পৃথিবী জুড়েই এই ক্রান্তিকালে লেখা হচ্ছে কবিতা। লেখা হচ্ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাতেও। কখনও তা ক্ষতের শুশ্রূষার কাজ করছে, কখনও প্রকাশ ঘটাচ্ছে দ্রোহের। ভারতবর্ষের চারটি ভাষার ছ’জন কবির ছ’টি কবিতায় উঠে এল এই সময়ের বিভিন্ন মুখ, অনুভব আর অনুষঙ্গ
পৃথিবী জুড়েই এই ক্রান্তিকালে লেখা হচ্ছে কবিতা। লেখা হচ্ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাতেও। কখনও তা ক্ষতের শুশ্রূষার কাজ করছে, কখনও প্রকাশ ঘটাচ্ছে দ্রোহের। ভারতবর্ষের চারটি ভাষার ছ’জন কবির ছ’টি কবিতায় উঠে এল এই সময়ের বিভিন্ন মুখ, অনুভব আর অনুষঙ্গ। মূল ভাষাগুলি থেকে নয়, ইংরেজি অনুবাদ থেকেই কবিতাগুলির বাংলায় রূপান্তর ঘটিয়েছেন অংশুমান কর।
একা
কে. সচিদানন্দন
ঘরে বসে আছি একা।
জানলা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি বাইরে
শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতেই যে উবে যায়নি,
পৃথিবীটা এখনও রয়েছে।
ওই যে একটা বড়সড় তেঁতুল গাছ।
তার নীচের দিকে একটা ডালে একটা দোলনা বাঁধা।
একটা ছোট্ট ছেলে দোল খাচ্ছে, উপরে উঠছে, উঠছে...
গাছটা দাঁড়িয়ে আছে সোজা, সতর্ক রয়েছে
যাতে ছেলেটা পড়ে না যায়।
একটা বাছুর আর একটা বেড়াল
লেজ খাড়া করে
এই দৃশ্যটা দেখছে।
ছেলেটার বাবা একটা খবরকাগজ পড়ছে।
তাতে ছাপা হয়েছে একটা ছোট্ট মেয়ের ফোটো।
ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার মুখের অদ্ভুত মিল।
কিন্তু মেয়েটা মৃত।
যে জীবন মেয়েটাকে ছেড়ে গেছে
সেই জীবন রয়েছে ওই
তেঁতুল গাছটার শাখাতে।
খুবই উত্তেজিত হয়ে সে তার জীবিত ভাইটিকে
দোলনার দোল খেতে দেখছে।
ঘরে বসে আছি আমি একা
আর তাকিয়ে রয়েছি জানলা দিয়ে
শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতেই যে উবে যায়নি,
পৃথিবীটা এখনও রয়েছে।
বাইরে একটা ঘোড়া দ্রুত ছুটে যাচ্ছে।
ওর পিঠে বসে রয়েছে এক শিকারি
প্রতিদিন সূর্যের মতো যে
তরুণদের রক্তে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়ে সুন্দর হয়ে উঠছে।
ঘোড়াটার খুরের নীচে কেঁপে কেঁপে উঠছে পৃথিবী।
ওর কেশরে লেগে রয়েছে টাটকা রক্ত
রক্ত যা সরে গিয়ে লেগে যাচ্ছে একটা দোলনায়।
ঘরে বসে আছি আমি একা
আর পৃথিবী বসে রয়েছে একা, বাইরে।
কাঁকন পরা অমলতাসের এক শাখা
জানলা দিয়ে আমার দিকে একগোছা ফুল ছুড়ে দেয়
একটি শিশুর জীবন রয়েছে এই পুষ্পগুচ্ছের সন্ধিতে।
ওটা আমার জীবন।
ফুলের গুচ্ছটা এসে পড়ে আমার শরীরে।
বাতাস ওকে আলতো দুলিয়ে দেয়
মনে হয় যেন ওটা একটা দোলনা
মনে হয় আমিই যেন এক শিশু বসে রয়েছি
একটা তেঁতুল গাছের সঙ্গে বাঁধা ওই দোলনায়
আমার গ্রামের উঠোনে
আমাদের বাড়ির দক্ষিণে
আর মৃত্যুর উত্তরে।
