শেষ আপডেট: 29th August 2023 12:35
"এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।
মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥"
সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া কাজি নজরুল ইসলামের এই গান আজও বাঙালির মুখেমুখে ফেরে। গানটি যতই সকলের প্রিয় হোক, গানের ভ্রাতৃত্ববোধের বার্তাটির (Communal Harmony) প্রতি অবশ্য সুবিচার করেনি বাঙালি? দুই বাংলাতেই হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ আজও আছে। বিশেষত বাংলাদেশে যতই নজরুলকে জাতীয় কবির সম্মান দেওয়া হোক না কেন, সেখানেও বহু মানুষের বিদ্বেষও কুড়িয়েছেন তিনি। অথচ সেই কবেই নজরুল হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ দূর করে সবার উপর মানুষ সত্য বলতে চেয়েছেন। শ্যামাসঙ্গীত লিখে মাতৃ আরাধনা করেছেন।
কাজি পরিবারের কথা বললেই প্রথমে আসে কাজি নজরুল ইসলামের নাম। কিন্তু কাজি পরিবারের সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন আসলে হিন্দু নারীরাই (Kazi Nazrul Islam and 3 Hidu Women)। তিন হিন্দু নারীকেই (Hindu Women) নজরুলের পরিবারের সকল কাব্য সৃষ্টির প্রেরণাদাত্রী বলা যেতে পারে। তিন যুগে তিন নারীর অবদান কাজি পরিবারে কম নয়।
কাজি নজরুল ইসলাম নিজে এবং তাঁর দুই পুত্র কাজি সব্যসাচী ও কাজি অনিরুদ্ধ বিয়ে করেছিলেন হিন্দু নারীদের। বিশেষত নজরুলের হিন্দু বিবাহ নিয়ে তোলপাড় হয় সমাজ। দুই পুত্রবধূর বেলাতেও নজরুল ও তাঁর স্ত্রী যদি তাঁদের পাশে না থাকতেন তবে হিন্দু বিবাহ তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল।
নজরুলের স্ত্রীর আসল নাম আশালতা সেনগুপ্ত। ডাক নাম দোলন বা দুলি। প্রমীলা নামটি তাঁকে নজরুল দিয়েছিলেন। মানিকগঞ্জ জেলার শিবলায় উপজেলার তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আশালতা। পিতার নাম বসন্তকুমার সেনগুপ্ত, মায়ের নাম গিরিবালা সেনগুপ্ত। শৈশবে পিতৃহারা হলে, গিরিবালা তাঁর কন্যা আশালতাকে নিয়ে, তাঁর দেওর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
ঐ সময় নজরুল তাঁর কলকাতায় পরিচিত আলি আকবর খানের সাথে কুমিল্লায় আসেন এবং কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে ওঠেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী ছিলেন বিরজাসুন্দরী। যিনি নজরুলকে পুত্রস্নেহে কাছে টেনে নেন। নজরুলও তাঁকে মায়ের স্থানে বসিয়েছিলেন। এই সময় ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বৌদি গিরিবালা সেনগুপ্ত ও তাঁর কন্যা আশালতা, ইন্দ্রকুমারের আশ্রয়ে ছিলেন। বিরজাসুন্দরীকে নজরুল মা বলে ডাকতেন। পাশাপাশি গিরিবালাকে মাসিমা সম্বোধন করেছিলেন নজরুল। এই সময় আশালতার বয়স ছিল ১৩ বৎসর। তখনই আশালতাকে প্রথম দেখেন নজরুল।
ইতিমধ্যে আলি আকবর খান নজরুলকে নিয়ে তাঁদের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে যান এবং তাঁর ভাগ্নী সৈয়দা খাতুনকে নজরুলের দিকে এগিয়ে দেন। নজরুলের তখন সদ্য যৌবন। সৈয়দার রূপে মুগ্ধ হন নজরুল। নজরুল সৈয়দার নতুন নাম দেন নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের দিন নজরুল জানতে পারেন তাঁকে ঘরজামাই করার উদ্দেশেই এই সকল পরিকল্পনা। বিয়ের পিঁড়ি ত্যাগ করে নজরুল বেরিয়ে আসেন। লোকমতে বলা হয় নার্গিস নজরুলের প্রথম স্ত্রী, প্রমীলা নন। কিন্তু এ তথ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে সুসম্পন্ন হয়নি।
