শেষ আপডেট: 13th November 2021 12:22
আলু, বেগুন, গাঁটি কচু, কচি লাল মুলো কাঁসার গামলায় সমান মাপে কেটে জলে ভেজানো আছে। কাঠের আখায় বড় লোহার কড়াইতে ঝাঁঝালো সর্ষের তেলে দু একটা শুকনো লঙ্কা আর পাঁচফোড়ন। বড়ি সামান্য ভেজে আগেই তুলে রাখা হয়েছে। বিউলির ডাল ফেটিয়ে তৈরি সামান্য হিং দেওয়া বড়ি। ডুমো ডুমো। ঝোলে ফুটলেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। আনাজগুলো তেলে অল্প হলুদ দিয়ে সাঁতলে নিয়ে জল ঢেলে বড়িগুলো ছেড়ে কড়াইএর মুখে থালা চাপা দিয়ে দিলেই হল। গুবগুব শব্দ। বাইরে হলুদ ধোয়া জলের মতো রোদ্দুর। অপরাজিতার পাপড়ি ছেঁড়া রং সারা আকাশের গায়ে। দূর মাঠ থেকে ভেসে আসছে রুখু বাতাস। মেটে রান্নাঘরের একফালি জানলার বাইরে ঘন দুপুর।
আঁচলে হাত মুছে মাটির হাঁড়ি থেকে কুনকে করে চাল বের করে রাখছে এক যুবতী। আলগা শ্রী সারা শরীরে। একরাশ চুল হাতখোঁপা করে বাঁধা। উনোনের আঁচে চকচক করছে মুখ। যেন গর্জন তেল মাখিয়েছে কেউ যত্ন করে। পুরনো তেঁতুল রাখা আছে মাটির সরায়। আনাজ সেদ্ধ হলেই তেঁতুল গোলা জল আর কাঁচালংকা দিয়ে ফোটাবে। তারপর ভাত বসাবে। ঝাল ঝাল টক আর ভাত। সব শেষ করে বাসন নিয়ে ঘাটে যাবে। বাসন মেজে চান করে ফিরবে যখন তখন সূয্যি মাঝ আকাশ পেরিয়ে যাবে। বাঁশবনের পাশের সরু রাস্তা ঢেকে দেবে ছায়া। শুকনো বাঁশপাতা তিরতিরে হাওয়ায় উড়ে বেড়াবে আপনমনে। কার্তিকের মাঠে ঝলমলে ধান। আরও দূরে নতুন আলুর খেত। গা হাত পা খসখস করে তোলা বাতাস। দু একটা চিল অনেক উঁচু আকাশের শরীরে ভেসে বেড়ায়।
রান্নাঘর বাইরে মাটির দাওয়া। খড়ের আসনে বসে আছেন এক পুরুষ। অনাবৃত দেহ। কাঁধ অবধি নেমে এসেছে চুলের রাশি। গিরিমাটি ছোপানো ধুতি একফেরতা করে পরা। সামনে নীচু কাঠের জলচৌকি। খাগের কলম, সমান করে কাটা তালপাতা। দোয়াতে কৃষ্ণবর্ণের কালি। মানুষটি লিখছেন মুখ নীচু করে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে সামনে চেয়ে রয়েছেন। হলুদ আভা চোখেমুখে। হঠাৎ গলা তুলে ওই যুবতীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, 'শুনিয়া বলিবে একবার কেমন হইতেছে?'
গলার স্বর শুনে চালের সরা রেখে দাওয়ায় বেরিয়ে আসে যুবতী। সলাজ দৃষ্টি।
মানুষটি তদগত কণ্ঠে বলে ওঠেন, 'যৌবন-বনের পাখি, পিয়াসে মরয়ে গো উহারই পরশরস মাগে!'