কে. সচিদানন্দন মালয়ালাম ভাষার একজন প্রধান কবি। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত। ইতালি সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন নাইটহুড অব দ্য অর্ডার অব মেরিট। অনূদিত হয়েছেন একাধিক ভাষায়। লন্ডন, নিউইয়র্ক, বার্লিন, প্যারিস, মস্কো সহ বিশ্বের একাধিক শহরে পড়েছেন কবিতা।
এই বসন্তে রাজহাঁসেরা
অশ্বিনী কুমার
কেউ ভাবেনি
এই ভয়ংকর নির্জন দিনগুলিতে
মাটি আর ইটের মুখোশ পরে
ঝাঁকে ঝাঁকে কাজ হারানো পরিযায়ী
এই পরিত্যক্ত শহরে হাজির হবে।
ওদের সঙ্গেই নেমে এল
আর্মেনিয়ান রাজহাঁসেরা; দলে দলে
বসন্তের খেয়ালি ছায়ার মধ্যে।
ওদের ঘর্মাক্ত গোলাপি ডানা থেকে
সদ্য বানানো আশ্রয়শিবিরগুলির ওপরে
ঝরে পড়তে লাগল শুকনো সরষের পাতা
শূন্য পাকস্থলি ঝাপটে
খাবার আর জলের জন্য ক্ষুধার্ত, নাকি সুরের কান্নায়
ওরা ধীরে ভরে তুলল আকাশ।
সংক্রমিত রক্তের গন্ধে রেগে উঠে
শহরের সচ্ছল মানুষেরা নিজেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াল
নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার মুহূর্তগুলিতে
কথা বলতে লাগল অচেনা পাথুরে কণ্ঠস্বরে।
অশ্বিনী কুমার ইংরেজি ভাষার একজন প্রধান কবি। পেশায় টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (মুম্বাই)-এর অধ্যাপক। তাঁর শেষ কবিতার বই “বেনারস অ্যান্ড দ্য আদার” জয়দেব ন্যাশনাল পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ডের জন্য লং লিস্টেড হয়। সম্প্রতি তাঁর একটি কবিতার বই “আর্কিটেকচার অব অ্যালফাবেট” হাঙ্গেরিয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অনিদ্রা
সবিতা সিং
ও আমার দেশ, আমার ক্ষতে প্রলেপ দাও।
বেশি কিছু চেয়ো না আমার থেকে।
মাত্র কয়েকজনের ফুর্তির জন্য
কীভাবে তোমার নাগরিকরা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
মাত্র কয়েকজনের খিদে মেটাতে গিয়ে
দিন ক্ষুধার্ত, রাত্রিও।
জঙ্গলের পর জঙ্গল ভরে রয়েছে
রাইফেল আর কার্তুজে।
গাছগুলো জেগে রয়েছে সারারাত্রি।
কোনও কিছুই স্থায়ী হচ্ছে না
পুরুষরা না, মহিলারা না, শিশুরা না
রাত্রি না, রাত্রির রহস্যও না।
রাত্রি একটা প্লাস্টিকের ফুলের মতো
এখন খুব তুচ্ছ একটা জিনিস।
ওর চোখে বিঁধে রয়েছে স্বপ্ন
এই অনিদ্রার থেকে
জেগে উঠছে
একটা নতুন দেশ।
সবিতা সিং মূলত হিন্দি ভাষায় কবিতা লেখেন। ইগনুতে জেন্ডার এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপিকা। হিন্দি আকাদেমি পুরস্কার, মহাদেবী বর্মা পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। অনূদিত হয়েছেন জার্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়।
লকডাউন
কেদার মিশ্র
একটানা বাজতে থাকা একটা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন
আমার নীরবতাকে আঁচড়ে দিচ্ছে।
এই পৃথিবী আর তার সাতশো পঞ্চাশ কোটি মানুষ
একে অন্যের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে
মুখে মাস্ক
মনে হচ্ছে যেন প্রত্যেকেই এক একটি মৃত্যু
এই মৃত্যুপুরীতে, বলো, কেউই কি আর বেঁচে রয়েছে?