এরপর নজরুল আবার কুমিল্লায় ফিরে আসেন এবং সেনগুপ্তদের বাড়িতেই ওঠেন। সেখানেই নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার প্রণয় বন্ধন গড়ে ওঠে। তাঁদের সম্পর্ক প্রকাশ্যে এলে হিন্দু-মুসলিম (Hindu Muslim) বিয়ে নিয়ে প্রবল ঝামেলা হয়। ধীরে ধীরে ঘটনাটি স্থানীয় মানুষের কাছে একটি প্রাত্যহিক আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে, যা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। তাঁদের বাদ-প্রতিবাদে অচিরেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নজরুল-বিদ্বেষী উঠেছিল। ফলে তাঁর পক্ষে কুমিল্লায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে উঠেছিল।
এরপর নজরুলের জীবনে আসে একের পর এক সংঘাত। সেই সঙ্গে চলত প্রতিবাদী কাব্য লেখা। কিন্তু নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল। জেলে শেষদিকে তিনি শুরু করলেন অনশন। শেষমেষ জেলমুক্ত হওয়ার পরে আবার প্রমীলা ওরফে আশালতার সঙ্গে নজরুলের দেখা। তখন কলকাতার বেনিয়াপুকুরের ৬ নম্বর হাজি লেনের বাড়িতে নজরুলের সঙ্গে আশালতার বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই সময় আশালতার বয়স ছিল ১৬ বছর আর নজরুলের বয়স ছিল ২৩ বছর।
বিয়ের সময় আশালতা ধর্মান্তরিত হননি, তাই ইসলামী রীতিতে এই বিবাহ হয়নি। মূলত একটি বৈবাহিক চুক্তির মাধ্যমে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম দেন প্রমীলা। প্রমীলা শাঁখা-পলা-সিঁদুর পরতেন মুসলমান স্বামীকে বিয়ে করেও। হিন্দু নারীর ভাবাবেগে নজরুল কখনও বাধা দেননি। কিন্তু মুসলিম সমাজে এই নিয়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। নজরুল প্রমীলা ও শাশুড়িকে নিয়ে চলে এলেন হুগলি। হুগলিতেও নজরুলকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে সম্মত হলেন না। শেষে এক বিপ্লবীর সহায়তায় বাড়ি পান নজরুল।
কাজি নজরুলের চার ছেলে ছিল। প্রথম ছেলে কৃষ্ণ মুহম্মদ খুব ছোট বয়সেই মারা যায়। জন্মাষ্টমী তিথিতে জন্ম বলে প্রথম সন্তানের নাম কৃষ্ণ রাখেন নজরুল। এটিও ছিল তাঁর এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে মারা যায়। দ্বিতীয় ছেলে অরিন্দম বা বুলবুল মাত্র চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে মারা যায়। কাজি সব্যসাচী ছিলেন ওঁদের তৃতীয় সন্তান আর কাজি অনিরুদ্ধ কনিষ্ঠ সন্তান।
কাজি সব্যসাচীর কণ্ঠ তো আকাশবাণী থেকে রেকর্ড প্লেয়ারে আজও স্মরণীয়। এই দুই পুত্র কাজি সব্যসাচী ও কাজি অনিরুদ্ধ দু'জনেই পরে হিন্দু নারীকে বিবাহ করেন।
বয়সকালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিশুর মতো হয়ে গেছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি। বসে বসে শুধু কাগজ ছিঁড়তেন। এই সময় নজরুলকে দেখাশোনার জন্য উমা মুখোপাধ্যায় নামে এক নার্সকে আনা হল লেডি ডাফরিনের নার্স
হোস্টেল থেকে। উমা সন্তান স্নেহে কবিকে বুকে টেনে নেন। প্রমীলা দেবীও তখন অসুস্থ।
নির্বাক কবি তখন কলকাতার মানিকতলায় ছিলেন। তাঁকে স্নান করানো, খাওয়ানো, দেখভাল করা, গল্প শোনানো-– উমার হাতের স্পর্শ যেন কবির কাছে মায়ের আঁচলের মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল আর এক কাণ্ড। উমার সেবা দেখে, মিষ্টি ব্যবহার দেখে কবির বড় ছেলে কাজি সব্যসাচী পড়ে গেলেন উমার প্রেমে। উমাও সব্যসাচীকে মন দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভিন্ন ধর্মে অসম ভালবাসা কি সমাজ মেনে নেবে?
