শেষ আপডেট: 5th February 2024 16:06
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ধরুন আপনি রোজ দুপুরের খাওয়া সারলেন মায়ানমারে গিয়ে, আর ঘুমোতে এলেন ভারতে, তাহলে কেমন হবে?
আরও ধরা যাক, আপনাকে এমন একটা বাড়িতে থাকতে দেওয়া হল যার রান্নাঘার-ডাইনিং রুমটা মায়ানমারে, বেডরুমটা ভারতে।
না কোনও আজগুবি গল্প নয়। এমন আজব গ্রাম আছে ভারতেই। এই গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে তার একদিকটা ভারতে, অন্যদিকটা মায়ানমারে। অর্থাৎ ভারত-মায়ানমারের সীমান্তরেখা একেবারে গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে।
চমকের শেষ এখানেই নয়। এই গ্রামের গ্রামপ্রধানের বাড়িটা এমন জায়গায় যে বাড়ির বুক চিরে চলে গেছে সীমান্ত। ফলে বাড়ির একটা দিক থেকে গেছে ভারতে, অন্যদিকটা মায়ানমারে। দুই দেশেরই নাগরিকত্ব ভোগ করেন গ্রামপ্রধান। এদিক ওদিক যেতে তাঁর কোনও ভিসা লাগে না। গ্রামপ্রধানের বাড়িতে রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া হয় মায়ানমারের দিকে। সেখানেই শষ্য ফলে। ক্ষেত্রের তাজা শাকসব্জি তুলে এনে রাঁধতে বসেন গ্রামপ্রধানের বৌ। মায়ানমারেই হয় রান্না ও খাওয়া দাওয়া। কিন্তু ঘুমোবার ব্যবস্থা মানে বিছানাপত্র সব ভারতের দিকে। সেইদিকটায় পরিবারের সকলে ঘুমোতে আসেন। বৈঠকখানাও সেই দিকেই। গুল্পগুজব, আড্ডাও হয় ভারতে।
সবুজ পাহাড়, দিগন্ত বিস্তৃত গাছপালায় ভরা উপত্যকা, দুধসাদা মেঘ ফেনার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে ইতি উতি। নাগাল্যান্ড বড়ই সুন্দর। ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের জন্য একেবারে স্বপ্নের জায়গা। পাহাড়, কুয়াশা, মেঘের সৌন্দর্য ছাপিয়েও আদিবাসীদের সভ্যতা-সংস্কৃতি নাগাল্যান্ডের মূল আকর্ষণ। এখানেই একটি ছবির মতো সুন্দর জেলা হল মোন। সেখানে আদিবাসী কোনিয়াকরা বসবাস করেন। মোনের একটি গ্রাম হল লংওয়া। এই গ্রামটি বড়ই অদ্ভুত। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে ভারত-মায়ানমারের মধ্যে যে সীমান্ত টানা হয়েছিল তা এই গ্রামের মধ্যে দিয়েই গিয়েছিল।তাই গ্রামের অর্ধেকটা রয়ে গেছে ভারতে, আর বাকিটা মায়ানমারে। লংওয়া গ্রামের লোকজন একই সঙ্গে মায়ানমার ও ভারতে বাস করে। মায়ানমার তাতে কোনও আপত্তি জানায়নি। দুই দেশেই তাদের অবাধ যাতায়াত। অনুমতির দরকারই পড়ে না।
রান্নাবান্না হচ্ছে মায়ানমারের দিকে
লংওয়া গ্রামের কোনিয়াকরা আবার দুর্ধর্ষ মুণ্ডু শিকারি। ব্রিটিশ মিশনারী আর সেনাবাহিনীর চোখ রাঙানিতে মুণ্ডু শিকারের প্রখা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও কোনিয়াকদের ঘরে ঢুঁ মারলে পিতলের খুলির মালা পাওয়া যাবে। কোনিয়াকরা বিশ্বাস করত যুদ্ধে যে গোষ্ঠী জিতবে তারা শত্রুপক্ষের মুণ্ডু কেটে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে রেখে দেবে। মুণ্ডু শিকারের ওই প্রথা ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই একটু একটু বন্ধ করা হয়। তবে পাহাড়ের আড়ালে নরমুণ্ড শিকার এর পরেও হয়েছে কিনা তা জানা নেই। এই নাগাদের সারা গায়ে উল্কি। তারা নিজেদের যোদ্ধা হিসেবেই পরিচয় দেয়। গ্রামবাসীরাই বলেন, মুণ্ডু কেটে নেওয়াটা তাদের জাতির বীরত্বের নিদর্শন। যদিও এমন কাজ আর এখন গ্রামে হয় না। শিক্ষার আলো ঢুকেছে লংওয়া গ্রামে। আইনের কড়া বাঁধুনিতে মুণ্ডু শিকারের প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।
একসময় দুর্ধর্ষ মুণ্ডু শিকারি ছিলেন
হিংসা, সংঘর্ষের জেরে নাগাল্যান্ড এখন রক্তাক্ত। কিন্তু উত্তর-পূর্বের এই ছোট্টো রাজ্যটি আদতে কিন্তু হাসিখুশি, শান্ত, নির্মল এবং চিরসবুজ। প্রকৃতিদেবী যেন সবুজ গালিচা পেতে দিয়েছে গোটা রাজ্যজুড়ে। পাহাড়িয়া এই গ্রামের আদিবাসীরা এখনও সম্প্রীতির নিদর্শন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে যোগসূত্র ধরে রেখেছে এই লংওয়া গ্রাম ও গ্রামের আদিবাসীরাই।