কোন সময়ের ওপার থেকে ছুটে আসে রুখু বাতাস। দু একটা শুকনো পাতা। কিছু হলুদ রোদ্দুর। মানুষটি ওই যুবতীর প্রেমিক। যুবতীর নাম সুরবালা। আদর করে তিনি পদ্মাবতী বলে ডাকেন।
তিনি বলেন, তোমার বাড়ির সামনে একটা বকুল গাছ আছে। দেখেছ তুমি কখনও ? যাতায়াতের পথে ? কবেকার পুরনো গাছ। আমার ছোটবেলার ইস্কুলে সিমেন্ট বাঁধানো বকুলতলায় বসে প্রথম পড়েছিলাম অমল আর দইওয়ালার গল্প। তখনও সুধা আসেনি সে-গল্পে। সাদা ধুতি সাদা দাড়িওয়ালা একজন মাস্টারমশাই নরম স্বরে বলে যাচ্ছিলেন দই নেবে ? দই ? তাঁর গায়ে খসে পড়ছে টুপটাপ শুকনো পাতা, বকুল কুসুম।অমলের কী একটা যেন অসুখ করেছে। যে অসুখে মায়া পৃথিবীর টান ফেলে রেখে কাটা যায় কয়ামৎপুরের রেল টিকি ট।
তোমার বাড়ির পিছনে একটা পুকুর আছে। পুকুর ধারে ছোট শিউলি গাছ। জানলা দিয়ে দেখা যায়। জলে খেলা করে ছটফটে মাছ। দু একটা বক আসে তাদের লোভে। নুয়ে পড়া বটের ডালে স্থির বসে থাকে মাছরাঙা। অল্প আকাশ দেখা যায় উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির মাথার ওপর।
তোমার ঘরে রাখা আছে তিব্বতি মুখোশ। সবুজ রঙের গৌতম বুদ্ধ। কয়েকটা কাঠের প্যাঁচা। রঙিন ফুলদানি। অবন ঠাকুরের ছবি। কিছু বই।
আজ আকাশ আকুল করে মেঘ এসেছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো। ভাঙা ছাতা নিয়ে বাসের জানলায় বসে আছি। নোংরা জল কাদা অফিসযাত্রী স্কুলের বাচ্চা এলোচুল তরুণী সিঁদুর পরা গেরস্থ বউ সবাইকে নিয়ে বাস চলেছে আরও বড় কলকাতা শহরের দিকে। নেমে যাব এইবার আমি।
হাঁটতে থাকব এলোমেলো। ফাল্গুন মাসের বৃষ্টিও হাঁটবে আমার সঙ্গে। মেঘ হাঁটবে। বাতাস হাঁটবে। পথে আশ্রম দেখতে পাব একটা। গেরুয়া পরা এক সন্নিসি আমাকে ডাকবেন হাত তুলে। বলবেন, দুপুরের প্রসাদ খেয়ে যেও। বলবেন, পুকুরে সর্ষের তেল মেখে স্নান করো তার আগে। মন্দিরে দুটো হলুদ ফুল রেখো এসো! অবেলায় পথে নেমো না!
আমি চিরকালের কথা না-শোনা লোক। বলব তাঁকে, আমি একটা বাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছি! একটা বাড়ি যার সামনে বকুল গাছ আর পিছনে পুকুর! তিনি হাসবেন অল্প। তাকিয়ে থাকবেন আমার দিকে অপলক!
সে দৃষ্টি পার হয়ে আমি এগিয়ে যাব। ও আমার মালতীমালা, তুমি চেনো কোথায় সেই বাড়ি ? ভৈরবী আমার, চেনো তুমি সেই বাড়ি ?