উমার বাড়ি থেকে এদিকে পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। সরকারি কর্মচারী এক সুপাত্রকে খুঁজেও ফেলেছেন উমার জামাইবাবু। উমা অনেক সাহস সঞ্চয় করে জানিয়ে দিলেন, “সব্যসাচীকে আমি ভালবাসি। ওকেই বিয়ে করব।” বাড়িতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সকলে এ কথা শুনে। পরিবারের তরফে উমাকে বলা হয়, “মুসলিম বিয়ে করে কোনও দিন যদি দুঃখ পাও, তখন আমরা কিন্তু আর তোমাকে ফেরত নেব না।” উমা বলেছিলেন, “দুঃখ করতে যদি নেমেই থাকি, দুঃখে পড়লেও কাউকে জানাব না।”
বিয়ে হল বামুনের মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের। সে সময়ে একরকম অসম্ভব একটা ব্যাপার। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রেখে উমা মুসলিম পরিবারকে আপন করে নিলেন। হয়ে উঠলেন উমা কাজি। উমা মুসলিম পদবী গ্রহণ করলেও, তাঁর নামে থেকে গেল মা দুর্গার নিশান। উমা নাচে গানে কবিতা লেখায় কখনও প্রচারে আসেননি। তিনি সেবায় সেরা।
অন্যদিকে নজরুলের ছোট ছেলে প্রখ্যাত গিটারবাদক কাজি অনিরুদ্ধ প্রেমে পড়েন আরও এক হিন্দু মেয়েরই। তিনি কল্যাণী। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কল্যাণীর পরিচয় আর পাঁচজন ছেলেমেয়ের মতোই, কবিতার বইয়ের পাতার ঘ্রাণ নিয়ে। যেখানে ‘ভোর হল দোর খোল’ পড়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন। রাঁচি বেড়াতে গিয়ে কবির ছোট ছেলে অনিরুদ্ধর সঙ্গে কল্যাণীর প্রেম থেকে প্রণয়।
ছোট ছেলে যেদিন প্রথম কল্যাণীকে বাবা নজরুলের কাছে নিয়ে গেলেন, সেদিন কল্যাণী কবির অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন। নজরুল প্রথমে মুখ দিয়ে জোরে আওয়াজ করে বিরক্ত হয়ে কাগজ-পেন সরিয়ে দেন। কিছু পরে ছেলের অনুরোধে কাগজে লেখেন ছোট ছেলের নাম। কিন্তু তারপরই বোঝেন, কবির নিজের নাম লিখতে অনুরোধ করা হচ্ছে। তখন জড়িয়ে জড়িয়ে কবি লেখেন কাজি নজরুল। ইসলাম কথাটি আর লিখতে পারেন না। সেই অমূল্য কাগজ কল্যাণী রেখে দিয়েছিলেন চিরটাকাল। পুত্রবধূকে মেনেও নেন নজরুল। কল্যাণী কাজি বলছিলেন প্রমীলা দেবী ও নজরুল ইসলাম না থাকলে তখনকার রক্ষণশীল সমাজে কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হত কিনা সন্দেহ।
১৮ বছর বয়সে নজরুল পুত্রবধূ হয়ে আসেন তিনি। কিন্তু অনিরুদ্ধ বেশি দিন বাঁচেননি। নজরুল থাকতেই মারা যান তাঁর ছোট ছেলে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের বৈধব্য জীবন কাটান কল্যাণী কাজি। কিন্তু নজরুলের গানে তিনি প্রাণ সঁপে দিয়ে এই শোক থেকে উত্তরণ পান। কল্যাণী কাজি নজরুলগীতির সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই বিখ্যাত হন।
সকলেই আজ সুরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। শেষ তারা কল্যাণী কাজিও চলে গেলেন ১২ মে। কিন্তু এই তিন হিন্দু নারীর হাত ধরেই কাজি পরিবার ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কাজি পরিবারে তাঁদের স্বামীরা ব্যস্ততায় বা অসুস্থতার কারণে সংসারটা ঠিক করে করতেই পারেননি। পুরুষদের ভূমিকা সংসারে যেন পালন করেছেন এই নারীরাই। হিন্দু হয়েও মুসলিম পরিবারে বিয়ে তাঁদের কোনওরকম সমস্যা বা দুঃখের কারণ হয়নি। বরং সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের ভালবাসাকে সম্মান দিয়েছেন তাঁরা। পাশে দাঁড়িয়েছেন কাজি নজরুল, কাজি সব্যসাচী ও কাজি অনিরুদ্ধর। তাঁদের ভালবাসার কথা (Communal Harmony) চিরকাল লেখা থাকবে দুই বাংলার আকাশে-বাতাসে।
কবি নজরুলকে আগলে রেখেছিলেন উমা! এই ব্রাহ্মণ-কন্যাই ছিলেন কবির পুত্রবধূ