শেষ আপডেট: 25th December 2021 12:40
সকাল এগারোটা নাগাদ কেয়াতলায় হৈমবতীর বাড়ির দরজার সামনে একটি মার্সিডিজ এসে থামল। সারা দেশের আর্ট ডিলাররা এই গাড়ির মালিকের সঙ্গে সুপরিচিত। মি. অমর খৈতান, আগামী মাসে বিখ্যাত জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে হৈমবতী রায়ের সত্তরতম জন্মদিন উদযাপন করবেন বলে স্থির করেছেন, সকলকে আমন্ত্রণ জানানোও হয়ে গেছে। বহু বছর পর শ্রীমতী রায়ের নতুন কতগুলি চিত্র দেখবে মানুষ। সারা ভারতবর্ষের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, সমালোচক, আর্ট ডিলার এবং নামী সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। শোনা যাচ্ছে বিদেশের বহু সম্মানিত চিত্র-শিল্পীও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
একতলার ঘরে বসে হৈমবতীর ব্যক্তিগত সচিব কিশোর ভট্টাচার্যকে খৈতান জিজ্ঞাসা করলেন, 'ইজ এভিরিথিং ওকে মি. ভাট?'
--অ্যাবসোলিউটলি। সি ইজ অন হার লাস্ট পেন্টিং!
উৎফুল্ল খৈতান বললেন, 'গ্রেট। এনি আইডিয়া অ্যাবাউট দ্যাট পেন্টিং?'
মৃদু হাসলেন কিশোর, 'ইটস আ হিউজ ওয়ার্ক মি. খৈতান! না দেখলে আপনার বিশ্বাস হবে না। প্রায় দশ ফুট বাই বারো ফুট ক্যানভাস! এই বয়সে কীভাবে ম্যানেজ করছেন এত বড়ো কাজ, গড নোজ! প্রবাবলি হার বেস্ট ওয়ার্ক!'
হৈমবতী রায়ের এই কাজের বাজারদর একবার হিসাব করতেই মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন অমর খৈতান। কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যবসাদারের মতো অচঞ্চল কণ্ঠে বললেন, 'ফাইন, দেন উই ক্যান গো ফর এগ্রিমেন্ট, রাইট?'
--প্লিজ ওয়েট ফর কাপল অব ডেজ! আই স্যাল ইনফর্ম ইউ।
সামান্য বিরক্ত হলেও সহজ গলায় খৈতান বললেন, 'অ্যাজ ইউ উইশ! প্লিজ গিভ মি আ কল, আই স্যাল সেন্ড মাই সেক্রেটারি টু ইউ!'
খৈতান চলে যেতেই দোতলায় উঠে এলেন কিশোর। বামদিকের ঘরটি হৈমবতীর কাজের ঘর, দরজা বন্ধ, কাজ চলার সময় সে-ঘরে ঢোকার অনুমতি কারোও নেই। দরজায় নিঃশব্দে কান পাতলেন কিশোর। ভেতর থেকে হৈমবতীর মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, 'দুটি ফুল, নীল দুটি ফুল, তারা এই জগতের কেউ নয়। ঠিক যেন অমল আর ইরা, দুই শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব-গান্ধর্বী। আমি তাদের মানুষজন্ম মুছে নীল ফুলের রেণুর স্পর্শে তৈরি করব চিত্র-আখ্যান। তোমরাই তো আমার চরিত্র! ইরা ও অমল! রাজা এবং কমলা!'
স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল কিশোরের মুখে। যাক এসেছে, এবার তাহলে নাম ইরা আর অমল!
কয়েকদিন ধরেই ছেলে মেয়েদুটি আসছে হৈমবতীর কাছে। প্রতি ছবির আগেই এমন চরিত্র আসে। শ্রীমতী রায় তাদের সঙ্গেই তখন সারাদিন কথা বলেন, বেড়াতে যান, ভালোবাসেন, গতবার সেই 'দ্য লোটাস' ছবির সময় এসেছিল পল্লীগীতিকার রানি কমলা!
এই গোপন কথা কিশোর ছাড়া আর কেউ তেমন জানেও না। ছবি শেষ হলে কিশোরের কাছে চরিত্রদের গল্প করেন হৈমবতী। শেষ হয় একটি আখ্যান, তারপর আবার অপেক্ষা করেন নতুন মানুষ-মানুষীর।
শেষ আশ্বিনের রৌদ্র ও তিরতিরে বাতাস জগত উঠানে বিছিয়ে দিয়েছে আসন্ন হেমন্তের সুবাস। বারান্দায় অপরাজিতা ফুলের লতায় আজ দুটি ভ্রমর এসেছে। এরাই কি তাহলে অমল ও ইরা?
পীতবসনা আলোর স্রোতে উচ্ছল বারান্দা পার হয়ে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় কিশোর ভাবলেন, এবার কি তাহলে হৈমবতী ছবিটির নাম রাখবেন 'পেটালস অব ব্লু ফ্লাওয়ার'? নাকি ইরা ও অমলের হৃদয়কুসুম দিয়ে তৈরি ছবির নাম হবে, 'নীল ফুলের রেণু'?
কিশোরের কানে আরও কিছু অস্পষ্ট কথা ভেসে এল, সে প্রায় কুড়ি বাইশ বছর আগেকার কথা, আমার দেশের ভিটা থেকে কলিকাতা ফিরতে দিন পশ্চিম আকাশে এলিয়ে পড়ত। ভোরবেলায় উঠে বাস ধরা তারপর একপোয়া পথ হেঁটে রেলগাড়ি। তখন ওদিকে দিনমণির মুখ দেখানোর আগে হিমহিম কুয়াশার আঁচলের তলায় শুয়ে থাকত চরাচর। বাবা প্রতিবার বাসে তুলে দিতে আসতেন, চোখ দুখানি উদ্বেগে ভরা, বাস ছাড়ার আগে নিয়ম মেনে বলতেন সাবধানে যাস।
তারপর কানা ময়ূরাক্ষী পার হয়ে আদিগন্ত হেমন্ত প্রান্তর। গত রাত্রির রিনরিনে শিশিরে ভেজা পথঘাট। কর্ণসুবর্ণের আগে শীর্ণা নদীতীরের মলিন গঞ্জবাজার। ধামা ভরে ফুলকপি, কচি শিষ পালং, নতুন মেটেরঙা আলু নিয়ে বসতেন এক বুড়ো মানুষ। পূজার সুবাস মুছে এখন ভুবনডাঙায় নেমে এসেছে বিষাদঋতু। চারপাশ কেমন যেন শূন্য হয়ে উঠেছে। ঠাকুমা কতগুলি নারকোলের নাড়ু ভরে দিয়েছে কৌটোয়, সে আমি খেতে পারতাম না। ওই সুখাদ্যে ভিটার সুবাস লেগে রয়েছে। বাস ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে সদর শহরের পথে, ওখান থেকেই কলিকাতার রেলগাড়ির দেখা পাওয়া যায়।
রেলগাড়ি থেকে যখন কলিকাতার উপকণ্ঠে নামতাম তখন বেলা ফুরিয়ে গেছে। ইস্টিশানের বাজার গমগম করছে। নেমেই অল্প মুরগির মাংস-গিলা-মেটে, কয়েকটি তাজা টম্যাটো, আমাদের গঙ্গা মাসি বলতো টমটম, এক আঁটি ধনেপাতা, কিছু নতুন আলু, চকচকে পেঁয়াজ আর যুবতি ডাঁটো লঙ্কা কিনে সেই টঙের ঘরের দিকে হাঁটা দিতাম। আর হ্যাঁ ওই কমবয়সী অনুপান হিসাবে সিকি বোতল বুড়ো সন্ন্যাসীও নিতাম বৈকি! আর কালো’দার দোকান থেকে সাদা ময়দার রুমালি রুটি চারটে কি পাঁচটা।
মলিন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর, চান নাই, খাওয়া নাই। পাড়ার মোড়ে টুম্পাদের বাড়ি থেকে হারমোনিয়ামের বেলো টানার শব্দ ভেসে আসছে। ওই যে সেই গান, ঝরা ফুলদলে কে অতিথি! টঙের ঘরে ঢুকে কোনওক্রমে বোঁচকা রেখেই ছুটতাম রান্নাঘরের দিকে। ছাদ পার হয়ে একফালি রসুই ঘর। ঘসঘস পাম্প করে স্টোভ জ্বালাতাম। তার আগে মাংস ধোওয়া, পেঁয়াজ টমটম কুচোনো, আদা রসুন শিলনোড়ায় থেঁতো করা, কাজ কী কম!
