
সন্ধ্যার নিরাভরণ স্তিমিত আলোয় শ্যামানন্দ দেখলেন সুহাসিনী কিশোরী একখানি ক্ষুদ্র মাটির কলস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাঁর দিকে তাকিয়ে পুনরায় মৃদু নূপুরধ্বনির মতো সুরে বলল, ‘পানি লিজিয়ে বাবুজি, শিউজীকা শির পর চঁড়াইয়ে!’
কলসটি দু হাতে নিয়ে শ্যামানন্দ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অ্যায়সি সাম মে তুম কাঁহা সে আয়ি হো বেটি? ম্যায়নে শুনা থা সাম হো যানে সে ইঁহা পর কোই নহি আতা।’
অস্তরাগে রঞ্জিত আকাশে সুদূর অলকানন্দার মতো হিল্লোল তুলে বয়ে গেছে শৈলরাজি। পাদদেশে গহিন হরিদ্রাভ সমুদ্রসম অরণ্যানী দিনান্তের ম্লান আলোয় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। মন্দির সংলগ্ন গিরিচূড়ার শীর্ষদেশ হতে সমগ্র উপত্যকাটি ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী বলে ভ্রম হয়। চরাচর সম্পূর্ণ কোলাহলশূন্য। দীর্ঘ প্রতীক্ষার মতো পদ্মকুসুম আঁখি মেলে কিশোরী বলল, ‘ম্যায় ইঁহা পর রেহেতি হুঁ!’, পরমুহূর্তেই একটি গেরুয়া সাপি থেকে কতগুলি অস্ফুট গাঢ় পীতবর্ণ বনকুসুমু মুঠি ভরে নিয়ে শ্যামানন্দের সামনে নিজের করতল উন্মুক্ত করে মৃদু হাসল, ‘আরতি কিজিয়ে বাবুজি, মেরা পাস ধূপ ঔর দীপ ভি হ্যায়!’
সাপিটি খেয়াল করে বিস্মিত হলেন শ্যামানন্দ। এমন গেরুয়া সাপি সন্ন্যাসীদের সঙ্গী। এই দুর্গম শ্বাপদসঙ্কুল মুণ্ড মহারণ্যে প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় কিশোরী পুষ্প-ধূপ-দীপ কোথা হতেই বা সংগ্রহ করল! অল্পক্ষণ পূর্বে সাপিটি কি দেখেছিলেন?
সহসা তাঁর মনোবৃত্তি অনুসরণ করেই যেন কিশোরী সুললিত কণ্ঠে বলল, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে বাবুজি। সামমে হামেশা শিউজীকে আরতি কে লিয়ে ম্যয় আতি হুঁ!’
ভগ্নপ্রায় জীর্ণ দেবমন্দিরে সন্ধ্যারতির জন্য এই কিশোরী নিয়মিত আসে- এই কথা তেমন বিশ্বাস না হলেও শ্যামানন্দ নীরব রইলেন। অনাম্নী কিশোরী সাপি থেকে সযত্নে একখানি মৃৎ-প্রদীপ চন্দন ধূপ এবং আরেকটি ক্ষুদ্র মাটির পাত্র বের করে গর্ভগৃহের সম্মুখে সাজিয়ে রেখে শ্যামানন্দের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সেই ওষ্ঠচাপা কুসুম হাস্যে জগতের সকল মালিন্য এক নিমেষে যেন দূর হয়ে যায়। নিথর অরণ্যে এখন ছায়া পশ্চিমগামী। প্রাচীন বৃক্ষরাজির মাথায় দিনান্তের শেষ আলোও দ্রুত নিভে আসছে। মাটির পাত্র হতে অল্প ঘি প্রদীপে ঢেলে সাপি থেকে দিয়াশলাই বের করে শিখায় অগ্নিসংযোগ করতেই প্রাচীন দেবমন্দির পীতবসনা রহস্যময়ীর মতো আলোয় ভরে উঠল। সম্মুখে গর্ভগৃহ, কতগুলি ভগ্ন প্রস্তর সোপান নেমে গেছে দেবগৃহে। উজ্জ্বল প্রদীপটি শ্যামানন্দের হাতে সন্তর্পণে তুলে দিয়ে পূর্ণ চোখে তাকাল কিশোরী। স্পষ্ট আলোয় তিনি দেখলেন পারিজাত পুষ্পের সুবাস তুল্য মুখখানি মায়াদেবীর স্নেহ ও ভালোবাসার অলীক বসনাবৃত। ভ্রমরকৃষ্ণ কেশরাজি বেণীবন্ধনে শৃঙ্খলিত। ধীর স্বরে কন্যা বলল, ‘যাইয়ে বাবুজি, শিউজীকা আরতি কে লিয়ে যাইয়ে।’