তিলডাঙার মাঠ পার হয়ে ময়ূরাক্ষীর খেয়াঘাট। তার আগে ধূ ধূ বালি ঢাকা নদীগর্ভ, গরমের দিনে তেতে ফাল হয়ে আছে । ভৈরবীর দৃষ্টি অনুসরণ করে খেয়া ধরতে ওই তপ্ত বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে বসন্ত।
বিকেল ফুরোনোর আগে মাথার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে চখা-চখীর দল। অনেক দূরে একসারি তালগাছ। কয়েকটার গায়ে বাঁধা মাটির হাঁড়ি। বেলা বাড়লেই তালরস গেঁজিয়ে ওঠে, সাদা ফ্যানা জমে, মাথা ঝিমঝিম করে তখন সেই রস খেলে।
নদী পার হয়ে কিশোরগঞ্জে যাবে বসন্ত। বুড়ো সীতাপতি বাবাজির আখড়ায় ক’দিন ঠাঁই মিলবে। সেই কবে ঘর ছেড়েছিল তারপর থেকে যখন যেমন পায় উঞ্ছবৃত্তি করে পেট চালায়। ক্ষুৎকাতর পৃথিবীর বুকে গরম ভাতের মতো মৃত সঞ্জীবনী সুধা আর কিছুই নেই।
ময়ূরাক্ষীর চরে শেষবেলার আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। বালিহাঁসের দল নেমে এসেছে যেন কোথা থেকে। গাঙ শালিখ ওড়াউড়ি করছে পড়ন্ত বেলায়। পাকা তরমুজের ক্ষেতে কার ফেলে দেওয়া পুরনো জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে একাকী কাকতাড়ুয়া। হাঁড়িপানা মুখ।
আর ভালো লাগে না বসন্তর এই জীবন, মনে হয় এই আদিগন্ত চরে যদি দরমা আর তালপাতায় ছাওয়া একখানি গৃহ থাকত, বেশ হতো! তার নিজের ঘর! কাঠের উনানে দিবসের অষ্টমভাগে শাকান্ন প্রস্তুত করতো শ্রীমতী। তার আপনার ভালবাসার ধন শ্রীমতী!
রাত-জোছনায় চিকচিকে রুপোর পাত হয়ে ওঠে বালুচর। দূরে কোথাও টুপটাপ শব্দে ফুটে ওঠে জংলা হাস্নুহানা। উঠোনে বকুল গাছ লাগানোর কথা ভাবে বসন্ত। মাটি ছাড়া কি পূর্ণ হয় বকুল ফুলের শখ ?
নদীর বুক থেকে ছুটে আসে জলবাতাস। দু একটা নৌকো পাল খাটিয়ে কোথায় যেন ভেসে ভেসে চলে যায়।
লোকে বলে নির্জন চরায় কোন উর্দ্ধলোক থেকে নেমে আসেন তখন জোছনার দেবী। ফিনফিনে নরম দেহের ত্বক। কিচ্ছুটি নেই পরনে। গম্ভীর শঙ্খের মতো দুটি চোখ। মোম গলানো এলোচুল। ওই রূপ দেখলেই চোখ জ্বলে অন্ধ হয়ে যায় গাঁ ঘরের মানুষ।
দু হাত জড়ো করে অদেখা দেবীর কাছে ঘর চায় বসন্ত। উঠোন ভরভরন্ত দাওয়া একখানি ফুলেল বকুল বৃক্ষ প্রার্থনা করে। আর ভালো লাগে না এই বৈরেগীর বিবাগী জীবন। শ্রীমতীর হাতের অন্ন আর আঁচলের ঘ্রাণ ভিক্ষা করে জোছনার দেবীর কাছে।
প্রসন্না দেবীও তাই চান। সবকিছুর সঙ্গে দুটি অপরূপ কাঁটাগাছও দান করেন বসন্তকে। অদৃশ্য ওই কাঁটাগাছ বিষের মতো লেগে থাকবে নতুন সংসারে। ভাতের থালায়। শ্রীমতীর শরীরে।
মুখে কাঁটাক্ষতের রক্ত মুছে আবার কোনও বসন্ত হয়তো একদিন হেঁটে যাবে বালুচর ভেদ করে। ঘর পুড়িয়ে সে হাঁটবে আরও দূর কোনও অধরা তৃপ্তির দিকে। অলক্ষ্যে সেদিনও হাসবেন দেবী।
তাই হয় বারবার। আগেও হয়েছে কতবার। আগামী দিনেও হবে।
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : পরবর্তী শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।
https://three.pb.1wp.in/magazine/novel-harer-banshi-part-thirty-seven-by-sayantan-thakur/