শেষ আপডেট: 18th June 2022 11:54
কালকের দিনটা মনে আছে তো। কুড়িবছর কাটিয়ে দিলাম তোমার মত একটা অপোগণ্ডর সাথে। বলো, কী গিফট দেবে?
ঈপ্সিতা আমার দিকে পাশ ফিরেছে ‘গিফট চাই-গিফট চাই’ চোখ নিয়ে ।
বই পড়া ছাড়ো, আগে বলো, কী দেবে?
বইয়ের সিকিভাগ বালিশের নীচে গুঁজে বললাম, অনেকদিন পেঁয়াজ দিয়ে মাংস খাইনি। কাল, ভাবছি, পঁচিশ কিলো পেঁয়াজ কিনব। মাটন পাচ্চিসি বানিয়ে খাওয়াব (Short Story)। খাবা?
তোমার সবেতেই ইয়ার্কি না! ও সব ছাড়ো, শোনো, আমার একটা প্ল্যান আছে। নতুন গাড়ি কিনব। ফাইনাল ডিসিশন...
গাড়ি! গাড়ি তো আছে আমাদের।
ওটা পুরনো। এক্সচেঞ্জ করে নতুন গাড়ি নেব। ড্রাইভারলেস কার। ইমপোর্টেড। অটোমেটিক চলবে, ড্রাইভার ছাড়া।
ড্রাইভারলেস! সে তো অনেক দাম!
সে হোক। আমি ফিফটি পার্সেন্ট দেব। বাকিটা তুমি লোন নেবে। আমি কিছু শুনতে-ফুনতে চাই না। নো মোর আরগুমেন্ট।
কী মুশকিল! সে নয় হবে, তাই বলে কাল আর একেবারে ড্রাইভারলেস?
তুমি একটা টিউবলাইট। আরে বাবা, ড্রাইভারের খরচা বাঁচবে। বিশ হাজার টাকা কম নয়। তুমি ইমানুলকে কাল জানিয়ে দিয়ো। আমি কুলীন বামুন। ঘরে পুজোটুজো হয়। এমনিতেও ওকে আমার আজকাল পছন্দ হচ্ছে না। কী সব মিছিল-ফিচিলে হাঁটছে। দেশ থেকে তাড়ানোর আগে তুমি ওকে তাড়িয়ে দাও।
ঈপ্সিতা একটু রেগেই কথাগুলো বলেছে। খানিকটা অভদ্রতা মেশানো। আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। ইমানুলের মিছিলে যাওয়া নিয়ে আমার কোনও অসুবিধাই নেই, কিন্তু মিষ্টুকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় যদি কিছু একটা ঘটে যায়... ওদের তো এখন শত্রু কম নয়। আমি চুপ করেই থাকলাম।
ঈপ্সিতা কম্বলের গরমে নরম গলায় বলল, কাল তা হলে যাচ্ছি কিন্তু। আমি শো-রুমটা চিনি। কথা বলে রেখেছি। প্রিয়াঙ্কারা অলরেডি কিনে ফেলেছে। ফেসবুকে খুব শো-অফ করছে। আর পারি না। দেড়হাজার লাইক। তিনশো সাতাশটা কমেন্ট। তুমি ভোদারাম, পনেরো বছর হল মারুতি থেকে বেরতেই পারলে না।
এই খুচরো অপমানগুলো এখন কর্পূরের মত উবে যায়। প্রথম-প্রথম বিষমাখানো আলপিন হয়ে ফুটত। আমি ভাবছি ইমানুলের কথা। ছেলে হিসেবে তো খুব ভাল। ওর মেয়ের জন্মদিনে হালিম খেয়েছি। বকা খাওয়ার ভয়ে ঈপ্সিতাকে বলিনি। ঘুম পাচ্ছে। চোখ বুঝলাম। আমার মনে ড্রাইভারলেস কার, ইমানুল আর নতুন একটা কার-লোনের আজব এক মিছিল!
