
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর গানকে স্বরলিপি দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কণ্ঠের রেঞ্জ সাংঘাতিক। গানে অনুভূতি প্রকাশ করার সময়ে যখন এক নোট থেকে আর এক নোটে যেতেন, মনে হত তাঁর কণ্ঠই যেন ভেসে চলে যাচ্ছে। তিনি মহম্মদ রফি। তিনি মধুঢালা বহুমুখী কণ্ঠ। পেপি আইটেম নাচের গান থেকে দেশাত্মবোধক গান, বিরহ থেকে চুড়ান্ত রোম্যান্টিক গান, সুফি কাওয়ালি থেকে ভজন ভক্তিমূলক– সব সঙ্গীতের ঘরানায় অবাধ বিচরণ রফির। আবার বাংলা ভাষায় আধুনিক গানও গেয়েছেন।
‘তোমার নীল দোপাটি চোখ,
শ্বেত দোপাটি হাসি,
আর খোঁপাটিতে লাল দোপাটি দেখতে ভালবাসি।’
এছাড়াও আছে ‘পাখিটার বুকে যেন তির মেরো না, ওকে গাইতে দাও।’, ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’, ‘গুলমোহরের ফুল ধরে যায়’, ‘ওই দূর দিগন্ত পাড়ে।’
ভাঙা বাংলা উচ্চারণ তাঁর, কিন্তু ওই মিষ্টি কণ্ঠের জাদুতে আজও তাঁর গানে মুগ্ধ বাঙালিরা। এই মহম্মদ রফি, দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, শাম্মি কাপুর, রাজেশ খান্নাদের লিপে বিখ্যাত সুপারহিট প্লেব্যাক লেজেন্ড হওয়ার পাশাপাশি বাংলা ছবিতেও গান গেয়েছেন, খোদ উত্তম–সুচিত্রার ছবিতে। আজ রইল সে গল্প।
এ গানের বিশেষত্ব হল, বাংলা ছবিতে হিন্দি গানের অদ্ভুত সুন্দর ব্যবহার। গানটি যে বলিউড গান, তা নয় মোটেও। বাংলা ছবির জন্যই নির্মিত হিন্দি গান।
বম্বেতে রেকর্ডিং হচ্ছে সেই বাংলা ছবির গান। কারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্তকে সঙ্গে নিয়ে ডুয়েট গাইবেন ‘সূর্য ডোবার পালা’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’। দুটো উত্তম–সুচিত্রা লিপে সেই চির-রোম্যান্টিক গান। আরও চমকপ্রদ, এই বাংলা গানের অ্যারেঞ্জার ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল। গানটা এত হিট, এত ভাল, তার কারণ ভাল রেকর্ডিংও। এমন সুন্দর ভাবে হেমন্ত-গীতার গলা আগে বাজেনি রেকর্ডিং-এ। সেদিন রেকর্ডিং স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন রাজ কাপুরও।
‘ইন্দ্রাণী’ ছবির পরিচালক ছিলেন নীরেন লাহিড়ী। সুরকার নচিকেতা ঘোষ। নচিকেতা ঘোষ বলে বসলেন ‘‘এই ছবিতে আমি একটা হিন্দি গান রাখব। আর সেটা গাওয়াব মহম্মদ রফিকে দিয়ে।’’ কিন্তু এ কী যে সে আবদার! বাংলা ছবিতে মহম্মদ রফি গাইবেন? রাজি হবেন আদৌ? কে রাজি করাবে? কত পারিশ্রমিক চাইবেন? অকল্পনীয় ভাবনা। পরিচালক প্রযোজকদের মাথায় হাত। এ কী আদৌ সম্ভব!
শেষ অবধি হাল ধরলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যিনি টালিগঞ্জ তথা বলি পাড়াতেও বড় বাঙালি নাম তখন। হেমন্ত বাবু নচিকেতা ঘোষকে নিয়ে গেলেন মহম্মদ রফির বাড়ি। সাদর আমন্ত্রণ জানালেন রফি। রফি শুনতে চাইলেন ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির গান।
‘সবি কুছ লুটাকার হুয়ে হাম তুমহারে’— গান শুনে মহম্মদ রফি তো প্রায় পাগল হয়ে গেলেন, ‘‘কেয়া ধুন বানায়া আপনে! ইতনা মিঠা…!’’ আসল কথা পাড়লেন এবার নচিকেতা ঘোষ। এটা বাংলা ছবি। প্রযোজক আপনাকে পাঁচশো টাকা অবধি দিতে পারবে গান গাইবার জন্য। ‘‘পাঁচশো টাকায় রেকর্ডিং!’’ চমকে উঠলেন রফি। রফির আঁতকে ওঠা দেখে নচিকেতা ঘোষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উঠে পড়লেন।
এর পর কী যে মনে হয়েছিল রফি সাবের! দরজার দিকে চলে যাচ্ছেন ওঁরা, এমন সময় পিছু ডাকলেন রফি সাব। বললেন, ‘‘ছাড়ুন, ছাড়ুন। ও সব কথা ছাড়ুন। আপনার জন্য এ গানটা আমি বিনা পয়সায় গেয়ে দেব।’’ এই হলেন রফি। ভাল সুরের গানের জন্য গানটাই আসল। পরে পারিশ্রমিক। রচিত হল সেই ক্লাসিক লাভ সং, ‘সবি কুছ লুটাকার হুয়ে হাম তুমহারে’। সুচিত্রা উত্তমের ফুলসজ্জায় এই গান ব্যবহার হল ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে। যেমনি নায়ক-নায়িকার অভিনয় তেমনি রফি সাবের কণ্ঠ, সেরকম সুর ও কথা।
বাংলা ছবিতে মহম্মদ রফির অমর অশেষ গান হয়ে রয়ে গেল।
বাঙালিদের মধ্যে ‘ইন্দ্রাণী’র এই গানটার তখনও দারুণ ক্রেজ ছিল, কারন রফি বাংলা ছবিতে গান গেয়েছেন। ‘ইন্দ্রাণী’র সব গান হিট, কিন্তু এ গানটা আলাদা বিশেষত্ব রাখে। গানের কথা লিখেছিলেন যশস্বী হিন্দি গীতিকার শৈলেন্দ্র। এক পথচলতি আগন্তুকের লিপে এ গান সুচিত্রা-উত্তমের প্রেমদৃশ্যকে কালজয়ী করে তোলে।