
শাশ্বতী সান্যাল
“আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী! হয়তো সারাজীবন জেলখানায় কাটাব, অথবা হয়তো আমাকে গুলি করা হবে কিংবা ফাঁসি দেওয়া হবে।… তোমাকে হয়তো আর দেখতে পাব না- হয়তো ফিরে গিয়ে আর চিঠিও লিখতে পারব না- কিন্তু বিশ্বাস কর, তুমি সর্বদা বেঁচে থাকবে আমার হৃদয়ে, আমার চিন্তায়, আমার স্বপ্নে’।”…
এই চিঠি লিখেছিলেন একজন প্রেমিক ও বিপ্লবী তাঁর গোপন প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে। হ্যাঁ, সেই বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যদিও আমরা অনেকেই এখনও বিশ্বাস করি না, তিনি কারও প্রেমে পড়েছিলেন অথবা কাউকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। বিশ্বাস করি না তাঁর কোনও স্ত্রী-কন্যার অস্তিত্ব। উল্টো দিক থেকে আমরা কেউ কেউ এখনও বিশ্বাস করি, এই ১২৫ বছর বয়সেও হয়ত তিনি বেঁচে আছেন। সেই রহস্যময় প্লেন দুর্ঘটনা এখনও সমান বিতর্কিত। এখনও তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রে গুমনামি বাবা, শৈলমারী আশ্রমের সন্ন্যাসী হয়ে বেঁচে আছেন আমাদের কল্পনায়। এক আশ্চর্য মানুষ তিনি, তাসের দেশের নিয়মভাঙা রাজপুত্র, যাঁর জন্মদিন আছে, কিন্তু কোনও মৃত্যুদিন নেই।(Netaji)বিপ্লবীদের কি বিয়ে করতে নেই? তাঁদের কি প্রেমে পড়াও বারণ? তাঁরা কি রক্তমাংসের মানুষ নন? তাঁদের কি হৃদয় বলে কিছু নেই? তাঁরা কি নিছক রাজনৈতিক রোবট? পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষের মনে একটা স্বাভাবিক অথচ অদ্ভুত ধারণা ছিল যে, প্রেম-সংসার-বিয়ে-সন্তানসন্ততি এসব আটপৌরে ব্যাপার অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের জন্য নয়। মাস্টারদা সূর্য সেন নামমাত্র বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু একদিনের জন্যেও পুষ্পকুন্তলা দত্তের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন যাপন করেননি। বহু বিপ্লবী আজীবন অবিবাহিত থেকে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে স্বদেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাল্যপ্রেমিকাকে উপেক্ষা করে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সারাজীবনে বিবাহই করবে না:
‘আমি পনেরো বৎসর বয়সের সময় কলিকাতায় পালাইয়া আসি, তখন সুরবালার বয়স আট; এখন আমি আঠারো। পিতার মতে আমার বিবাহের বয়স ক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে। কিন্তু এদিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব–‘
সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও এই জাতীয় একটা ভাবাবেগ পোষণ করত বহু ভারতীয়, বিশেষত বাঙালিরা। অথচ দেশ-বিদেশের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে আমরা দেখব, চিরকুমার বিপ্লবীদের পাশাপাশি বিবাহিত বিপ্লবীদের সংখ্যাও কম নয়। কেউ কেউ একাধিক বিয়েও করেছিলেন, তাতে বিপ্লবের হানি ঘটেনি। কার্ল মার্ক্স বিয়ে করেছিলেন জেনি ফন ভেস্টফালেনকে। তাঁদের বেশ কয়েকটি সন্তানও জন্মেছিল।