ড্রাইভারলেস কারের শো-রুমটা শহরের ঠিক মাঝখানে। যদ্দুর মনে পড়ে, এখানে একটা কারখানা ছিল। দু’বছর আগেই সেখানে আগুন লাগে। লাগিয়ে দেওয়া হয়। সব মাটিতে মিশে গিয়েছিল, যাকে বলে গ্রাউন্ড জিরো।
শো-রুমের ম্যানেজার আমাদের বসতে বললেন। কালো গদিওলা সোফার সামনে কাচের টেবল। টেবলে বিজনেস ওয়ার্ল্ড, ইন্ডিয়া টুডে।
আমার জন্য কফি এল, ঈপ্সিতার হাতে মকটেল। আমার পেটে গুঁতো মেরে সে বলল, অত দামি গাড়ি কিনব, মকটেল খাওয়াবে না। খেয়ে নাও, ফ্রি।
ম্যানেজার গাড়ির ক্যাটালগ নিয়ে এলেন। স্মার্ট ম্যানেজার। চেহারায় আর মেজাজে বলিউডি ছাপ।
তিনি বললেন, স্যার, ড্রাইভারলেস কার কিন্তু ট্র্যাডিশনাল যে সব গাড়ি আপনারা চালিয়েছেন, তার থেকে একদম আলাদা। এই গাড়িতে লেটেস্ট টেকনোলজি আছে। স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট টেকনোলজি। কাস্টমারের ফিলোসফির ওপর গত দশবছর স্টাডি করে এই গাড়িগুলো বানানো হয়েছে। তো স্যার, আপনার ফিলোসফিটা ঠিক কী, সেটা জানতে চাইব। অ্যাকরডিংলি গাড়ি সাজেস্ট করব।
আমি ঈপ্সিতার দিকে তাকালাম। ঈপ্সিতা ফিলোসফিতে এমএ। ঈপ্সিতাও এখন আমার দিকে তাকিয়ে। সে ঠিক দেখেছে, আমি গতকাল হিস্ট্রি অব চাইনিস ফিলোসফি পড়ছিলাম।
ম্যানেজার আমাদের সমস্যা বুঝে বললেন, আমি আপনাকে ব্যাপারটা জলের মত বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরুন, আপনি এই ইন্টেলিজেন্ট গাড়িতে বসে। গাড়ি আশিতে চলছে। হঠাৎ সামনে একটা গরু। গাড়ির ইন্টেলিজেন্স হিসেবে করে দেখল, গরুটাকে বাঁচাতে ডানদিক ঘেঁষে থার্টি সেভেন ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে যেতে হবে। সেখানে আবার একজন হকার বেগুন বিক্রি করছে। সে দিকে গেলে হকারের চোট লাগতে পারে। আর যদি ব্রেক কষে, তা হলে পেছনের গাড়ি এসে আপনার এই দামি গাড়ি ড্যামেজ করতে পারে। মনে রাখবেন, এই গাড়ির সেভেন ডাইমেনশনাল চোখ আছে। সামনে, পেছনে, সাইডের মোট তিনহাজার গাড়ির পজিসন হিসেবে রাখতে পারে। এই হল ব্যাপার। আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা গাড়ি প্রোভাইড করব। টেল মি ম্যাডাম, হাউ ডু ইউ ওয়ান্ট ইওর ড্রাইভারলেস কার টু রিয়্যাক্ট?
আমি আনসারলেস। ঈপ্সিতাও চুপ।
অগত্যা আমিই জিজ্ঞেস করলাম, মানে আপনি বলতে চাইছেন, গাড়িটা ইচ্ছে করলে হকারকে ধাক্কা মারতে পারে গরুটাকে বাঁচাতে? এতে তো সেই হকার মারাও যেতে পারে। এমন গাড়ি কেউ কেনে নাকি?
কেনে মানে! কিনছে তো স্যার। হট সেল। এই রকম মরণবাঁচন সিচুয়েশনে রাস্তায় হকার, পাগল, কুকুর, ছাগল সবাইকে মেরে উড়িয়ে দেবে স্যার, কিন্তু গরু যদি সামনে থাকে, তা হলে ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার ব্রেক। দেড়হাজার গাড়ি অর্ডার হয়েছে। সব গাড়ির রং ডিপ স্যাফরন। ওদের ডিমান্ড অনুযায়ী গাড়িতে একটা অ্যাডভান্সড ফিচার রেখেছি। ব্রেক কষেই গাড়ি থেকে অটোমেটিক ‘মা’ বলে একটা সাউন্ড বেরবে। এত সুন্দর ‘মা’ বলে উঠবে না স্যার, চোখের জলে ম্যাডামের শাড়ি ভিজে যাবে।
আমি কিছু বলার আগেই ঈপ্সিতা বলে উঠল, আচ্ছা এমন কোনও গাড়ি নেই, যে সবাইকেই বাঁচাবে? এ সব মারামারির মধ্যে গেলে তো আবার পুলিশ কেস। ড্রাইভার তো নেই, গাড়িকে তো আর অ্যারেস্ট করবে না, ধরলে আমাদের ধরবে। দেখুন, কুকুর বিড়াল মানুষ সবাইকেই আমি ভালবাসি। কেউ মারা যাক, আমি একদম চাই না।
ম্যানেজার ওসেন গ্রিন রঙের একটা গাড়ি দেখিয়ে বললেন, এইটে নিতে পারেন ম্যাডাম। এটা মহাবোধি ভার্সন। ভগবান বুদ্ধের দর্শনে অনুপ্রাণিত। কিন্তু এতে আপনার নিজের গাড়ি কিন্তু ড্যামেজ হতে পারে। অসুবিধা নেই। মহাবোধি ইন্স্যুরেন্স আছে। নতুন বছরে আপনাদের জন্য কম প্রিমিয়ামে ব্যবস্থা করে দেব। কী বলেন?
