

কিন্তু এর কারণ কী? কেনই বা এই এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে এমন জাঁকিয়ে বসেছে ম্যালেরিয়া (Malaria)?
এই উত্তর খুঁজতেই সুদীর্ঘ এক গবেষণায় সামিল হয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী ডক্টর ঈপ্সিতা পালভৌমিক। ডিব্রুগড়ের রিজিওনাল মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের (আরএমআরসি) এই গবেষক এসেছিলেন কলকাতার আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান উৎসবের মঞ্চে। সেখানেই হেল্থ কনক্লেভের আসরে জানিয়েছেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের ম্যালেরিয়া (Malaria) রোগের আশঙ্কাজনক অবস্থার কথা। পেশ করেছেন সে বিষয়ে তাঁর গবেষণার বেশ কিছু তথ্য, যাতে রীতিমতো চমকে উঠতে হয় পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া (Malaria) দূরীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই উদ্দেশে সারা দেশ জুড়ে রাজ্যভিত্তিক একাধিক পরিকল্পনাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঈপ্সিতা বলছেন, “ম্যালেরিয়া (Malaria) একটি ‘লোকাল’ এবং ‘ফোকাল’ অসুখ। স্থানবিশেষে এই অসুখের বিস্তার এবং তীব্রতা দুই-ই আলাদা। তাই একইরকম ভাবে রাজ্যভিত্তিক ম্যালেরিয়ার (Malaria) চিকিৎসার চেয়েও বেশি জরুরি, নির্দিষ্ট এলাকায় ম্যালেরিয়া কেন হয় তার কারণ খোঁজা, তার ধরন বোঝা। তার পরে সেই অনুযায়ী প্রতিরোধী কর্মসূচি সাজানো হলে এই লড়াই আরও সহজ হবে।”
সরকারি তথ্য বলছে, সারা দেশে ম্যালেরিয়া (Malaria) অসুখে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা যান, তাঁদের মধ্যে ২৫ শতাংশই এই উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ। ঈপ্সিতা পালভৌমিক গবেষণার খাতিরে খুঁজে বার করেছেন গত ৩০ বছরের পরিসংখ্যান। তা থেকে তিনি জানালেন, ৩০ বছর ধরে সামগ্রিক ভাবে এই রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে উত্তর-পূর্বে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই বৃদ্ধি কেবল আদিবাসী মানুষগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যাঁরা আদিবাসী নন, তাঁদের মধ্যে কিন্তু ম্যালেরিয়ায় (Malaria) আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমেছে। শেষ দু’বছরের পরিসংখ্যানে এই বিভেদ আরও বেশি স্পষ্ট হয়। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত।
শুধু তাই নয়। ঈপ্সিতার তিন বছরের গবেষণা বলছে, এই বিস্তীর্ণ এলাকায় ম্যালেরিয়া (Malaria) রোগের কারণ কিন্তু সুপরিচিত অ্যানোফিলিস মশা নয়। বাইমাই ও মিনিমাস নামের দুই অন্য প্রজাতির মশার আধিক্যই উত্তর-পূর্বের ম্যালেরিয়ার মূল কারণ। বাইমাই মশার বিশেষত্ব হল, এই মশা রাতের অন্ধকারে নয়, ঘুমোনোর আগে সন্ধেবেলা এবং ঘুম থেকে ওঠার পরে ভোরবেলায় কামড়ায়। আধো অন্ধকারে। ফলে ঘুমোনোর সময়ে মশারি ব্যবহার করার দাওয়াই দিয়ে এই মশা আটকানো যায় না। আবার মিনিমাস মশার সমস্ত আচরণই অ্যানোফিলিসের থেকে আলাদা। মশা মারার সাধারণ স্প্রে বা ধূপ তাদের ক্ষেত্রে এতটুকু কার্যকর হয় না।
এই দুই মশার ধরনও উত্তর-পূর্বের সাধারণ আদিবাসী মানুষের আক্রান্ত হওয়ার একটা কারণ। কারণ তাঁদের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কৃষিকাজ। এবং এই কৃষির অন্যতম একটি ধরন হল, ঝুমচাষ। জনবসতি ছেড়ে পাহাড়ের অনেকটা ওপরে কোনও প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে গিয়ে, বনভূমি পুড়িয়ে সেখানে ফসল চাষ করা হয় বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে। ঈপ্সিতার গবেষণা বলছে, এই ঝুমচাষিদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার (Malaria) প্রকোপ অত্যন্ত বেশি।
এর কারণ স্পষ্ট হয়ে যায় একটু খোঁজ নিলেই। সপ্তাহের নির্দিষ্ট এক দিন বা দু’দিন তাঁরা প্রত্যন্ত চাষ-এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামে বা লোকালয়ে নেমে আসেন হাট-বাজার করতে। সেই নির্দিষ্ট দিনগুলোয় ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘর থেকে বেরোন তাঁরা, আবার কাজ মিটিয়ে ফিরে যান সন্ধের মুখে। স্বাভাবিক ভাবেই, বেশির ভাগ সময়েই তাঁদের যাত্রাপথ ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে থাকে। আর সকাল-সন্ধে বাইমাই মশার কামড় খান তাঁরা। অবধারিত ভাবে আক্রান্ত হন ম্যালেরিয়ায় (Malaria)।
বিভিন্ন এলাকায় এই ঝুমচাষিদের গতিবিধি বুঝে, তাঁদের হাটে আসার দিনক্ষণ মেপে, মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজনও করে আরএমআরসি। বিলি করা হয় মশা নিরোধক ক্রিম। কোন এলাকায় বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় (Malaria) আক্রান্ত হচ্ছেন, ইসরো নর্থ ইস্ট সেন্টারের সহায়তায় তার একটা স্যাটেলাইট ম্যাপিংও করেছেন ঈপ্সিতারা। সেই ম্যাপিং থেকেই স্পষ্ট, জঙ্গল এলাকায় যেখানে মানুষের বসতি, সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। আবার যেসব বসতি জঙ্গল থেকে খানিকটা দূরে, সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপও কম।
ঈপ্সিতা জানালেন, সচেতনতার অভাবে অনেক সময়েই সঠিক চিকিৎসা হয় না প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের। এ কারণে একটি বিশেষ অ্যাপও তৈরি করা হয়েছে ইসরো নর্থ ইস্ট সেন্টারের সহায়তায়। স্থানীয় ভাষায়, ছবির মাধ্যমে সেখানে আপলোড করা যাবে নিজের অসুস্থতা সম্পর্কিত তথ্য। তা সরাসরি এসে পৌঁছবে আরএমআরসি-তে। এর ফলে কোথায় কত মানুষ কী ধরনের ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত, তার সম্যক ধারণা মিলছে আরও বিস্তারিত ভাবে।