লেনিনও বিবাহিত। তাঁর স্ত্রীর নাম নাদেজদা ক্রুপস্কায়া। স্টালিন দুটি বিয়ে করেছিলেন। মাও জে দং চারটে বিয়ে করেন এবং তাঁদের সন্তানসংখ্যা দশ। নাজিম হিকমত, চে গ্যেভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রো তিন জনেই দুবার করে বিয়ে করেছিলেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে আত্মগোপন করে থাকার সময় জাপানি তরুণী তোশিকু সোমাকে অত্যন্ত গোপনে বিয়ে করেছিলেন। সুতরাং বহু অকৃতদার বিপ্লবীর কথা স্মরণে রেখেও বলা যায়, প্রেম কিংবা বিবাহ বিপ্লবীদের বিপ্লবের পথে সবসময় বাধা হিসেবে দেখা দেয় না, অনুপ্রেরণা হিসেবেও দেখা দেয়।১৯৩৪ সালে ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় গিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । অসহযোগ আন্দোলনের সময় কারাবাসের ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপরই চিকিৎসার জন্য তাঁকে ইউরোপে যেতে হয় ইংরেজ সরকারের অনুমতি নিয়ে।
ভিয়েনায় যাবার পর তিনি স্থির করলেন ইউরোপের ভারতীয় ছাত্রদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন।সেই সময় এক প্রকাশকের অনুরোধে তিনি ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ নামে একটা বই লিখতে আরম্ভ করেন। সেই বই লেখার জন্য তিনি একজন ইংরেজিতে দক্ষ টাইপিস্ট খুঁজছিলেন।
বন্ধু ড. মাথুর দুজনের নাম পাঠালেন। তাঁদের মধ্যেই একজন ২৩ বছরের সুন্দরী অস্ট্রিয়ান তরুণী এমিলি শেঙ্কল। দানিউব নদীর দেশে সেদিন শুরু হল এই ভারতীয় বিপ্লবীর জীবনে অন্য এক অধ্যায়। সুভাষচন্দ্র তখন ৩৭ বছরের তরুণ। এমিলির চাইতে ১৪ বছরের বড়ো। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ভারতের স্বাধীনতা। তিনি তখনও ভাবতে পারেননি ভিয়েনায় তাঁর জীবনে এক অপ্রত্যাশিত তুফান সৃষ্টি করতে চলেছে এমিলি শেঙ্কল নামের ওই তরুণী টাইপিস্ট।ঐতিহাসিক সুগত বসু তাঁর ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট- সুভাষ চন্দ্র বসু এন্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন, এমিলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেই সুভাষের জীবনে একটা আকস্মিক পরিবর্তন এসেছিল।
এর আগে শোনা যায়, সুদর্শন ও মেধাবী তরুণ সুভাষের জীবনে কিছু কিছু প্রেম ও বিবাহপ্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সুভাষের তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। অথচ অস্ট্রিয়ার এই চমৎকার রাজধানী-শহরে এসে তাঁর জীবনের হিসেব নিকেশ রাতারাতি বদলে গেল। (Netaji love life)
এমিলির কথা তুলে ধরে সুগত বসু জানিয়েছেন, আগ্রহটা প্রথম এসেছিল সুভাষের দিক থেকেই। ক্রমশ তা রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে।অস্ট্রিয়ার এক ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে এমিলির জন্ম হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি ১৯১০ সালে। বাবা মা চেয়েছিলেন মেয়ে গির্জার সন্ন্যাসিনী হবে। কিন্তু সব হিসেব ওলট-পালট হয়ে গেল এক ভারতীয় বিপ্লবীর অধীনে টাইপিস্টের কাজ করতে এসে।
সুভাষ এবং এমিলি দুজনেই অনুভব করেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কটা আর দশটা সম্পর্কের মতো হবে না। সেখানে নানা বাধাবিঘ্ন আসবে। দেখা দেবে ঝড়-ঝঞ্ঝা। বিভিন্ন চিঠিপত্রে এমিলি সুভাষকে সম্বোধন করতেন ‘মিস্টার বোস’ বলে। আর সুভাষ লিখতেন ‘মিস শেঙ্কল’। উভয়েই নিজেদের সম্পর্ককে যথাসাধ্য গোপন রাখার চেষ্টা করতেন। সহস্র রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও সুভাষ এমিলির সম্পর্কের প্রতি যত্নবান থাকতেন। ৫ মার্চ, ১৯৩৬ সালে লেখা একটি চিঠিতে দেখা যায় তিনি লিখছেন,
“মাই ডার্লিং, কখনও কখনও হিমবাহও গলে যায়। আমার মনের এখন অনেকটা সেইরকমই অবস্থা। আমি যে তোমায় কতটা ভালবাসি সেটা জানাতে এই চিঠিটা লেখা থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। ‘মাই ডার্লিং’, আমাদের নিজেদের মতো করে কি বলতে পারি, যে তুমি আমার হৃদয়ের রানি?”