ঈপ্সিতা ফিসফিসিয়ে বলল, কী গো, বুদ্ধটাই নিয়েনি না কি?
আমার বুদ্ধির পুঁজিতে প্রবল সঙ্কট। সঙ্কটমোচনে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আর কী কী ভার্সন আছে আপনাদের? যদি আরও বেটার কোনও অপশন পাই, তাই জিজ্ঞেস করছি আর কী।
ম্যানেজার হেসে বললেন, স্যার, টোটাল তিনশো পঁচাত্তরটা ভার্সন।
আমার মুখ হাঁ। কী বলেন! মানে, আপনি বলতে চাইছেন ভারতবর্ষে এখন তিনশো পঁচাত্তরটা ফিলোসফি?
ম্যানেজার ঘাড় নেড়ে বললেন, এক্স্যাক্টলি স্যার। ফেসবুক টুইটার ইনস্টাগ্রাম হোয়াটসঅ্যাপে আপনাদের সবাইকে স্টাডি করে এতগুলোই বেরিয়েছে এখনও পর্যন্ত। ওয়েস্ট বেঙ্গল তো একাই তিনশো এগারোটা ফিলোসফি হোল্ড করছে। প্রত্যেক মাসে নতুন একটা করে অ্যাড হচ্ছে জানেন! কী ঝামেলা বলুন তো। ইঞ্জিনিয়ারদের হেবি খাটনি। গাড়িগুলো সবসময় আপগ্রেড করতে হয়।
আমি কিছু বুঝতে না পেরে ঈপ্সিতার দিকে তাকালাম। ঢোকার মুখে ঈপ্সিতার মুখের প্রথম উত্তেজনা অনেকটাই ফিকে। তার মুখে এখন এক অসহায় গোবেচারা দার্শনিক যেন লুকোতে চায়।
ম্যানেজারকে বললাম, তা হলে তো আপনাদের গাড়ির বিক্রি প্রচুর। সব ভার্সনই তো বিক্রি হয়। কেউ না কেউ তো নিচ্ছেই। তাই না?
না স্যার। সব নয়। আছে কয়েকটা। কোনও বিক্রি নাই। যেমন ওই তীর্থঙ্কর ভার্সন।
কে তীর্থঙ্কর?
ওই স্যার, মহাবীর, জৈন ধর্ম।
সে তো ভাল। তা বিক্রি নেই কেন?
সে কী আর বলব, আগের মাসেই জৈন মন্দিরের এক পুরোহিত কিনে নিয়ে গেল। কত কথা। পিঁপড়ের আর গঙ্গাফড়িঙের ওপর তার কী দরদ! একসপ্তাহ পর গাড়ি ফেরত।
কেন?
বলছে, পঞ্চাশ মিটার যেতে সাতাশবার নাকি গাড়ি থেমেছে। ভেবেছিলেন গাড়ির সমস্যা। তা নয়। গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন একটা গুবরে পোকা রাস্তা পার হচ্ছে। সামনে দিয়ে যতবার কেন্নো, গুবরে, স্যাপ, ব্যাঙ যায়, গাড়ি ফুল ব্রেক মারে। দশের বেশি নাকি গাড়ি উঠছেই না। শেষে বন্ড সই করে একটা মহাবোধি নিলেন। এখন মনাস্ট্রিতে পার্ট টাইম ত্রিপিটক পড়ান।
আমার গলা দিয়ে মিনমিনে আওয়াজ বেরোল, কী সাংঘাতিক!
