
মৃত্তিকা মাইতি
মেয়েদের হোম। নাম তার আশ্রয়। এখানে কেউ এসেছে সোনাগাছি থেকে, কেউ পাচারকারীর হাত থেকে উদ্ধার হয়ে, ঠাঁই পেয়েছে আঁস্তাকুঁড়ে ফেলে যাওয়া মেয়েও। দেশ, ধর্ম, জাত, ভাষা আলাদা হলেও এখানে তাদের একটাই পরিচয়। বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত। হোম-মাদারের কাজ পেয়ে এখানেই এসে পড়ে পরমা। তার নিজের জীবনকেও তাড়া করে ফিরেছে দুঃখ আর অপমান। তবু সে মিশে যেতে থাকে হোমের মেয়েদের সঙ্গে। এক একজনের জীবনের কথা তোলপাড় তোলে মনে। সেইসঙ্গে সামনে আসতে থাকে হোমের নানা সমস্যা, চোরা দুর্নীতি, ক্ষোভ ও বিক্ষোভ। পরমা জড়িয়ে পড়ে সমস্ত কিছুর সঙ্গে। এ যেন এক খাঁচা। পাখিঘর। যার ঠিকানা শুধু জানে মুক্তির আকাশ। দ্য ওয়ালের ধারাবাহিক। আজ পর্ব – ২৩।
ধারাবাহিকটি প্রথম থেকে পড়তে নীচের লাইনে ক্লিক করুন
উপন্যাস পাখিঘর পর্ব ১ থেকে পর্ব ২২
কয়েকটা মেয়ের সর্দি-কাশি, জ্বরজ্বর ভাব। জলখাবারের পর সকালবেলা বড়বাড়ির দোতলায় তাদের ওষুধ দিতে গিয়েছিল পরমা। চোখ পড়ল রিমার দিকে। তারও তো শরীর খারাপ বলে মনিটর সোনালির কাছ থেকে শুনেছিল। তবু সে চার-পাঁচজনের সঙ্গে গল্প জমিয়েছে। সেদিন নবনীতা দত্তর সঙ্গে চলে যাওয়ার দু’দিন পর ফিরেছিল রিমা। কেউ তা নিয়ে কোনও কথা তোলেনি।
মুনিয়া আর শাকিলাকে ওষুধ দিয়ে ফেরার মুখে রিমার কাছে গেল পরমা। ওষুধ বাড়িয়ে দেওয়ার পর সে তাকাল পরমার দিকে। ‘তুমি নাকি সেদিন তালা খুলে মেয়েদের বের করে দিতে চেয়েছিলে?’
একটু অবাক হয়ে গেল পরমা। কথা তো হয়েছিল হোম-মাদারদের মধ্যে। তা তো অন্য কোথাও পৌঁছনোর নয়। তাদেরই কেউ বলেছে? সে বলল, ‘তুমি কী করে জানলে?’
‘তোমায় কেন বলব? এখানে কে কী বলে, সব আমার কানে আসে। জায়গামতো পৌঁছে দিলে অনেকের মুশকিল হয়ে যাবে।’
‘সেটা কি ভাল হবে বলে মনে হয় তোমার?’
রিমা সোজাসুজি পরমার চোখে চোখ রাখল। ‘এখানে যারা থাকে তাদের কথা কী জান তোমরা? সবাই তো জানে আমরা খারাপ মেয়ে। খারাপই থাকব। ভালোরা যেন দূরে থাকে।’
‘খারাপ না ভালো তা সহজে বলে দেওয়া যায় না। আমি বিশ্বাসও করি না তাতে। তবে ওই কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ, আমরা তোমাদের জানি না।’
চোখ নামিয়ে রিমা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘অনেকে তোমার কথা বলে। তুমি নাকি মেয়েদের ভালোবাস, তাদের কথা শোনো।’
রিমা হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে ওষুধটা। পরমা বলল, ‘ওটা খেয়ে নাও। জল আছে?’
