৪ এপ্রিল রবিবার। ১৩ এপ্রিল শনিবার পড়েছে চৈত্র সংক্রান্তি। আর তার পরের দিন ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪৩০ সাল শেষ হয়ে ১৪৩১ পড়ছে। অর্থাৎ রবিবার ১৪ তারিখ থেকেই শুরু হচ্ছে ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
বৈশাখী মাহাত্ম্য
আকবরের আমল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। ইতিহাস বলছে, এই দিনেই হজরত মহম্মদ জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এই ঘটনা আরবি ভাষায় ‘হিজরত’ নামে পরিচিত। এর ৯৬৩ বছর পর যখন আকবর সিংহাসনে বসেন (৯৬৩ হিজরি, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ), তখন এই হজরত মহম্মদের স্মৃতিবিজড়িত এই পুণ্য দিনটি পালনের রীতি শুরু হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে সব প্রজা খাজনা, শুল্ক পরিশোধ করে দিত। বৈশাখের প্রথম দিন হত উৎসব।
শোনা যায়, বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ জমিদারদের উপর নবাবি কর্তৃত্ব রাখার জন্যে বৈশাখে ‘পুণ্যাহ’ প্রথা চালু করেন। বিশেষ দিনটিতে জমিদারেরা নৌকায় চেপে দামি দামি উপঢৌকন নিয়ে মুর্শিদাবাদে আসতেন। তারপর নবাবের দরবারে খাজনা জমা করতেন। সোনার মোহর নজরানা দিলে নবাব তাঁদের পদমর্যাদা অনুসারে পাগড়ি, পোশাক, কোমরবন্ধ দান করতেন। মুর্শিদকুলি খাঁ পুণ্যাহ নাম দিলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল হালখাতারই আর এক রূপ। ক্রমে এই প্রথা বাংলার নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত ও ফারসি, দু’টি ভাষাতেই পাওয়া যায়। সংস্কৃত ‘হল’ শব্দের অর্থ লাঙল। তার থেকে বাংলায় এসেছে হাল। আর ফারসি ভাষায় ‘হাল’ মানে হল নতুন। বৈশাখে সে কালে নববর্ষ পালনের উৎসব হত না, সেটি ছিল ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার দিন। আর এই সময় রাজা, মহারাজ, সম্রাটরা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষিজমির খাজনা আদায় করতেন। ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। চাঁদ দেখে হিজরি সন গণনা করা হত। এদিকে বাংলায় চাষবাস হত সৌরবছরের হিসেব অনুযায়ী। ফলে অসময়ে ও অকালে কৃষিপণ্যের বিপুল খাজনা দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতেন চাষিরা। পরবর্তীসময়ে প্রজাদরদী সম্রাট আকবর এসে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের আমল থেকেই পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব। যার মধ্যে ধর্ম নয়, বঙ্গজীবনে আর্থিক বছরের যোগ রয়েছে। বাঙালিরা মনে করতেন, আর্থিক বছরের শুরুর এই দিনটি থেকে সমৃদ্ধি, সুখ, নতুন প্রত্যাশা বাড়তে থাকে।
তবে ভিন্ন মতও আছে। ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন বাংলার রাজা শশাঙ্ক এই বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন।
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উদযাপনের দিন
চৈত্র শেষে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে হয় গাজন, চড়ক। এটি ধর্মীয় উৎসব। আবার এই বাংলারই অনেক জায়গায় প্রাচীন পুণ্যাহ প্রথায় নতুন ফসল ঘরে তুলে উৎসব পালন করা হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে অর্থনৈতিক জীবন। আকবরের সময়ে এই দিনটিতে জমিদাররা প্রজাদের ঋণ দিতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কারণে রাজস্ব জমা করতে না পারলে তা মকুব করে দেওয়া হত। এই দিনটি ছিল সামাজিক আদানপ্রদানের দিন। স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে সেই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে।
বাংলা নববর্ষ কখনওই ধর্মের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ এই উৎসবে বাংলার মানুষ— সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান— মহানন্দে যোগ দিতেন। একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়াদাওয়া, আনন্দ উৎসব, নতুন সাজ সব মিলে সারা বছরের অন্য দিনগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সেজে উঠত এই দিনটি। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। যা কিছু পুরনো, যা কিছু গ্লানি তা বছরশেষের ভেলায় বিসর্জন দিয়ে নতুনকে আবাহন করার দিন। পয়লা বৈশাখ ভেদাভেদ নয়, উদযাপনের দিন, এই দিনের একটাই মন্ত্র "মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা"।
বাংলা আর বাংলাদেশের ক্যালেন্ডার কিন্তু আলাদা
বাংলাদেশে কিন্তু ‘পহেলা বৈশাখ’ মানে জাতীয় উৎসব। একুশে ফেব্রুয়ারি এবং পহেলা বৈশাখ দু’টোই বাঙালির মজ্জায় মিশে। একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের, পহেলা বৈশাখে শুধুই আনন্দের। এপার বাংলা আর ওপার বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক মিল। কিন্তু দুই বাংলায় এক দিনে পয়লা বৈশাখ পালন করা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে পালন করা হয় ১৫ এপ্রিল। কিন্তু বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল। এ বছর পশ্চিমবঙ্গেও ১৪ এপ্রিল পালন করা হবে পয়লা বৈশাখ।
বাংলাদেশ যখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অংশ ছিল তখন ভারতীয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে সরকার ১৯৫২ সালে পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব দেয়। সেই পঞ্জিকা অনুসারে, পয়লা বৈশাখ ছিল ১৪ এপ্রিল। যদিও মেঘনাদ সাহা যে সংস্কারটি করেন, তা কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গে ১৯৬৬ সালে ড. মহম্মদ শহিদুল্লাহের পরিচালনায় একটি কমিটি পুরনো বাংলা দিনপঞ্জির সংশোধন করে। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই পঞ্জিকা গ্রহণ করে। এরপর, জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা ও প্রতি বছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই হয়ে থাকে। ভারতের রাজ্যগুলিতে যে দিনপঞ্জি ব্যবহার করা হয়, তা সংস্কৃত গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তে উপর ভিত্তি করে লেখা। তাই দিনপঞ্জিকা দুই দেশের আলাদা।