শেষ আপডেট: 9th February 2025 11:06
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ‘কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে’। আত্মজীবনী পাঠে উৎসুক পাঠকদের এভাবেই নিরুৎসাহিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজেও ‘জীবনস্মৃতি'র কালসীমা আটকে রেখেছিলেন প্রাক-মানসী পর্ব পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথের যুক্তি ছিল: ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে যেহেতু তাঁর যথার্থ ‘কবি’ হিসেবে উত্তরণ হচ্ছে, তাই এবারকার কাব্যগ্রন্থগুলি পাঠ করলেই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ভাঙাগড়ার হদিশ মিলবে। আগের ইতিবৃত্ত ধরা আছে ‘জীবনস্মৃতি’তে। আর বাকিটুকুর জন্য তো রচনাবলি রইলই!
আজ কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলার প্রেস কর্ণারে উদ্বোধন হল এমন একটি গ্রন্থের, যার ভূমিকা কথনে (সাহিত্যিক অমর মিত্রের লেখা) উল্লেখ রয়েছে ‘জীবনস্মৃতি’র। প্রচ্ছদ উন্মোচনের বাসরেও বারবার উচ্চারিত হয়েছে রবিঠাকুরের আত্মজীবনীর প্রসঙ্গ। কিন্তু এই তুলনা এসেছে রচনার স্বাদুতা ও শৈলীর সূত্র ধরে। আখ্যানের চলন, বয়ান ও সামগ্রিক পরিকল্পনায় যদিও দুটি বইয়ের কোনও মিল নেই। রাঢ় বাংলার সাহিত্যিক বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত আত্মকথা ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’ এমন একটি গ্রন্থ, যা আত্মকথনের চিরাচরিত ভাষ্যকে একই সঙ্গে গ্রহণ ও বর্জন করেছে। আত্ম-উন্মোচনের সীমিত বৃত্তে তা আত্মজৈবনিক। আবার বৃহত্তর বৃত্তে তা একটি সমাজ পরিসরের প্রতিনিধি-স্বর হয়ে উঠতে চেয়েছে।
বীরেন্দ্রকুমারের জন্মস্থান পশ্চিম সীমান্তবাংলার কোলিয়ারি অঞ্চল। গ্রামের নাম বালিজুড়ি। পাণ্ডবেশ্বর থেকে কয়েক মাইল দূরেই যার অবস্থান। জাতিবিন্যাসে ব্রাহ্মণ্যপ্রধান। সময়বিন্যাসে বীরেন্দ্রকুমার বিশ শতকের তিনের দশক থেকে পাঁচের দশককে বেছে নিয়েছেন। এই সময়পর্বে অশান্ত বাংলা, অশান্ত ভারত। স্বাধীনতা, দেশভাগ, দাঙ্গা, নাগরিকবিনিময়, জনবিন্যাসে পরিবর্তন—সময়ের গ্রন্থিতে স্থায়ী আঁচড় ফেলেছিল টুকরো টুকরো এমনই কিছু ঐতিহাসিক ‘ঘটনা’। অথচ কোন এক আশ্চর্য জাদুবলে এই সমূহ ‘ঘটনা-পরম্পরা’ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল রাঢ়বাংলা। বঙ্গভূমির উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল যেভাবে উদ্বাস্তুস্রোতের মোকাবিলা করেছিল, আত্মস্থ করেছিল বদলে যাওয়া জাতিপরিচয়ের চাপ—রাঢ়ভূম সে সবদিক দিয়ে নিরুপদ্রব, অচঞ্চল। তার ভৌগোলিক উচ্চাবচতাও যেন বর্ম হয়ে তাকে রক্ষা করে গেছিল। আর এর ফলেই দীর্ঘকাল বাহিত কৌমজীবন, বিচার-সংস্কারকে সযত্নে লালন করে যেতে পেরেছে বঙ্গের পশ্চিমতট। বালিজুড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। এই অখণ্ড, অটুট সংস্কৃতির এক মনোরম আখ্যান ২৪টি ছোটবড় এপিসোডে বিধৃত করেছেন বীরেন্দ্রকুমার। ভূমিকা কথনে এবং মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে দাঁড়িয়েও এই ঐতিহাসিকতার দিকে আগত শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন লেখকের সুযোগ্য পুত্র আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা’ তাঁর পদের নিশান হলেও একজন স্বাদু গদ্যকার ও সাহিত্যের রসজ্ঞ হিসেবেও তিনি আদৃত।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাহিত্যিক ভগীরথ মিশ্র ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি'তে উঠে আসা লেখকের শৈশব ও কৈশোর জীবনে দৃকপাত করেছেন। ব্যাগ হাতে স্কুলে যাওয়া, পাঠাভ্যাস, পারিবারিক সংস্কার কীভাবে এক গ্রাম্য বালকের রুচির নির্মাণ ঘটায়, তার আলেখ্য ব্যক্তিগত হলেও অর্জন করেছে সর্বজনীনতার স্বাদ। ভগীরথবাবু ফেলে আসা বাল্যজীবনের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেয়েছেন। নিজেও রাঢ় সংস্কৃতির আত্মজৈবনিক আখ্যান রচনায় প্রাণিত হয়েছেন। একটি ব্যক্তিগত বয়ান কীভাবে কালসীমানার গণ্ডি ডিঙিয়ে বৃহত্তর জনপদের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে, তার সার্থক প্রমাণ ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্যদের মধ্যে একালের বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিনতা রায়চৌধুরী গ্রন্থে বিম্বিত অন্তর্লীন বিষাদের সুরকে শ্রোতা-পাঠকদের নজরে আনেন। লেখক যে ‘সততা’র সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন, যে অপরাধবোধ, সরলতা নিয়ে নিজের জীবনকে মেলে ধরেছেন, তা বিনতার ভাষায় ‘শিক্ষণীয়’। বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কলমের রাশ খুলে লিখেছেন। ফলে পৌনঃপুনিকতা এসেছে। কিন্তু তা যেন জীবনের বাস্তবতারই নামান্তর। আর এই কারণেই গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে ‘উপাদেয় আত্মজীবনী’। মত বিনতার।
সবশেষে বলতে উঠে সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে আত্মচরিতের নির্যাসটি তুলে ধরেন এভাবে: ‘লেখক যখন পাঠকের আত্মজন, তখনই আত্মকথা সার্থক। পায়ে পায়ে পাঁচালি’ পাঠক হিসেবে অন্তত আমার আত্মজন হয়ে উঠেছে।’
মোড়ক উন্মোচনের আসরে বালিজুড়ির বহু মানুষ উপস্থিত ছিলেন। গ্রন্থের উপশিরোনামেও লেখা ‘রাঢ় বাংলার একটি গ্রামের আত্মকথা’। বইপ্রকাশের অবসরে এই কথনকে যেন সত্যে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বালিজুড়ির বাসিন্দারা। একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকথা যখন নির্মোক ভেঙে প্রচ্ছদপটে গ্রামীণ আত্মকথনের স্বীকৃতি অর্জন করে, তখন তা নাগরিক অলিন্দেও বয়ে আনে টুমনি নদীর ধার ঘেঁষে বয়ে চলা এলোমেলো বসন্ত-বাতাস।