
দেবদাস কুণ্ডু
শাশ্বতী মেডিক্যাল কলেজের সিস্টার। পাঁচবছর আগে রামপুরহাট সদর হাসপাতাল থেকে ট্রান্সফার হয়ে মেডিক্যাল হাসপাতালে পোস্টিং পেয়েছে। এখন গাইনি ওয়ার্ডে ডিউটি। মর্নিং ডিউটি থাকলে শাশ্বতী খুব ভোর-ভোর ওঠে। ঘরের বাসি কাজগুলো করে নিয়ে কর্পোরেশনের কলে ছ’টায় জল এলে স্নান করে পুজোয় বসে। তার আগে দুটো সবজি আর ডিমের ঝোল রান্না করে। আধঘণ্টা সময় লাগে পুজো দিতে। সাতটার মধ্যে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যায়। বিধাননগর থেকে মেডিক্যাল কলেজে যেতে আধঘণ্টা লাগে। সকালের দিকে রাস্তা ফাঁকা থাকে। ৯ নম্বর সরকারি বাস রেসের ঘোড়ার মত ছোটে। আটটার আগে ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ে খাতায় সই করে। নাইটের স্টাফের কাছ থেকে চার্জ বুঝে নিয়ে তাকে রিলিজ দেয়। তার পর রঘুকে চা বানাতে বলে। দম আটকে থাকা হৃদযন্ত্রটাকে এবার বিশ্রাম দেয়। এতক্ষণ তার সঙ্গে ওটাও ছুটছিল। ডিউটি শেষ দুটোয়। বাড়ি আসে সেই চারটে।
আমি কোনওদিন জিগ্যেস করলে বলে, ‘আমি সরকারি অফিসে কাজ করি না শাশ্বত। আমি একজন নার্স। পেশেন্ট ফেলে চলে আসতে পারি না। যতক্ষণ না ইভিনিং ডিউটিতে কেউ আসছে।’ ডিউটি সম্পর্কে এত সচেতন শাশ্বতীর কী হয়েছে কে জানে, আজ একমাস ধরে ডিউটি যাচ্ছে না। ঘরে রান্না করছে না। হোটেল থেকে খাবার আনতে হচ্ছে। মেয়ের দিকে নজর দিচ্ছে না। শুধু খাটে শুয়ে বস্তিঘরের বাঁশের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। টিভি চালিয়ে রাখে। ‘কী হয়েছে তোমার?’ জিগ্যেস করলে জবাব দেয় না। এর মধ্যে মেট্রন একদিন ফোন করেছিলেন। কেন শাশ্বতী ডিউটি আসছে না। মেট্রনকে সব বললাম। মেট্রন বললেন, ‘সাইকিয়াট্রিক ডা. রায়কে দেখাও। এভাবে চলতে পারে না।’
।। দুই।।
এখন আমরা সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ডে সিনিয়র ডা. শুভেন্দু রায়ের ঘরে বসে আছি। ডা. রায় বললেন, ‘আপনি প্লিজ একটু বাইরে গিয়ে বসুন।’
আমি বাইরে বসে। জুনিয়র ডাক্তাররা পেশেন্ট দেখছেন। কত পেশেন্ট! আমি অবাক। এত মানুষের মাথায় গণ্ডগোল। জুনিয়র ডাক্তারও ধৈর্য নিয়ে দেখছেন। কারণ এটা তো মাথায় নয়। মনের গণ্ডগোল। আর মন বড় জটিল।
প্রায় আধঘণ্টা পর শাশ্বতী বেরিয়ে এসে বললে, ‘তোমাকে স্যার ডাকছেন।’
‘আমাকে?’
‘হ্যাঁ।’
ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম চেম্বারে।
‘মি. দাস’, স্যার বললেন, ‘সিস্টারের একটা প্রবলেম দেখা দিয়েছে। সেটা আজ নয়, প্রায় একবছরের ওপর।’
‘বলেন কী স্যার? এতদিন তো ঠিক ছিল!’
‘হ্যাঁ, তা ছিল। আপনি রাজারহাটের জমিতে বাড়ি করবেন বলে কিছুদিন আগে প্ল্যান করতে দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ দিয়েছি। আসলে, বাবার বাড়িতে একটা আট বাই দশ ঘরে থাকি। পাঁচ ভাই। সেখানে জলের সমস্যা। থাকার সমস্যা। আরও অনেক সমস্যা। এ-দিকে মেয়েটা দশ পার করে এগারোতে পড়েছে। ওর পড়াশুনার জন্য ঘর…।’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ডা. রায় বললেন, ‘জমিটা বেচে দিন।’
‘কী বলছেন স্যার? ওই জমি বেচে দিলে আমি আর জমি পাব নাকি?’