ওষুধ খেয়ে চিবুকের কাছে লেগে থাকা জল মুছে নিচ্ছিল রিমা। তখন পরমা বলল, ‘আমি শুধুই শুনি। তাদের কষ্ট নিতে পারি না। তবে ভালোবাসি।’
এবার রিমা বলল, ‘বিশ্বাস করো আন্টি, আমরা ইচ্ছে করে খারাপ হইনি।’
পরমা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আমি তো বলি, খারাপ তোমরা হওইনি। মনের ভেতরটা যাদের ভালো থাকে তাদের বাইরে থেকে খারাপ করা যায় না। চারপাশের কিছু মানুষ শুধু তাদের কষ্ট দেয়, ক্ষতি করে।’
এই কথাটায় ঝট করে মাথা তুলল রিমা। রাগে তার চোখের কোনায় যেন রক্তের দানা জমাট বেঁধে গিয়েছে। ‘ওদের মানুষ বলা যায় না। ওরা সব—’
পরমা রিমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করার পর তাকে ঘিরে বসে থাকা মেয়েরা উঠে চলে গিয়েছিল। পরমা বুঝতে পারছিল রিমার ভেতরটা ফেটে পড়তে চাইছে। সে চুপ করে সময় দিচ্ছিল।
‘কাউকে কিছু বলতে আমার ইচ্ছে করে না আন্টি। কী হবে বলে! সেই ছোট্টবেলা থেকে তো চুপ করেই রয়েছি। বুঝে গেছি, আমাদের জন্যে কেউ কোথাও নেই। বাবা মরে যাওয়ার পর মা আমাদের দুই বোনকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিল অন্য একটা লোকের সাথে। আমার তখন তেরো, বোন আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট। রায়দিঘির ওদিকে একটা গ্রামে থাকতাম আমরা। কাকা-জ্যাঠারা কেউ আমাদের দেখেনি। উলটে জায়গাজমি নিয়ে নিয়েছিল। আমাদের লেখাপড়া, ঘরবাড়ি সব ঘুচে গেল। মাকে কোথায় খুঁজব! খুঁজতে ঘেন্নাও করছিল। খবর পেয়ে মাসি এসে নিয়ে গেল আমাদের, থাকত বৈদ্যবাটীতে। ওই একটাই মাসি। সেখানে গিয়ে দেখলাম মেসো একটা রাক্ষস।’
কথা বলতে বলতে শ্বাস টানছিল রিমা। যেন দমবন্ধ হয়ে এলেও বলবে। ‘ওদের ছেলেমেয়ে ছিল না। একটা ঘরে মাসি-মেসো শুত খাটে, নীচে আমি আর বোন। রাতেরবেলা মেসো নেমে আসত। আমার বুকে হাত দিত, খামচে ধরত, ফ্রক তুলে দিতে চাইত ওপরে। বাঁচার জন্যে আমি বোনের গায়ে চিমটি কাটতাম। ও কেঁদে উঠলেই মেসো ধড়মড়িয়ে খাটে উঠে যেত, নয়তো দরজা খুলে বাইরে। মাসিকে কিচ্ছু বলতে পারিনি। পাশে একটা বাড়ি ছিল। সে বাড়ির মেয়েটা আমার খুব বন্ধু। তার দাদাও ছিল একটা। আমার সাথে গল্প করত, পছন্দ করত আমায়। মাঝে মাঝে কথায় এমন অন্তরশিলুনি দিত, গা কেঁপে উঠত আমার। তাকেও মেসোর নোংরামির কথা বলতে পারিনি। যদি আমাকেই খারাপ ভাবে! একদিন ওখান থেকে ফেরার সময় গলির মধ্যে এসে মেসো ধরল আমায়। জামা টেনে ধরে বলল, ওখানে কেন গেছিলি? ওই ছেলেটার সঙ্গে ভালবাসা মারাতে! খুব চুলকুনি হয়েছে না! আমি গাছে সার দেব, জল দেব আর ফল খাবে অন্য লোকে! তা হতে দেব না। খেতে হলে আমি আগে খাব তোকে।’