গর্ভগৃহটি পরিচ্ছন্ন। অমসৃণ প্রস্তরগাত্র রুক্ষ হলেও যথেষ্ট শীতল। দীপের ক্ষীণ আলোয় শ্যামানন্দ দেখলেন পূজার উপচারের চিহ্নমাত্র নাই। সম্ভবত বহুকাল এইস্থলে কেউ পদার্পণ করেনি। নর্মদামুখী লিঙ্গের গৌরীপট প্রস্তরনির্মিত। শ্বেতশুভ্র গোলাকৃতি স্ফটিক লিঙ্গের মধ্যস্থলে অতি উজ্জ্বল রক্তচ্ছটা দৃশ্যমান, কয়েক মুহূর্ত পর বুঝতে পারলেন শূলপাণি এখানে রৌদ্রলিঙ্গরূপে প্রকট। নিজের অজান্তেই শ্যামানন্দ অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, নর্মদাসম্ভবাং রৌদ্রং শ্বেতং রক্তং গোলাকৃতি, রৌদ্রলিঙ্গং তথা খ্যাতং সর্বজাতিষু সিদ্ধিদ্ম।
গর্ভগৃহের নৈঋত কোণে একখানি ত্রিশূল প্রস্তরভূমির উপর প্রোথিত। দীপটি গৌরীপটের নীচে রেখে বাকি উপচারগুলির জন্য গর্ভগৃহের সোপান বেয়ে উপরে উঠে আসার সময়ে হঠাৎ শ্যামানন্দের খেয়াল হল কিশোরী মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই শ্বাপদপূর্ণ ভীষণ অরণ্যে বিপদ হয়নি তো কোনও! অজানা শঙ্কায় দ্রুত পায়ে গর্ভগৃহের বাইরে প্রশস্ত চাতালে উঠে এসে দেখলেন নিঃসীম আঁধারে নিমজ্জিত চরাচর জনমানবশূন্য। বনস্থলী যেন কৃষ্ণকায় কালসর্পের রূপ ধারণ করেছে। মাথার উপর সহস্র কোটি নক্ষত্রের অপরূপ সজ্জা। নিথর মুণ্ড মহারণ্যে এই অতি প্রাচীন দেবালয়ে শ্যামানন্দ একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, কিশোরী কন্যার চিহ্নমাত্র কোথাও নেই।
গর্ভগৃহ থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ জলধারার মতো মৃদু আলোয় দেখলেন উপচার তেমনই সাজানো রয়েছে এবং কী আশ্চর্য একখানি সবুজ পাতায় কতগুলি বাজরার রুটি আর পাশে মাটির পাত্রে কেউ যেন পরম যত্নে দুধ রেখে গেছে! ক্ষুধার অন্ন, নিকটে গিয়ে স্পর্শ করে বিস্ময়ের অবধি রইল না। রুটিগুলি যেন সদ্য উনান থেকে এইমাত্র নামানো হয়েছে, সফেন ঘন দুধও উষ্ণ। সন্তানের জন্য জননী হয়তো এভাবেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে ক্ষুধানিবৃত্তির পন্থা অবলম্বন করেন। কৃপাময়ীর নিশীথিনীসম আলুলায়িত কৃষ্ণকেশরাজির মায়ায় আচ্ছন্ন অরণ্যানী এবং তাঁর নক্ষত্রখচিত দূকুলাবৃত অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে করজোড়ে সাশ্রু নয়নে শ্যামানন্দ মৃদু স্বরে বলে উঠলেন, মহাগভীরনীরপূরপাপধূতভূতলং, ধ্বনৎসমস্তপাতকারিদারিতাপদাচলম্ । জগল্লয়ে মহাভয়ে মৃকণ্ডুসূনুহর্ম্যদে, ৎবদীয়পাদপঙ্কজং নমামি দেবি নর্মদে।