
গা ছমছমে মাউন্ট রোরাইমা, যেন অরণ্যদেবের ‘ওয়াকার টেবিল’
বেলেপাথর দিয়ে তৈরি পাহাড়টির বয়েস প্রায় ২০০ কোটি বছর।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: যাঁরা ‘ফ্যান্টম’ ওরফে ‘বেতাল‘ ওরফে অরণ্যদেব পড়েছেন, তাঁরা জানেন ওয়াকার টেবিলের কথা। অরণ্যদেবের সবচেয়ে পুরোনো ও পছন্দের অজ্ঞাতবাসের স্থান ছিল এই ‘ওয়াকার টেবিল’। ১৪৯৯ সালে, যেটি আবিষ্কার করেছিলেন প্রথম অরণ্যদেব ও তাঁর বন্ধু ক্যারিবো। তবে ইউরোপীয় রাজার দখলমুক্ত করে ওয়াকার টেবিলকে নিজের আয়ত্বে এনেছিলেন, দ্বিতীয় অরণ্যদেব। কমিকসের ‘ওয়াকার টেবিল’ হলো রুক্ষ সমতলভূমিতে থাকা বিচ্ছিন্ন এক খাড়া পাহাড়, যেটির চূড়া সমতল এবং চূড়ার ওপরে আছে একটি গুহা। অজ্ঞাতবাসকালে সেখানেই থাকেন অরণ্যদেব।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সত্যিই কি পৃথিবীতে আছে সেরকম কোনও পাহাড়! উত্তর হল ‘হ্যাঁ’। এরকমই একটি টেবিল টপ মাউন্টেন বা সমতল চূড়ার পর্বত আছে দক্ষিণ আমেরিকায়। যার নাম মাউন্ট রোরাইমা। বেলেপাথর দিয়ে তৈরি পাহাড়টির বয়েস প্রায় ২০০ কোটি বছর।
ভেনেজুয়েলার কানাইমা ন্যাশন্যাল পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, গায়ানা শিল্ডের ওপর অবস্থান করছে অদ্ভুত আকৃতির মাউন্ট রোরাইমা। অরণ্যদেবের স্রষ্টা লি ফক মাউন্ট রোরাইমাকে দেখেই, কমিকসে ওয়াকার টেবিল এনেছিলেন কিনা জানা যায়না। তবে মাউন্ট রোমাইমাকে দেখেই ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ লেখার কথা মনে এসেছিল, স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের।
মাউন্ট রোরাইমার চূড়া, অন্যান্য পর্বতের মত শঙ্কু আকৃতির নয়। টেবিলের মতো সমতল। চূড়ার আয়তন প্রায় ৩১ বর্গ কিলোমিটার। সমতল চূড়া থেকে, চারদিকে নেমে গিয়েছে, খাড়া পাথুরে দেওয়াল। দেওয়ালের উচ্চতা প্রায় ১৩০০ ফুট। স্থানীয় ‘পেমন’ ইন্ডিয়ানরা পর্বতটিকে বলে ‘টেপুই’। যার অর্থ ‘দেবতাদের বাসভূমি’। বছরে বেশিরভাগ সময় মেঘের ওপরে থাকে পর্বতটির চূড়াটি, তাই হয়ত এই নাম দিয়েছে তারা।
১৫৯৫ সালে, এই এলাকাটিতে অভিযান চালানোর সময়, স্যার ওয়াল্টার র্যালের নজরে পড়েছিল এই অদ্ভুত আকৃতির পর্বতটি। তিনিই প্রথম বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন মাউন্ট রোরাইমাকে। ইউরোপীয়রা এই এলাকায় আসার আগে, পর্বতটির ওপরে বাস করত স্থানীয় আদিবাসীরা। শত্রুদের হাত থেকে বাঁচতে মাউন্ট রোরাইমাই ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।
‘মাউন্ট রোরাইমা’ পর্যটকদের কাছে বিখ্যাত, আরও একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য। ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা ও গায়ানা, এই তিনটি দেশের মিলনস্থল হলো ‘মাউন্ট রোরাইমা’। মাউন্ট রোরাইমার ৮৫ শতাংশ অংশ আছে ভেনেজুয়েলার মধ্যে। গায়ানার মধ্যে আছে দশ ও ব্রাজিলের মধ্যে আছে পাঁচ শতাংশ। পর্বতের ওপরে থাকা তিনকোণা একটি পিলার দেখিয়ে দেয়, সমতল চূড়ার কোন দিকটি কোন দেশের দখলে আছে। যেমন এই ছবিটি তোলা হয়েছে ভেনেজুয়েলার দিক থেকে।
মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায় থাকা জঙ্গলে বাস করে বিভিন্ন প্রাণী। তবে কোনও হিংস্র প্রাণি নেই। জঙ্গলে পাওয়া যায় কিছু বিরল উদ্ভিদ। এদের মধ্যে আছে মাংসাশী উদ্ভিদও। মাউন্ট রোরাইমার সমতল চূড়ায় আছে ছোট ছোট কিছু পুকুর। পুকুরে আছে মস ফার্ণ জাতীয় জলজ উদ্ভিদ।
১৮৮৪ সালে, বহিরাগত হিসেবে মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায় প্রথম আরোহণ করেছিলেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী এভরার্ড থুর্ন। মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায় ওঠাটা খুব একটা সহজ নয়। একমাত্র ভেনেজুয়েলার দিক দিয়েই পর্বতটির ওপরে ওঠা সম্ভব। কারণ একমাত্র সেদিকেই, মাউন্ট রোরাইমার গায়ে প্রকৃতির খেয়ালেই তৈরি হয়ে গিয়েছে সিঁড়ির মতো কিছু ধাপ। ট্রেকারেরা সেই পথেই এগিয়ে যান চূড়ার দিকে।
সারাবছর ধরে, বিভিন্ন দেশ থেকে মাউন্ট রোরাইমায় আসেন রক ক্লাইম্বারেরা। তবে তাঁরা চূড়ায় ওঠার জন্য, সর্বসাধারণের পথ মাড়ান না। যে পথে চ্যালেঞ্জ নেই, যে পথে পদে পদে আতঙ্ক নেই, সে পথে যাওয়ার উৎসাহ পান না তাঁরা। তাই তাঁরা খুঁজে নেন নিজেদের পথ। সে পথ বিপজ্জনক, সবার জন্য নয়।
আপনি যদি মাউন্ট রোরাইমা যেতে চান, আপনাকে যেতে হবে ব্রাজিলের ‘রোরাইমা’ স্টেটের রাজধানী বোয়া ভিস্টাতে। সেখান থেকে তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে, যেতে হবে ভেনেজুয়েলার শহর সান্তা এলেনার কাছে থাকা পারাইটেপুই গ্রামে। পারাইটেপুই থেকেই ট্রেকিং রুট গিয়েছে মাউন্ট রোরাইমার চূড়ার দিকে। কোনও নির্দিষ্ট মরসুম নেই, ট্রেক করার জন্য। বছরের যেকোনও সময় যেতে পারেন রহস্যময় মেঘে ঘেরা মাউন্ট রোরাইমা। রোজই প্রায় বৃষ্টি হয়, তবে দেখা দেয় নীল আকাশও। এই জন্যেই অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে মাউন্ট রোরাইমা।
ট্রেকিংয়ের জন্য স্থানীয় গাইড পেয়ে যাবেন পারাইটেপুই গ্রামেই। গাইড হয়ে আপনার সঙ্গে হাঁটবে কোনও ‘পেমন’ আদিবাসী যুবক। আপনাকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে, পৌঁছে দেবে মেঘের রাজ্যে থাকা মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায়। যে পর্বতের চূড়ায় একসময় বাস করতো তাদের পূর্বপূরুষেরা। মাউন্ট রোরাইমার চূড়া থেকে আপনি দেখবেন, মেঘের সাগরে উঠতে থাকা ঢেউ। দেখবেন, চেনা পৃথিবীর অচেনা কিন্তু অবিস্মরণীয় রূপ। যে রূপ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, পৃথিবীর খুব কম লোকেরই।