টেলিভিশনে খবর দেখাচ্ছে
তুমি যদি বেঁচে থাকতে চাও, তোমাকে মরতেই হবে
তোমাকে মরতেই হবে হয় অনাহারে
নয় এক অজানা ভাইরাসের আক্রমণে।
তোমাকে মরতেই হবে হয় অবসাদে
নয় দারিদ্র্যে।
তোমাকে মরতেই হবে তোমার নিজের খাঁচার ভেতরে।
তুমি তোমার মৃত্যু নিজেই বেছে নেবে
তুমি রাস্তায় বেরিয়ে এলে
পুলিশ তোমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে
তুমি যদি বাড়িতে থাকো
ক্ষুধার্ত শিশুদের দৃষ্টির চাবুক
তোমাকে মেরে ফেলবে।
মাটি আর আকাশ দুই বন্ধনীর মতো দু’দিক থেকে চেপে ধরবে তোমাকে
অনেকটা মৃত্যুর ফাঁদের মতো।
তোমার খুপরির গায়েই দাঁড়িয়ে থাকা বহুতলের দিকে তুমি তাকিয়ে থাকবে
সেখানে থাকেন এক বাবু-দম্পতি। অন্ত্যাক্ষরী খেলতে তাঁরা ব্যস্ত।
তাঁরা এখন জাতীয়তাবাদী ছুটি উদ্যাপন করছেন।
তুমি কখনও তাঁদের জিজ্ঞেস করতে পারবে না
আমার মতো একজন গরিব মানুষ
আপনাদের এই দেশভক্তির মানচিত্রে কোথায় বাঁচবে?
তুমি জন্মেছই মারা যাওয়ার জন্য
তোমার কুষ্ঠিতে লেখা রয়েছে অন্তহীন দুর্দশা।
কীভাবে তোমার মৃত্যু হবে ঠিক করতে
একদিকে রয়েছে খিদে আর অন্যদিকে ভাইরাস।
তুমি বেঁচে থাকবে না মরবে
তা নিয়ে কেউ বিচলিতই নয়
তুমি যদি সত্যিই মারা যাও
তোমার দেশের পতাকা কোনওদিন অর্ধনমিত থাকবে না।
কেদার মিশ্র ওড়িয়া ভাষায় কবিতা লেখেন। সাংবাদিক, শিল্প সমালোচক, অনুবাদক কেদার একজন মানবাধিকার কর্মী। অনূদিত হয়েছেন ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, মালয়ালাম, নেপালি ভাষায়।
বিচ্ছিন্নতার গান
দুর্গাপ্রসাদ পাণ্ডা
সেই সময়টা ঠিক কখনও ছিল কি
যখন আমরা বিচ্ছিন্ন বোধ করিনি?
যখন আমাদের বন্ধুরা এগিয়ে গিয়েছিল
আমাদের থেকে
হয়ে উঠেছিল বড় বড় নাম
তাদের কায়দার অ্যাকসেন্ট
কী অদ্ভুত আর অপরিচিত লেগেছিল।
যখন আমরা তাদের
উঁচু স্তম্ভের থেকে
কথা বলতে শুনেছিলাম
আমাদের মনে হয়েছিল
আমরা কত নিঃসঙ্গ আর বিচ্ছিন্ন।
তখন কি আমাদের বিচ্ছিন্ন মনে হয়নি
যখন আমাদের কাছের মানুষেরা
এমন ভান করত যেন আমাদের অস্তিত্ত্বই নেই
আর বিরক্তিতে মুখ বেঁকিয়ে চলে যেত?