গর্ভগৃহে ফিরে এসে উপচার সাজিয়ে পদ্মাসনে বসলেন শ্যামানন্দ। কলসী হতে সামান্য নর্মদাবারি শুষ্ক চন্দনে দিতেই দেবালয় অপরূপ সুবাসে ভরে উঠল- যেন সহস্র ব্রহ্মকমল বিকশিত হয়েছে। স্নানান্তে রৌদ্রলিঙ্গের সর্বাঙ্গে সযতনে সেই সুগন্ধী চন্দন প্রলেপ দিলেন। ধূপে অগ্নিসংযোগের মুহূর্তে শ্যামানন্দের শরীর ও মন আচ্ছন্ন করে উঠে এল সহস্র বৎসর পূর্বের স্মৃতি। ভগবান সনৎকুমার যেন এইস্থলে বসেই মহর্ষি নারদকে নাম-বাক-মন-সংকল্প-চিত্তের উপদেশ দান করছেন। সুললিত মধুক্ষরা কণ্ঠস্বরে বলে চলেছেন, ধ্যায়তীব পৃথিবী-ধ্যায়তীব অন্তরীক্ষং, পরমুহূর্তেই বলছেন, যো বৈ ভূমা তৎ সুখম্, নাল্পে সুখমস্তি আর মহামুনি নারদ সেই উপদেশ অবলম্বন করে তমসাবৃত জগতের পরপারে সেই নিত্য জ্যোতির্ময় সত্তার প্রকৃত স্বরূপ অনুভব করছেন… রৌদ্রলিঙ্গরূপে প্রকট হিমাদ্রীশেখরকে চন্দন-চর্চিত পীতবর্ণা বনকুসুম অর্ঘ্য দিলেন শ্যামানন্দ। কণ্ঠে অনুরণিত হয়ে চলেছে মন্ত্র- ত্রিশূলডমরুধরং শুভ্ররক্তার্ধভাগতঃ, অর্ধনারীশ্বরাহ্বানং সর্বদেবৈরভীষ্টদম্, পুনরায় একটি পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে মেঘমন্দ্রিত স্বরে উচ্চারণ করলেন, ওঁ শুভঙ্করায়ঃ নর্মদা-শঙ্করায় তে নমঃ শিবায়, ওঁ কর্মপাশ-নাশ নীলকণ্ঠ তে নমঃ শিবায়!
পূজা সমাপান্তে বাজরার রুটি এবং দুধ মুখে দিতেই ক্ষুধা ও সারাদিন পথ চলার শ্রম নিমেষে দূর হল। মন্দিরের প্রশস্ত চত্ত্বরে বসে রয়েছেন শ্যামানন্দ। অদূরে ক্ষীণকায় দীপটি সামান্য আলোকবৃত্ত রচনা করে ঘোর নিশীথ তমসাবৃতা চরাচরকে যেন অধিক রহস্যময়ী করে তুলেছে। নিদ্রাতুরা অরণ্য শব্দহীন নিথর। একটিও শ্বাপদ কি রাতচরা পাখির সাড়া নাই। অবোধ শিশুর মতো অস্ফুট চোখে তাকিয়ে রয়েছে সহস্রকোটি নক্ষত্ররাজি। অবসন্ন শ্যামানন্দের দুটি চোখে নিদ্রাদেবী তাঁর আঁচলের ছায়া বিছিয়ে দিয়েছেন। প্রায় নিদ্রিত দেহটির পাশ দিয়ে একটি অতিকায় সর্প নিঃশব্দে গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে চলে গেল। গর্ভগৃহে আশুতোষ সদা জাগ্রত। কথিত রয়েছে এই দেবালয়ে গভীর রাত্রে রুদ্রপিশাচের দল নেমে আসে। সাত ক্রোশ দূরের গ্রাম থেকে ভুলেও কোনও মানুষ সূর্যাস্তের পর এই মন্দির প্রাঙ্গনে পা দেয় না। বহু বৎসর পর আজ শ্যামানন্দ এইস্থলে রাত্রিবাসের সংকল্প করেছেন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, রাত্রির সম্ভবত দ্বিতীয় প্রহর। ধীরে ধীরে ঘন কৃষ্ণ মেঘে আচ্ছন্ন হল পূর্বাকাশ, বৃষ্টির নূপুরধ্বনি বেজে উঠেছে জগতে। সহসা শ্যামানন্দের নিদ্রিত শরীরের পাশে রাখা দীপটি কে যেন অতি সন্তর্পণে নিভিয়ে দিলেন।
এড়োয়ালি গ্রামে দোতলার ঘরে পশ্চিমের জানলাটি খোলা রয়েছে। পুরাতন কালের পালঙ্কে ঘুমিয়ে রয়েছেন ঈশ্বর। বন্ধ ঘরে তিনি ঘুমোতে পারেন না। অল্পক্ষণ পূর্বে মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে। কার্তিকের হিমশীতল বাতাস বয়ে আসছে। নিদ্রিত প্রান্তর ক্ষুদ্র গ্রাম এই প্রাচীন জনপদ এখন দুধ কুয়াশায় আচ্ছন্ন-দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোনও অবগুণ্ঠনবতী নিদ্রাতুর জগতের উপর তাঁর অলীক রেশমী শাড়ির আঁচলখানি সযত্নে বিছিয়ে দিয়েছেন। এই ভদ্রাসনের সুপ্রাচীন বাণেশ্বর থানে একখানি মৃদু প্রদীপ সারারাত্রি আলো দেয়। আজও সে জেগে রয়েছে। বাগানে আঁধার থইথই গাছ থেকে একটি হুতোম প্যাঁচা তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উড়ে গেল নিঃসীম রাত্রিপানে। ঈশ্বর রাওয়ের ঘরটি সম্পূর্ণ অন্ধকার। মাথার কাছে টেবিলের উপর একটি মৃদু হ্যারিকেন রেখে গেছিল ঋষা কিন্তু সেটিও ঈশ্বর ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিভিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ঘুম যদিও খুব পাতলা, সামান্য শব্দেই শরীর ও মন সজাগ হয়ে ওঠে। পেশাগত নানাবিধ অভ্যাসের কারণেই এটি হয়েছে। তবুও আজ মনে হচ্ছে তিনি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মুখখানি বালকের মতো নির্মল, শুধু কী এক আশ্চর্য কারণে ঠোঁট দুটি মাঝে মাঝে অল্প নড়ছে, ঈশ্বর কি কারোর সঙ্গে কথা বলছেন?
সহসা গভীর নিদ্রার মাঝে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হল। ঈশ্বর দেখলেন গহিন অরণ্যে একটি ভগ্নপ্রায় দেবমন্দিরের গর্ভগৃহে ক্ষীণ দীপালোকে বসে রয়েছেন একজন দীর্ঘকায় পুরুষ। গেরুয়াবসনাবৃত শরীর, চোখদুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। গাঢ় পীতবর্ণ বনকুসুমের একখানি মালা তাঁর কণ্ঠালঙ্কার। মুণ্ডিত মস্তক, মুখমণ্ডল শ্মশ্রুগুম্ফ রহিত। ধীর সুললিত কণ্ঠস্বরে সেই বৃষস্কন্ধ পুরুষ ঈশ্বরকে বলে চলেছেন, নীলপর্বত যদি লেখনীর কালি হয়, সমুদ্র মসীপাত্র, পারিজাত বৃক্ষশাখা কলম এবং এই সসাগরা মেদিনী লেখ্যাধাররূপে নিজেকে প্রকাশ করে আর এই সকল অপরূপ বস্তু দিয়ে যদি স্বয়ং বাগদেবী তোমার মহিমা-কথা লিখে চলেন তবুও হে শিবশম্ভূ তোমার অনন্ত অসীম গুণাবলী কখনও সমাপ্ত হবে না- লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং, তদপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি!
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : পরবর্তী শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।