ছায়া
রহস্যের আর এক নাম হল ছায়া
যখন সে ঘনাইছে বনে বনে
তখন সে যতটুকু আষাঢ়-শ্রাবণের, ততটুকুই রবীন্দ্রনাথের।
আবার গাছের হলে তা যতখানি কাঠবিড়ালির
ততখানিই পথিকের।
নেতার হলে চলতে হবে তার পিছু পিছু
আর, হায়, দলিতের হলে পাপ, মাড়ালেই।
শত্রুর হলে দুপ
রহস্যের আর এক নাম হল ছায়া
যখন সে ঘনাইছে বনে বনে
তখন সে যতটুকু আষাঢ়-শ্রাবণের, ততটুকুই রবীন্দ্রনাথের।
আবার গাছের হলে তা যতখানি কাঠবিড়ালির
ততখানিই পথিকের।
নেতার হলে চলতে হবে তার পিছু পিছু
আর, হায়, দলিতের হলে পাপ, মাড়ালেই।
শত্রুর হলে দুপুর বারোটার, নিজের হলে সকাল বা বিকেলের
মায়ের হলে অবশ্যই তা আঁচলের।
সত্যিই রহস্যের আর এক নাম হল ছায়া।
মানুষের জীবনে এই শব্দটির ছায়া
কতভাবেই না পড়েছে!
তবে দু’টি বিষয় নিয়ে কোনও রহস্য নেই।
এক. ছায়া পড়ছে মানেই রোদ্দুর রয়েছে
আর
দুই. বাবার ছায়া থেকে চিরকাল বেরোতে চাওয়া পুরুষ
মধ্যচল্লিশে এসে সেই ছায়ার নীচেই চায় একটু জিরোতে।
পথ
তার স্মৃতি প্রখর। তাই যখন মাঝরাত্তিরে গাঁক গাঁক করে মোটর সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে গুরা, গ্রামের শেষ নবাব, আর তার বড়সড় চেহারার কারণে তারাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আকাশের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে দুখি চাঁদ, তখন তার মনে পড়ে কিশোরীর সাজি থেকে তার বুকের ওপরে টুপ করে খসে পড়া শিউলি ফুলের কথা। মনে পড়ে ট্র্যাক্টরের চাকার তলায় পিষে যাওয়া ছাগলছানাটির বিস্ফারিত দুই চোখ আর ড্রাইভারের মুখ-নিঃসৃত অদ্ভুত ‘চু চু চু’ আক্ষেপ। মনে পড়ে ইয়াসিন আর লক্ষ্মীকেও। গুরার মোটর সাইকেল চলে যাওয়ারও অনেক পরে আলো ফোটবার আগেই যারা গ্রাম ছেড়েছিল। আর মনে পড়ে সেই কতদিন আগেকার ঠ্যাঙাড়েদের কথা, হাঁটুর ওপরে যারা পরে থাকত ধুতি আর ওঁৎ পেতে থাকত শিকারের জন্য। তারপর এল প্রসন্ন মাস্টার। স্কুল হল। বুড়ো অশথ পড়ে গেল। মনে পড়ে। তার সব মনে পড়ে। যা যা সে দেখেছে–সব মনে আছে তার। তবে কোনও কিছু নিয়েই তার বাড়তি কোনও আগ্রহ বা কৌতূহল নেই। শুধু এক একদিন গুরার মোটর সাইকেল চলে যাওয়ার পর তার জানতে ইচ্ছে করে শহরে কেমন আছে লক্ষ্মী আর ইয়াসিন।
বাহ রে! পথের স্মৃতি থাকবে আর মন থাকবে না?
সকাল
কে কখন সকাল দেখবে কেউ জানে না।
ছ’মাস পরে পরে সকাল দেখতেন কুম্ভকর্ণ।
আচ্ছা, জেলে থাকার সময় নেলসন ম্যান্ডেলা
ঠিক কতবার সকাল দেখেছিলেন?
সূর্যকে তো উঠতে দেখছ প্রায় রোজ
কিন্তু বলো তো
তুমিই বা কতদিন দেখেছ সকাল?
মরীচিকাকে নিয়ে এত না-ভেবে
মানুষের উচিত ছিল সকালকে নিয়ে ভাবা
কারণ সকালও প্রতারক।
আমেরিকাগামী প্লেনে যখন তোমাকে
কন্টিনেন্টাল প্রাতরাশ দেওয়া হল
তখন তুমি তো জানো যে,
তোমার দেশে হুংকার দিচ্ছে অন্ধকার।
আবার আট বছর আগে একদিন
রাত্রি নটায় অভুক্ত পথশিশুকে
যখন তুমি কিনে দিয়েছিলে একটা গোল পাঁউরুটি
তখনই সে ভেঙেছিল উপবাস, শুরু হয়েছিল তার সকাল।
তবে সকালের গল্প শেষ হবে না আমাদের ছোটপিসিকে ছাড়া।
পারেও বটে ছোটপিসি।
পঁয়তাল্লিশ বছর আগে নিরঞ্জনকাকু
একটা সকাল আনবে বলে গ্রাম ছেড়েছিল
আর
মোরগের ডাক শুনবে বলে ছোটপিসি
আজও অপেক্ষায় আছে।
নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে যে যুবক
সে দিব্যি আছে। এ গ্রামে সংসারের অত ঝামেলা নেই।
এখন তার নিজের জন্য কত সময়!
সে দু’পাতা পড়ে, চারপাতা লেখে। তারপর কাজে বেরোয়।
এ গ্রামে তার নাম অন্য। কাজও ভিন্ন।
সে চাষিভাইদের সঙ্গে ফসল নিড়ানির কাজ করে,
মাস্টারমশাইয়ের ছোটছেলেকে সে সন্ধেবেলা আঁক কষিয়ে দেয়,
তার দিদি তাকে আড়চোখে দেখে।
এক একদিন সে টহল দিতে বেরোয়।
এ পাড়া, ও পাড়া, বুড়ো বটতলা,
জোড়া শিবমন্দির, মনসার থান ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে
সে জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়, আঁজলা ভরে জল খায়।
এ তল্লাটের এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে সে যায়নি
শুধু বাসস্ট্যান্ডে সে কখনও যায় না।
বাস দেখলেই তার মেয়ের দু’চোখ মনে পড়ে।
যাত্রী
আগুন জ্বালাতে শিখে সে প্রমাণ করেছিল
শানিত তরবারির মতো ক্ষুরধার তার বুদ্ধি।
নদীতে বাঁধ দিয়ে সে দেখিয়েছিল
কুস্তিগিরদের মতো তার পেশির জোর নেহাত কম নয়।
চাঁদে লোক পাঠিয়ে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল
ঘুড়ি ও পাখিদের চেয়ে আরও অনেক উঁচুতে
উঠে যেতে পারে তার কল্পনা
আবার সাবমেরিনে চড়ে এক মহাদেশ থেকে
অন্য মহাদেশে পৌঁছে গিয়ে
সে বুঝিয়ে দিয়েছিল
দেবতাদের মতো জলে স্থলে অন্তরিক্ষে তার অবাধ যাতায়াত।
কিন্তু এসব কিছুর জন্য নয়
মানুষ যে এতটা পথ হেঁটে এল তার কারণ
আজও সে
অন্যের দুঃখে কাঁদতে পারে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলের সচিব। পেয়েছেন কৃত্তিবাস, বাংলা আকাদেমি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রভৃতি পুরস্কার। কবিতা পড়তে গিয়েছেন আমেরিকা, স্কটল্যান্ড, জার্মানি ও বাংলাদেশে।