গা গুলিয়ে উঠল পরমার। সে বলল, ‘এসব তোমায় বলতে হবে না রিমা।’
‘না আন্টি, শোনো। ওখানে আমার এক পিসি একদিন এসেছিল আমাদের দেখতে। নামখানার ওখানে করঞ্জলিতে থাকে। আমি তার হাতে-পায়ে ধরে বোনকে পাঠিয়ে দিলাম পিসির সাথে। তারপরেই মেসো মাসিকে বলল, কলকাতায় কোন বাড়িতে খাওয়াপরার কাজ দেখেছে আমার জন্য। নিয়ে যাবে সেখানে। মাসি কিছু বলেনি। আমিও ভেবেছিলাম বেঁচে গেলাম। আসলে মরেছিলাম। সব মনে আছে আমার। মেসো আমায় বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটা বাড়িতে নিয়ে গেছিল। সেখানে একটা ঘরে বসিয়ে রাখল অনেকক্ষণ। দুটো লোক এসে আমায় দেখে গেল। তারা চলে যাবার পর মেসো এসে আমায় বলল, তোকে বেচে দেব আজকে। তারপর আমায় একটা টাটা সুমোয় চড়িয়ে নিয়ে গেল সেই দুটো লোক। তোলার সময় বলল, যদি চেঁচাস তাহলে রেপ করিয়ে দেব তোকে, তোর সব কিছু নষ্ট করে দেব। ভয়ে আমি মরে গেছিলাম কিন্তু একটুকু আওয়াজও বেরোয়নি গলা দিয়ে। ওরা যেখানে নিয়ে গেছিল, সেখানে আমায় নষ্টই তো করে দিল তারপর। সেই যে ছেলেটা, তাকে আমি আর কোনওদিন দেখতে পাব না।’
মাথা নামিয়ে নিয়েছিল রিমা। পরমা খানিকটা এগিয়ে বসল তার কাছে। বলল, ‘না, নষ্ট হওনি। আমার দিকে তাকাও। তুমি কেমন থাকবে তা তুমিই ঠিক করতে পারো।’
মাথা নাড়ল রিমা। ‘পারি না আন্টি। আমার মনে হয় নষ্টই যখন হলাম, তখন আরও হয়ে যাই। সুখ আমি আর কীসে পাব!’
‘তুমি যা ভাবছ তা যে সুখ নয় সে তো তুমি জান।’
‘কী করব আমি? এখান থেকে যখন বাইরে যাই তখন কারও না কারও কথা তো মেনে নিয়েই যাই।’
পরমা খানিক চুপ করে ভাবছিল। তারপর বলল, ‘তুমি কোথায় যাও, কেন যাও, জানতে চাই না আমি। কিন্তু বলব, যেয়ো না, মেনে নিয়ো না। তুমি চাইলেই তা আটকাতে পার। তুমি যদি জোর দেখাও তাহলে কেউ কিছু করতে পারবে না। ভেবে দেখো আমার কথাটা।’
রিমার মুখ ম্লান হয়ে আছে এখনও। ‘পারব কি?’
‘তুমিই পারবে।’
‘তাহলে আমায় এখান থেকে পালিয়ে যেতে হয় আন্টি।’
তার এই কথাটার পিঠে কোনও কথা বলতে পারল না পরমা। রিমাও মুখ নামিয়েই বসে ছিল। তবে পরমা উঠে দাঁড়াতেই সে বলল, ‘তুমি খুব ভাল আন্টি।’
সামান্য হাসল পরমা। ‘কীসে বুঝলে?’
