

মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি (Muthulakshmi Reddy)। একাধারে ডাক্তার, সমাজ সংস্কারক, ভারতের প্রথম মহিলা বিধায়ক, নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ মুথুলক্ষ্মী রেড্ডির জন্মদিনকেই ‘হাসপাতাল দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে তামিলনাড়ু সরকার। ১৯৫৪ সালে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আদিয়ার ক্যানসার ইনস্টিটিউট। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মহিলা সার্জনদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন মুথুলক্ষ্মী । রাজনীতিতেও নজির গড়েছিলেন তিনি।
১৮৮৬ সালে জন্ম মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির পুদুকোত্তাইতে। দক্ষিণে তখন দেবদাসী প্রথার চল। কমবয়সী মেয়েদের দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হতো মন্দিরগুলোতে। পোট্টুকাট্টু প্রথায় দেবতার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে আজীবন মন্দিরের সেবাদাসী করে রাখার নিয়ম চালু করেছিলেন উচ্চবর্ণের পুরোহিতরা। মুথুলক্ষ্মীর মা চন্দ্রাম্মালও ছিলেন দেবদাসী। পরে তাঁকে বিয়ে করেন মহারাজা কলেজের অধ্যক্ষ নারায়ণস্বামী। সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে দেবদাসী চন্দ্রাম্মালকে বিয়ে করার জন্য এই পরিবারকে একঘরে করে রক্ষণশীল সমাজ।
লড়েছেন দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে (Muthulakshmi Reddy)
কিশোরী মুথুলক্ষ্মীকেও (Muthulakshmi Reddy) দেবদাসী বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছিল। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মা চন্দ্রাম্মাল। সমাজের বিষ নজর থেকে মেয়েকে বাঁচানোর জন্য কম বয়সে পাত্রস্থ করার চেষ্টাও করেন তিনি। কিন্তু বেঁকে বসেন মুথুলক্ষ্মী। তাঁর শিরায় তখন শিক্ষা ও সমাজ পাল্টানোর ভাবনা। নিয়ম ভেঙে পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট মহারাজা কলেজেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হলেন। যাবতীয় কটূক্তিকে আড়াল করে ছাতার মতো মেয়েকে আগলে রাখলেন কলেজেরই অধ্যক্ষ বাবা নারায়ণস্বামী।
পড়াশোনায় তুখোড় মুথুলক্ষ্মী (Muthulakshmi Reddy)। অবাক অধ্যাপকরাও। সোনার মেডেল নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯০৭ সালে মুথুলক্ষ্মী ভর্তি হলেন মাদ্রাজ মেডিক্যালে। ১৯১২ সালে ডাক্তারি পাস করলেন। প্র্যাকটিস শুরু করলেন সরকারি হাসপাতালে। ১৯১৪ সালে ডঃ সুন্দর রেড্ডির সঙ্গে চারহাত এক হওয়ার আগেই মহিলা সার্জন হিসেবে নাম করে ফেলেছেন মুথুলক্ষ্মী।
দলিত মহিলাদের সম্মান রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করলেন এই তেজস্বিনী (Muthulakshmi Reddy)
মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত মুথুলক্ষ্মী একদিকে ডাক্তারি অন্যদিকে সমাজ সংস্কারের কাজ করে চলেছেন সমান্তরালে। দলিত মহিলাদের সম্মান রক্ষার জন্য শুরু করলেন লড়াই। সে সময় অভিজাত পরিবারের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়াতেন দলিত মহিলারা। গর্জে উঠলেন মুথুলক্ষ্মী। সেই প্রথা রদ তো হলোই পাশাপাশি নিজের বাড়িতেই দলিত, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, কুমারী মা ও পতিতালয়ের মহিলাদের আশ্রয় দেওয়া শুরু করলেন। তৈরি হলো ‘আভভাই হোম।’
১৯২৬ সালে মাদ্রাজ বিধান পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন দেশের প্রথম মহিলা বিধায়ক (Muthulakshmi Reddy)। ১৯৪৭ সালে আইন করে দেবদাসী প্রথা রদের চেষ্টা করেন তিনি। মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর চেষ্টা করেন ১৬ বছর, আর ছেলেদের ২১ বছর। তা ছাড়াও নারী শিক্ষা, শিশু পাচার, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই অজস্র। স্বাধীনতা পরবর্তী অন্ধকার, পাঁকে ডুবে থাকা সমাজে প্রথম শিক্ষা ও ন্যায়ের আলো জ্বালান তিনিই। সমাজ সংস্কারের গুরুভার নেওয়ার জন্যই ১৯৫৬ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মান দেয় ভারত সরকার।
আরও পড়ুন: Anuradha Koirala: নেপালের মাদার টেরিজা, ১২ হাজার মহিলা-শিশুর পাচার রুখেছেন যে মা
মহিলা বিধায়ক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিটা মুহূর্ত লিখে রেখেছেন ‘মাই এক্সপেরিয়েন্স অ্যাজ আ লেজিসলেটর’ বইয়ে। ক্যানসার গবেষণাতেও কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন তিনি। আদিয়ারে ১৯৫৪ সালে তৈরি করেন ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সেই হাসপাতাল এখন আড়ে বহরে অনেকটাই বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপ্লব হোক বা সমাজ সংস্কার— পথ দেখিয়েছিলেন মুথুলক্ষ্মী। আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে গোটা দেশ।