হ্যাঁ স্যার, খুব সাংঘাতিক! আপনারা তা হলে কোনটা নিচ্ছেন?
ম্যানেজারের চাপ ক্রমশ ঘন হচ্ছে। বললাম, আমাদের মিনিট পাঁচেক সময় দিন, একটু প্রাইভেটে। ভেবে বলছি।
ম্যানেজার ‘ওক্কে স্যার’ বলে অন্য কাস্টমার সামলাতে অন্যদিকে চলে গেলেন।
ইপ্সিতাকে হেসে বললাম, কী, কোনটা নেবে? বুদ্ধ, মহাবীর না বীর সাভারকার?
ধুর, আমার কিছু মাথায় ঢুকছে না। তুমি বরং ইমানুলকে জিজ্ঞেস করো তো, ও কীভাবে গাড়ি চালাত। ওর ফিলোসফিটাই গাড়িতে সেট করে দিতে বলো না।
ঈপ্সিতাকে উস্কে দিতে ঠান্ডাগলায় বললাম, না না, ইমানুল মিছিল-টিছিল করছে, ওর মন এখন ওইদিকে, ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ফালতু ছেলে।
না, ফালতু কেন হবে, ইমানুল খুব ভাল ড্রাইভার। আজ পর্যন্ত আমাদের গাড়িতে আঁচ পর্যন্ত লাগতে দেয়নি। গাড়ি চালানোর সময় সবার কথা মাথায় রাখে। গুবরে পোকারও।
আমি সুযোগ বুঝে বললাম, তা হলে ইমানুলের ফিলোসফির সাথে সেও থাকুক। তুমি যতই ওর ওপর রাগ করো, আমি জানি, তুমি ভেতরে ভেতরে ওকে ভাইয়ের মতই ভালবাসো। মিষ্টুর জন্মদিনে ওকে তুমি পায়েস এমনি এমনি খাওয়ালে। আমি ঠিক জানি, রক্তচাপ আর ফেসবুক তোমার মাথাটা খেয়েছে। তার চেয়ে বরং গাড়িটা সার্ভিসিং করাই। অনেকদিন লং ড্রাইভে যাইনি। গভীর জঙ্গলে যাই চলো। সবুজ সবুজ, কত হরিণ, কত পাখি। যে হারে সব গাছ কেটে দিচ্ছে, গাছ দেখতে এর পর মিউজিয়াম যেতে হবে। শোনো, আমি বরং একটা সিগারেট খেয়ে আসি। তুমি ঠান্ডামাথায় দশ মিনিট ভাবো।
শো-রুমের বাইরে এসে সিগারেট ধরালাম। একটা মিছিল যাচ্ছে সামনের বড় রাস্তা দিয়ে। ইমানুলের বয়েসি অনেক ছেলেমেয়ে সেই মিছিলে। মনে হল, ঢুকে পড়ি মিছিলে। ইচ্ছে আছে, তাগিদ নাই।
ফিরে এসে দেখি, ম্যানেজার গাড়ির ক্যাটালগ নিয়ে ঈপ্সিতার সামনে দাঁড়িয়ে। ঈপ্সিতার মাথা নিচু। ভাবছে। দাঁত বার করে ম্যানেজার বললেন, স্যার, এখন নিউ ইয়ার ডিসকাউন্ট চলছে। কোনটা নেবেন ডিসাইড করলেন?
আমি বুড়ো আঙুল দিয়ে ঈপ্সিতার দিকে ইশারা করলাম। ম্যানেজার গলা নামিয়ে বললেন, ম্যাডাম একটা কথা বলব? ও সব বুদ্ধফুদ্ধ ছাড়ুন, আপনি আপনার ফিলোসফিটা বলুন, আমি অ্যাকরডিংলি বেস্ট প্রাইসে বেস্ট গাড়িটা আপনাকে সাজেস্ট করব।
আমি রুদ্ধশ্বাসে ঈপ্সিতাকে দেখছি। ওর মুখে কলেজপড়ুয়া ঈপ্সিতার অনেক পুরনো ছবিটা আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে।
ম্যানেজার আবার বললেন, ম্যাডাম?
ঈপ্সিতা মুখ তুলল। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি এনে বলল, এখন বরং থাক, বুঝলেন। আমার ফিলোসফিটা আপাতত আমি আপগ্রেড করছি।
চিত্রকর: মৃণাল শীল