‘বুঝেছি। ঠিকই বুঝেছি।’
পরমা বলল, ‘তুমিও ভাল। তোমরা সবাই ভাল।’
রিমাকে রেখে ঘর ছেড়ে প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল পরমা। এই সময় মনিটর কবিতা এসে ঢুকল সেখানে। হয়তো একতলায় গিয়েছিল। পরমাকে দেখেই সে বলল, ‘আন্টি, তুমি কি ওষুধ দিতে এসেছিলে? পিঙ্কির যে শরীর খারাপ, ওকে দিয়েছ?
‘না, কিছু বলল না তো রে।’
‘বলেনি? কিন্তু একটা কিছু দাও। ক’দিন ধরে ওর বমি বমি করছে। আজ টিফিন খেতে পারেনি। কিছুই নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আগে বলেনি কেন? ডাক্তারের সঙ্গে কথা না বলে কী ওষুধ দেব?’
পিঙ্কি শুয়ে ছিল। পরমা গিয়ে তাকে বলল, ‘কী হয়েছে? খাচ্ছিস না কেন? আজ ডাক্তার এলে বলতে হবে তো।’
কোনও উত্তর নেই। কবিতা হাত ওলটাল। পিঙ্কির ওপরের বাঙ্কে থাকে জুহি। সে এখন কোমরে হাত রেখে পাশে দাঁড়িয়ে। পরমা বলল, ‘আচ্ছা, আমি দেখছি।’
বেরিয়ে আসছিল সে। এই সময় জুহি এসে বারান্দায় ধরল তাকে। বলল, ‘উসকি কেয়া হুয়া আমি জানি।’
পরমার ভুরু জুড়ে গেল। ‘কী হয়েছে ওর?’
‘উও তো পেটসে হ্যায়। ওই জন্যে তো বারবার উলটি করছে।’
একটু আগেই রিমার কাছ থেকে শোনা সব কথা এখনও ফুসফুসের ফাঁকফোকর খুঁজে বেরোতে পারেনি। তার মধ্যে এই কথাটা শুনেও গোড়ায় ঠিক বুঝেই উঠতে পারল না পরমা। ‘কী বললি তুই?’
‘আমি বলছি ইয়ে উলটি অ্যাইসি-ব্যাইসি নেহি। মুঝে পতা হ্যায় কি উও পেটসে হ্যায়।’
কথাটা তাও পরমার মাথায় বসছিল না। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। সে আবার ফিরে গেল হলঘরটায়। পিঙ্কিকে টেনে বিছানায় বসাল। তখনই খেয়াল করল, ঘরের আরও কয়েকজন মেয়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘এই পিঙ্কি, কী বলছে জুহি?’
পিঙ্কি তাতেও চুপ। মুহূর্তের মধ্যে ঘরের হাওয়া যেন বদলে গেল। পাশ থেকে একটা মেয়ে বলল, ‘কয়েক ঘা বসিয়ে দাও না। তাহলেই সত্যি কথা বেরিয়ে পড়বে।’
ভয় এসে পরমার হাত-পায়ে ঝিম ধরিয়ে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে দানা বাঁধছে প্রশ্ন। হোমের ভেতরে থেকে একটা মেয়ের কী করে এরকম হতে পারে? কার সঙ্গে ঘটতে পারে? কেউ জানতে পারল না? সত্যি হলে এরপর কী হবে তাহলে?
ছন্দা নামের আরও একটা মেয়ে এগিয়ে এল। সে এদের চেয়ে বয়সে অনেকটা বড়। দাঁত চেপে বলল, ‘কার সাথে শুয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিস বল?’
মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল পিঙ্কি।
সেই দেখে আরও রেগে গেল কয়েকটা মেয়ে। একজন বলল, ‘এখন ন্যাকাকান্না হচ্ছে? শোয়ার সময় মনে ছিল না! তখন বোঝনি পরে কী হবে?’
এবার পরমা ধমকে উঠল। ‘থাম তোরা। এরকমভাবে কথা বলিস না।’ তারপর কবিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘অর্পিতা আন্টি কোথায় বল তো?’