চমকে উঠলেন? কিন্তু এখানেই শেষ নয়, সুভাষচন্দ্র ওই চিঠিতেই লিখছেন, “যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জন্মে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি।
আমি তোমার অন্তরে থাকা নারীত্বকে ভালবাসি, তোমার আত্মার সঙ্গে আমার প্রেম। তুমিই আমার জীবনে প্রথম প্রেম।”সুভাষচন্দ্র বসু, আমাদের নেতাজি, এমিলি শেঙ্কলের প্রেমে একেবারে মগ্ন তখন। শুরু হয়েছিল গুঞ্জন। ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও কি হয়নি! সুভাষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এ সি এন নাম্বিয়ারের ভাষায় এটা ছিল সুভাষের সাময়িক আদর্শগত বিচ্যুতি।
এর কিছুদিন পর ১৯৩৭-এর এপ্রিল-মার্চ মাসে সুভাষ এমিলিকে লিখছেন: “গত কিছুদিন যাবৎ তোমাকে চিঠি লেখার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আশা করি তুমি বুঝতে পারবে যে তোমাকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা লিখে বোঝানো কঠিন। তোমাকে শুধু এটাই বলতে চাই, আমি আগেও যেরকম ছিলাম এখনও সেরকমই আছি।”
পুরো চিঠিটাই ছিল ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লেখা।
জানা যায়, ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর অত্যন্ত গোপনে সারলেন অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। তাঁদের দুজনেরই পছন্দের রিসর্ট ছিল সেটা। বিদেশিকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ায় আইনগত বাধা ছিল তখন।
সুভাষচন্দ্র আর এমিলির মেয়ে অনিতা বসু তাঁর মায়ের কাছ থেকে যা শুনেছেন, তার ভিত্তিতেই কৃষ্ণা বসুকে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় নববধূর মতো বিয়ের সময়ে এমিলির মাথায় সিঁদুর পরানো হয়েছিল। কোনও পুরোহিত ছিল না। রেজিস্ট্রিও হয়নি।
সম্ভবত সুভাষচন্দ্রও তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এই বিয়ের কোনও প্রভাব পড়ুক, সেটা চান নি।

কৃষ্ণা বসুর লেখা ‘আ ট্রু লাভ স্টোরি – এমিলি এন্ড সুভাষ’ নামের বইটিতে উভয়ের প্রণয়পর্বের বহু অজানা তথ্য রয়েছে।
এমিলিকে সুভাষ আদর করে ‘বাঘিনি’ বলে ডাকতেন। আবার কখনও যথেষ্ট পড়াশোনা না করার জন্য মৃদু তিরস্কারও করতেন। ১৯৩৭ সালের ১২ অগাস্ট একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র এমিলিকে একটু কঠিন ভাষাতেই লিখেছিলেন, “তুমি ভারতের ওপরে কিছু বই আনতে দিয়েছ। তবে আমার মনে হয় না ওইসব বই তোমাকে পড়তে দিয়ে খুব একটা লাভ হবে। তোমার কাছে যেসব বই আছে, তুমি তো সেগুলোই পড়ে ওঠনি।…
তুমি যতদিন না সিরিয়াস হবে, ততদিন পড়ার ব্যাপারে তোমার মন লাগবে না। ভিয়েনাতে তোমার কাছে এখনই কত বই রয়েছে। আমার তো মনে হয় না সেগুলো তুমি উল্টেপাল্টেও দেখেছ কখনও”। অথচ তাঁরা একে অপরকে অসম্ভব ভালবাসতেন।
১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ – এই প্রায় ১১ বছর সময়ের মধ্যে তাঁরা বছর তিনেকেরও কম সময় একত্রে যাপন করতে পেরেছিলেন।
১৯৪২ সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম হয় তাঁদের কন্যা অনিতার। সদ্যোজাত মেয়েকে দেখার জন্য ১৯৪২ এর ডিসেম্বর মাসে ভিয়েনায় পৌঁছোন সুভাষ।
বড়ভাই শরৎচন্দ্রকে বাংলায় লেখা একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র তাঁর স্ত্রী ও কন্যার সম্পর্কে সবকিছু খুলে জানান। এবং তারপরেই শুরু করেন তাঁর রাজনৈতিক মিশন।
৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে সুভাষ বসু জার্মান সাবমেরিনে চড়ে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। সেটাই ছিল নেতাজীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও কন্যার শেষ দেখা। আর কখনও তিনি ফিরে আসেননি। অবশ্য অগ্নিযুগের একজন মহান বিপ্লবীর দাম্পত্যজীবন এরকমই অনিশ্চয়তায় ক্লিষ্ট হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা একটি চিঠিতে এমিলি জানিয়েছিলেন:
“আপনার ভাই ১৯৪১ সালে আরও একবার ইউরোপে আসেন, জানতে চান, আমি বার্লিনে তাঁর কাছে গিয়ে কাজ করতে পারব কি না। আমি রাজি হই এবং ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিই, তারপর আমরা ১৯৪২ সালের হেমন্তকাল পর্যন্ত কাজ করি। বার্লিনে থাকাকালীন আপনার ভাই আমার কাছে জানতে চান, তাঁর বিবাহের প্রস্তাব আমি গ্রহণ করব কি না। যেহেতু আমি তাঁকে বহু বছর ধরে চিনতাম, তাঁকে সচ্চরিত্র বলে জানতাম এবং আমাদের পরস্পরের প্রতি অনুরাগ ছিল, আমি রাজি হই।”
সুভাষ ও এমিলির পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস খুঁড়তে গেলে আমাদের এইসব চিঠিপত্রের উপরেই নির্ভর করতে হয়। অবিশ্বাসীরা সংশয় প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু তাতে সত্য বদলাবে না।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন এমিলি। কখনও ভারতবর্ষে আসেননি। টেলিগ্রাফ অফিসের সামান্য চাকরি করে কন্যা অনিতাকে মানুষ করেছেন। জার্মানির প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ তৈরি করেছেন। সুভাষচন্দ্রের পরিবারের কাছ থেকে একটা টাকাও সাহায্য নেননি।
লেখিকা শূন্য পরবর্তী দশকের পরিচিত কবি। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমির শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্মাননা ছাড়াও আরও একাধিক পুরস্কার।