এবার লোহার পুরাতন কড়াইয়ে সর্ষের তেল ঢেলে খুব করে ঝাঁজ তুলে পেঁয়াজ লাল করে ভাজা, তারপর মুরগির মাংস আর টম্যাটো আদা-রসুন-লঙ্কা থেঁতো একসঙ্গে ঢেলে অল্প হলুদ লবণ ফেলে মুখে স্টিলের থালা চাপা দেওয়া। এ তো আর পোশাকি মাংস নয়, এর নাম হল চটজলদি-মুরগি। তবে ঝাল হবে কিন্তু হুসহাস, নাহলে ভালো খেলবে না জিভে।
গা ধুয়ে সামান্য অনুপান মুখে দিতে না দিতেই মাংসে কালচে রঙ ধরে যেত। ওদিকে উৎসবান্তের কলিকাতা তখন বিধবার সিঁথির মতোই ম্লান, ছাদের পাশে ছাতিম গাছ কুসুম সুবাসে থইথই। ওপারে জংলা জমি, তারপর সেই আগুন গায়ে দেওয়া মেয়েটির চিলেকোঠা। কেমন যেন কোলাহলহীন এক রাত্রি। মাংস সেদ্ধ হলেই কালচে পোড়া মাংস থালায় ঢেলে, সে আবার এনামেলের থালা, আমাদের দেশে বলত ‘সতের থালা’, রুটি মাংস নিয়ে একছুটে ছাদ পার হয়ে ঘরে। ন্যাংটো সিগারেট মানে চারটাকার হলদে প্যাকেটের চারমিনার, অনুপান, মাংস-রুটি... ঘরের বাইরে ছাদ, আকাশ কেমন ধোঁয়াটে! এবার ঝিমঝিম ঘুম। কোথায় সেই আমার দেশের ভিটা আর কোথায় কলকাতা। দিন শুরুর মুখে একস্থান আর শেষে অন্য কোথাও, এমনই চঞ্চল পদ্মপাতায় জলের মতোই তো অনিত্য এই জীবন!
তারপর স্বপ্ন। একটি গ্রাম্য মেঠো পথ বাঁক নিয়েছ হঠাৎ গহিন অরণ্যের সুঁড়ি পথের দিকে, ওদিকে মহুয়া আর শাল জঙ্গল ভেদ করে কিছুটা এগোলেই সেই মারিয়াদের সমাধিভূমি, বিশাল বিশাল কাঠ খোদাই স্মৃতিফলক, মারিয়া উপজাতির মানুষেরা বলেন উরাসগুট্টা। ওখানেই তার বহু পরে আলাপ হবে বলি ভাতরার সঙ্গে কিন্তু স্বপ্নে সেসব আখ্যান উঠে আসছে হু হু। এই জগতও তো একটি প্রকাণ্ড স্বপ্ন, কাল স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে হয়তো বুঝতে পারব, ওহ! তাহলে এতক্ষণ এসব অলীক বস্তুর মোহে দিন কাটাচ্ছিলাম!
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : পরবর্তী শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।
https://thewall.in/magazine/novel-harer-banshi-part-41-by-sayantan-thakur/