‘তিনতলায়। প্রীতি আন্টিও ওখানেই।’
‘যা, এক্ষুনি ডেকে নিয়ে আয়।’
পরমা বসে পড়েছে পিঙ্কির পাশে। তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সে। ‘কী করে হল রে এসব? লোকটা কে বল। না বললে তো ভীষণ বিপদ।’
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘হরিপদদা।’
নামটা শুনে চমকে উঠেও পরমা বলল, ‘আমাদের বাস ড্রাইভার!’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাল পিঙ্কি।
একটা মেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘এই কারণেই ছাড়া পেয়ে বাসে গিয়ে ঢুকতিস? খুব ভালো লাগত, না!’
পরমার কথা বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ভাবনাচিন্তা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তবু নিজেকে শান্ত রেখে জানতে চাইল, ‘কতদিন হল মাসিক বন্ধ হয়েছে?’
পিঙ্কি কিছু বলার আগেই জবাব দিল জুহি। ‘তিন মাহিনা।’
আর এক মনিটর দোলা চড় তুলেছে জুহির দিকে। ‘তুই বলিসনি কেন এতদিন? মুখ বুজে আছিস!’
‘আমি জানতাম থোড়ি। দো-দিন হুয়া বলেছে ওর মাসিক হচ্ছে না। তব না জানলাম।’
সঞ্চিতার কাছে স্টোররুমের চাবি থাকে। পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন নিতে হলে তার কাছেই যেতে হয় মেয়েদের। পিঙ্কি কি তা নেয়নি তিন মাস ধরে? তাহলে তো সঞ্চিতার খেয়াল পড়ত। না কি ব্যাপারটা চেপে রাখতে গিয়ে পিঙ্কি নিয়ম করে তার প্যাড নিয়ে যাচ্ছিল? মেয়েটাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই। ছুটি নিয়ে সঞ্চিতা বাড়িতে গিয়েছে। সে না এলে জানা যাবে না কিছু। অবশ্য এখন আর জেনেই বা কী হবে।
অর্পিতা নেমে এসেছে তিনতলা থেকে। তার সঙ্গে প্রীতি আর তিনতলার মনিটর সোনালিও। ফ্যাকাশে মুখে অর্পিতা বলল, ‘কী রে, কী শুনলাম আমি!’
উঠে দাঁড়াল পরমা। ‘স্কুলবাসের ভেতরে ওদের বেশ কয়েকবার দেখেছে মেয়েরা। আমি নিজে গিয়ে পিঙ্কিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছি। সর্বাণীদিকেও জানিয়েছিলাম। তখন আমার কথা শোনেননি উনি।’
প্রীতি বলল, ‘ও গিয়েছিল কেন? দোষ তো ওর। আমিও তো দেখেছি বাসে গিয়ে ঢুকতে। তখন তো বলত গল্প করছিল। এই গল্প!’
‘ঠিক আছে, মানলাম দোষ পিঙ্কিরও আছে। তাই বলে ওই লোকটাকে তো ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সে তো আজও ভালোমানুষের মতো মেয়েদের নিয়ে স্কুলে গেছে।’
মেয়েদের একজন বলে উঠল, ‘আগে জানলে তখনই ধরা যেত।’
অর্পিতা কী যেন ভাবছিল। বলল, ‘ভালোই হয়েছে তখন হইচই হয়নি। আমরা যদি সামলাতে না পারতাম? যখন ফিরবে, সর্বাণীদিরা থাকবেন। তারাই ঠিক করবেন কী করা হবে।’
ফুঁসে উঠল পরমা। ‘কী করা হবে মানে? ওকে সোজা পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে।’
অর্পিতা মেয়েদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ‘এই নিয়ে এখন আর কোনও কথা নয়। তোরা সবাই শান্ত থাক। সর্বাণীদিকে আসতে দে।’
পরমা কবিতার কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তুই পিঙ্কির কাছেই থাকিস। খেয়াল রাখবি।’
হোম-মাদাররা বেরিয়ে এল বড়বাড়ি থেকে। নীচে এসেই প্রীতি বলল, ‘এ তো মারাত্মক ব্যাপার অর্পিতাদি!’