যখন আমাদের বিপদের মধ্যে রেখে
আত্মীয়স্বজনেরা জীবনের ট্র্যাকে
রেসের ঘোড়া হবে বলে আলাদা করে নিয়েছিল পথ?
আমাদের মনে হয়েছিল আমরা বাদ পড়লাম, বিচ্ছিন্ন হলাম
যখন যাদের সঙ্গে বড় হয়েছি তারা
আমাদের থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়েছিল
ভাগ্য, পরাজিত স্বপ্ন আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার
কাছে আমাদের ফেলে রেখে।
ঝাঁকুনি খেয়ে আমরা নড়ে উঠেছিলাম
যখন আমাদের প্রতিটি দুঃখ
আমাদের শেকড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে
আর ভেতর থেকে আমাদের একটু শূন্য করে দিয়ে
চলে গিয়েছিল।
আমরা চিরন্তন পতিত
আমাদের অন্তরিন আত্মা
দূরত্ব বজায় রেখেই বেঁচে থাকে।
আমাদের মতো অদ্ভুত, পাগল এবং বোকা লোকেদের জন্য
বিচ্ছিন্নতা এক ঋতু
যা কখনও শেষ হয় না।
বিচ্ছিন্নতা এক উষ্ণ কম্বল যা দিয়ে আমরা
নিজেদের ঢেকে রাখি
অন্যদের দৃষ্টির হিমশীতলতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে।
বিচ্ছিন্নতা রয়েছে আমাদের হাড়ে, শরীরে, চামড়ায়
এবং আমাদের অস্তিত্ত্বের একেবারে
অন্দরে।
দুর্গাপ্রসাদ পাণ্ডা ওড়িয়া এবং ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে থাকেন। অনুবাদক এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি পরিচিত। সম্প্রতি সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত কবি জয়ন্ত মহাপাত্রর ওপর একটি রিডার তিনি সম্পাদনা করেছেন।
লকডাউন সিম্ফনি
সনেট মণ্ডল
ঝড়ে উড়ে আসা এপ্রিলের মরীচিকাগুলি
নিরন্ন রেখেছে শহরের স্মৃতিগুলোকে।
কালবৈশাখীতে স্নান করবে বলে
কখনও সখনও ওরা অল্প অল্প ফুটে উঠছে।
আমার ঘরের ব্যালকনি আর জানলা
বয়ে নিয়ে আসছে স্পন্দন–
টিভি সিরিয়ালের শব্দ, কোন একটা টক শোর বিতর্ক,
দূর থেকে ভেসে আসা সুর, একটা কর্কশ ঝগড়া
ডিনারের মিশ্র গন্ধ...
ভেতরে আমার পোষা কুকুরের নাকের ডাক খেলা করছে
সিলিং ফ্যানের ক্লান্তিহীন কিচকিচ শব্দের সঙ্গে।
কাগজের ওপর আঁচড় কাটছে একটা কলম
যখন পতঙ্গদের সঙ্গীত চেষ্টা করছে
শহরের ওপর অলস ভাবে জাঁকিয়ে বসতে থাকা কুয়াশাকে
সরিয়ে দিতে।
দিগন্তে
রাত্রিকে ঘিরে ফেলছে
নিঃস্তব্ধতার এক সিম্ফনি।সনেট মণ্ডল ইংরেজি ভাষার কবি। কপার কয়েন প্রকাশিত তাঁর বই “কারমিক চ্যান্টিং” ইতিমধ্যেই সমাদৃত। আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া সহ পৃথিবীর নানা দেশের কবিতা উৎসবে তিনি কবিতা পড়েছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার একাধিক পত্রিকায় সনেটের লেখা প্রকাশিত হয়েছে।অংশুমানের ব্লগ ‘দিন অন্তরিন’দেখা হোক রাস্তায় আবার