‘আপনি আপনার স্ত্রীকে সুস্থ চান তো?’
‘অবশ্যই।’
ফোর্থ ক্লাস স্টাফ চা দিয়ে গেল। স্যার বললেন, ‘নিন চা খান।’ চা খেতে খেতে স্যার বললেন, ‘প্ল্যান করা বন্ধ করে জমিটা ইমিডিয়েট বেচে দিন!’
‘স্যার জমি তো বেচে দিতে পারব। কিন্তু সময় লাগবে। দালালকে বলব, সে খরিদ্দার দেখবে। তার পছন্দ হলে, দামে বললে, তবে না বেচা হবে।’
‘যদি দেখছেন জমিটা বেচতে সময় লাগছে, তবে সিস্টারকে মিথ্যে বলুন, জমিটা বেচে দিয়েছেন।’
‘মিথ্যে বলব স্যার!’
‘হ্যাঁ, একটা মানুষকে বাঁচাতে গেলে কখনও-কখনও মিথ্যে বলতে হয়।’
চা শেষ করে আমি বলি, ‘স্যার, আপনি যদি কারণটা একটু ব্যাখ্যা করেন?’
ডা. রায় বললেন, ‘আপনার মেয়ে বড় হচ্ছে। সিস্টারের শিফটিং ডিউটি। আপনার কাজ আছে। এমন তো হতে পারে, দু’জনকেই কাজে বেরুতে হচ্ছে একই সময়। মেয়েটা ঘরে একা!’
‘সে তো হতেই পারে স্যার।’
‘আর এখানেই সমস্যা!’
‘সমস্যা মানে?’
‘ওটা মুসলিম বেল্ট। আপনার আগে-পরে অনেক মুসলমানের বাড়ি।’
‘হ্যাঁ। তাতে হয়েছেটা কী?’
‘উনি সেখানে ইনসিকিয়োর ফিল করছেন।’
‘আর তা থেকেই মাথায় অসুখটা…’
‘ঠিক তাই! উনি সব সময় একটা ভয়ে-ভয়ে আছেন।’
।। তিন ।।
এই অসুখটা শাশ্বতীর আজকের নয়। প্রায় ১২ বছর আগে, মানে আমরা তখন সদ্য বিয়ে করেছি। পৌষমেলায় শান্তিনিকেতন গেছি। শ্যামবাটি ছাড়িয়ে আরও একটু ভিতরে একটা হোম স্টে করছি। লাগেজ রেখে আমরা খেতে এসেছি। শাশ্বতীর খাওয়া হয়ে গেছে। আগে চলে গেছে। আমি খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটে ঘরের দিকে যাচ্ছি। দেখি শাশ্বতী লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়।
‘কী ব্যাপার?’
‘ওই ঘরে থাকব না।’
‘কেন?’
‘মহিলাটি ভিতরের ঘরে নামাজ পড়ছে।’
‘তাতে তোমার অসুবিধে কী হল?’
‘তুমি বুঝবে না, আমি এই বকুলগাছের নিচে দাঁড়াচ্ছি, তুমি অন্য ঘর বা হোটেল দেখো। টাকা নিয়ে চিন্তা করবে না। টাকা আছে আমার।’ ট্যাক্সি করে আমি বাড়ি ফিরতে-ফিরতে শাশ্বতীকে দেখছি আর পুরনো দিনের ঘটনাটা মনে করছি।
রামপুরহাটের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। একজন মা সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরছে হাসপাতাল থেকে। শাশ্বতী তাকে, ‘তুমি এখানে টিপ ছাপ দাও।’ মেয়েটি কপাল থেকে লাল টিপ খুলে শাশ্বতীকেই পরাতে যাচ্ছিল। ফ্ল্যাটে ফিরে রাগী গলায় শাশ্বতী আমাকে বলল, ‘এরা লেখাপড়া শিখবে না। অল্প বয়সে বিয়ে করবে। বছর-বছর বাচ্চা দেবে। দেশের বোঝা বাড়াবে। এদের জন্য আর কত স্যাকরিফ্রাইস করব বলো তো?’
‘মানে? কী বলছ তুমি? কাদের কথা বলছ?’
‘ও তুমি তো আবার সেকুলার…’
‘এখানে নামবেন?’ ড্রাইভারের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ল। বললাম, ‘সামনের শিবমন্দির পার করে দাঁড় করান।’
আজ ডা. রায়কে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘কেন ওর এই ভয়?
‘সিস্টারের পিসি আত্মহত্যা করেছিলেন পূর্ববঙ্গে। ওনার ওপর অত্যাচার হয়েছিল।’
।।চার।।
এখন আমরা দাশপাড়ার ভিতর দু’কামরার সাতশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে থাকি। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। নাতি হয়েছে। শাশ্বতী খুব খুশি। আমিও।
একদিন শাশ্বতী বলল, ‘আমার একটা বড় সিংহাসন করার ইচ্ছে। তা হলে সব ঠাকুরকে ভালমত রাখতে পারব। এই ছোট সিংহাসনে অত জায়গা কোথায়!’
‘যদি তুমি তেত্রিশ কোটি দেবতাকে জায়গা দিতে চাও, বড় সিংহাসন তো লাগবে।’
‘তুমি একটা কাঠমিস্ত্রি দেখো।’
এক বন্ধুকে বলতে, ও একজন কাঠমিস্ত্রি পাঠিয়ে দিল। দু’দিন হল সে সিংহাসন বানাচ্ছে। একজন যুবক, রোগা চেহারা। দাড়ি-গোঁফ কাটা। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, দুপুরবেলা হোটেলে খেতে যাচ্ছে। বাইরে বড্ড রোদ। ঘেমেনেয়ে আসছে। শাশ্বতী হঠাৎ বলল, ‘কাল থেকে তুমি এখানেই খাবে।’
কাঠমিস্ত্রি হাসল, ‘তা হলে তো ভাল হয়। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করা যাবে।’
সাতদিন লেগেছে সিংহাসনটা বানাতে। এই পাঁচদিন দুপুরে খেতে দিয়েছে শাশ্বতী। সামনে বসে থেকে খেতে দিয়েছে। যেন অতিথি। সকালে চা-বিস্কুট, টিফিন দিয়েছে। বিকেলে দিয়েছে মুড়ি-তেলেভাজা।
গতবছর বইমেলায় গিয়ে শাশ্বতী রামকৃষ্ণ কথামৃত কিনেছে। মেলায় ফ্রি-তে দিচ্ছিল কোরান, বাইবেল। এই দুটো বইও সংগ্রহ করেছে। এই বইগুলি রাখার জন্য সিংহাসনের নিচে ড্রয়ার করছে।
বলেছিলাম, ‘কোরান-বাইবেল দিয়ে তুমি কী করবে?’
‘থাকল ঘরে। ইচ্ছে হলে পড়ব।’
‘এর আগে তুমি কখনও বাইবেল পড়োনি?’
‘বাইবেল পড়েছি। কোরান পড়া হয়নি।’
‘তা হলে এবার কি কোরান পড়বে?’
‘দেখা যাক।’
সাতদিন ছুটি নিয়েছে। মিস্ত্রি কাজ করছে। দুপুরের অবসরে শাশ্বতী কোনওদিন রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ছে। কখনও বাইবেল পড়ছে। কাজ থেকে দুপুরে ফিরে আমি এ-সব দেখেছি।
সিংহাসনটা হয়েছে অপূর্ব। শাশ্বতী খুব খুশি। বিকেলবেলা। আমি চা খাচ্ছি। শাশ্বতী সিংহাসনে দেবতাদের অবস্থান করাচ্ছে।
আমি হঠাৎ বললাম, ‘আচ্ছা শাশ্বতী, তুমি যে মিস্ত্রিকে খেতে দিয়েছ, তার নাম কি জানো?’
রামকৃষ্ণের ছবিটা পরিষ্কার করতে করতে আমার দিকে না তাকিয়ে শাশ্বতী বলল, ‘জানি, ওর নাম আলাউদ্দিন, আমার মোবাইলে সেভ করা আছে।’ যদি আবার দরকার হয় ডাকব, বড় ভাল মানুষ।
আমি কিন্তু কোনওদিন শাশ্বতীকে কোরান পড়তে দেখিনি।
চিত্রকর: মৃণাল শীল