অর্পিতা তাকাল তার দিকে। ‘তুই ছোটবাড়ি থেকে উর্মিলাকে ডেকে নিয়ে আয় তো। ওকেও জানিয়ে রাখা দরকার। আমাদের সবাইকেই ডাকবে অফিসে।’
প্রীতি চলে যাচ্ছিল। মেয়েদের শান্ত থাকতে বললেও সে নিজে যে ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে তা বোঝা গেল অর্পিতার কথায়। ‘কী যে হয়ে চলেছে! এটা যা ঘটল সেরকম কোনওদিনও হয়নি। নিজেকে একটু সামলাতে পারল না মেয়েটা!’
পরমা বলল, ‘হোমের ভেতরে থেকেও তো মেয়েরা তাহলে নিরাপদ নয় অর্পিতাদি।’
প্রীতির সঙ্গে হনহন করে হেঁটে এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল উর্মিলা। মুখে রাগ আর ভয় একসঙ্গে জড়ো হয়েছে। ‘লোকটার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। একে তো এরকম করল, তারপরেও আসা-যাওয়া চালিয়ে যাচ্ছে! সেদিন আবার দিব্যি ডাব পাড়ল! জানাজানি হলে কী হবে ভাবেনি? মেয়েটাকে কথা বলতে দেখে ভাবতাম সমস্ত সময় বন্ধ থাকে, বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলে যদি আনন্দ পায় তো পাক। আধবুড়ো একটা লোক, কী আর হবে! তাই বলে মেয়েটাও এরকম একটা কাজ করবে! মাগো, ভাবতেই পারছি না।’
পরমা বুঝতে পারছিল, সে একা নয়, অর্পিতা ছাড়া সকলেই দেখেছিল ব্যাপারটা। সে-ই শুধু গিয়ে সর্বাণীদিকে জানিয়েছিল।
সর্বাণী মিত্র এলেন দশটায়। ডাকার অপেক্ষায় না থেকে হোম-মাদাররা প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই চলে গেল তার কাছে। শোনার পর অস্থির দেখাচ্ছিল সর্বাণীকে। অফিসের আর কেউ এখনও এসে পৌঁছয়নি। তিনি সটান দাঁড়িয়ে পড়ে অর্পিতাকে বললেন, ‘শংকরকে ডাকো। এক্ষুনি আসতে বলবে। তার সঙ্গে আমার কথা আছে। আর হরিপদকে মেয়েদের নিয়ে ফিরে আসতে দাও, তারপর দেখছি।’
সর্বাণীর কথা শুনে তখনকার মতো চলে এল ওরা। তবে দমবন্ধ করে রইল স্কুলবাস আসার অপেক্ষায়।
পরের পর্ব আগামী শুক্রবার
এই উপন্যাসের যে কোনও চরিত্র এবং যে কোনও ঘটনার সঙ্গে বাস্তবের কোনও চরিত্র এবং কোনও ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত, আকস্মিক ও কাকতালীয় বলে গণ্য করতে হবে।
অলঙ্করণ – দেবাশিস সাহা
মৃত্তিকা মাইতির জন্ম ১৯৮৯ সালে, পূর্ব মেদিনীপুরে। পারিবারিক পরিস্থিতি সুস্থির না থাকায় প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরে নিজের চেষ্টায় যা শিখেছেন তাতে তাঁকে স্বশিক্ষিত বলা যায়। তাঁত বোনা থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি পর্যন্ত সবই করেছেন জীবনের প্রয়োজনে। বর্তমানে একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। লেখালেখিতে নবীন। কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে।