
সে-কথার স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে ঈশ্বর বলেছিলেন, ‘লেট আস সি!’
ঋষাদের এড়োয়ালির বাড়িতে দেখা সেই স্বাভাবিক, উচ্ছল মানুষটি হঠাৎ যেন বদলে গেছেন। কোথায় সেই গল্প, সহজ আচরণ! পরিবর্তে এখন ঈশ্বর রাওকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি প্রায় যন্ত্রমানব, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও যিনি কখনও বলেন না।
বসার ঘরটি প্রায় নিরাভরণ, তিনটে সোফাসেট আর একটি ছোট কাঠের টেবিল ছাড়া অন্য কিছুই নেই। দেওয়ালে ঘড়ির কাঁটা বিষণ্ন সুরে চক্রবৎ গতিশীল। সামনে কাচের পাল্লা পার হয়ে একখানি প্রশস্ত বারান্দা। মনে হয় পশ্চিমদিক। ধুলো আর কুয়াশাচ্ছন্ন দিল্লির আকাশ বিবর্ণ। মাঝে মাঝে শিরশিরে হিম বাতাস ভেসে এলেও ঘর যথেষ্ট উষ্ণ। মাথার উপর একটা ফ্যান টিকিস টিকিস শব্দে ঘুরে চলেছে। টেবিলের উপর তিনখানি জলের বোতল রাখা। পাশে কতগুলো কাগজের গেলাস। বোতল থেকে আলগোছে জল খেয়ে পৃথ্বীশের হঠাৎ সিগারেট ধরানোর ইচ্ছে হল। পকেট থেকে প্যাকেট আর লাইটার বের করেও কী মনে হওয়ায় আবার রেখে দিল। অসহ্য ক্লান্তিকর প্রতিটি মুহূর্ত। সামনে বসে থাকা মানুষগুলোও আশ্চর্য নির্বিকার, কেমন পুতুলের মতো ভাবলেশহীন মুখে বসে রয়েছে। একজনের মুখের দিকে চেয়ে সামান্য হেসে পৃথ্বীশ বলল, ‘হাই, আই অ্যাম পৃথ্বীশ!’
সুঠাম স্বাস্থ্যের দীর্ঘদেহী মানুষটি কোনও উত্তর না দিয়ে নির্বিকার চেয়ে রইল!
আশ্চর্য, এখানে কথা বলাও নিষেধ নাকি! ফ্ল্যাটটিই বা কার? ঢোকার সময় নেমপ্লেটে দেখেছিল লেখা রয়েছে, মি. টি আগরওয়াল। তার মানে ব্যক্তিগত ফ্ল্যাট। কেনই বা এখানে নিয়ে এলেন রাও? এই লোকগুলিই বা কারা? নেটওয়ার্ক নেই অথচ তখন থেকে ফোন নিয়েই বা কী করছে?
অনেকগুলো প্রশ্ন পৃথ্বীশের মাথা ভারী করে রেখেছে। মোবাইলে যে কাউকে মেসেজ করবে সেই উপায়ও নেই। সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক বিহীন যন্ত্রটি এখন খেলনামাত্র। এখন সারা দেশেই অটো-রোমিং তাছাড়া এয়ারপোর্টে নেমে বন্যা আর ঋষা দুজনকেই মেসেজ করেছিল তখন দিব্যি কাজ করছিল ফোন। তাহলে কি এখানে কোনও জ্যামার বসানো রয়েছে?
অসহ্য নীরবতা কাটানোর জন্য বারান্দায় যাবে বলে উঠে দাঁড়াতেই পাশের লোকটি কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওয়াশরুম?’
এই প্রথম মানুষের গলার স্বর শুনে খুশিই হল পৃথ্বীশ। সৌজন্যের হাসি মুখে টেনে বারান্দার দিকে ইশারা করে বলল, ‘নো, অ্যাকচুয়ালি ওয়ান্ট টু গো দেয়ার!’
–দ্য প্লেস ইজ নট অ্যাকসেসেব্ল! প্লিজ সিট হিয়ার।
আরে, এ কী বন্দিদশা নাকি, বারান্দায় যেতে দেবে না!
ঈষৎ রুক্ষ কণ্ঠে পৃথ্বীশ বলল, ‘আই ওয়ান্ট টু স্মোক, সো’, পৃথ্বীশের কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটি একটি কাগজের গেলাস পৃথ্বীশের দিকে এগিয়ে দিয়ে নির্বিকার গলায় উত্তর দিল, ‘ইউ ক্যান স্মোক হিয়ার!’
অবাক হয়ে পৃথ্বীশ ভাবল, কাগজের গেলাস ছাইদানি হিসাবে এগিয়ে দিচ্ছে অথচ বারান্দায় যেতে দেবে না! এরা কি কারোর নির্দেশ পালন করছে?
ঈশ্বরই বা কোথায় গেলেন কে জানে! সেই যে এখানে পৌঁছে ওপাশের দরজা খুলে পাশের ঘরে চলে গেলেন তারপর একবারের জন্যও আর বাইরে আসেননি। দরজাটিও ভেতর থেকে বন্ধ। একবার কি দরজায় নক করবে?
পরক্ষণেই মনে হল এই লোকগুলি নিশ্চয় বাধা দেবে। উপায়ান্তর না দেখে সোফায় বসেই সিগারেট ধরাল পৃথ্বীশ। অল্প ক্ষিদেও পাচ্ছে কিন্তু সবার আগে এখান থেকে ছুটি পেয়ে মুক্ত জগতে যাওয়া দরকার।
সিগারেট ধরিয়ে প্রথমেই বন্যার কথা মনে পড়ল। কোথায় যে গেল মেয়েটা? খড়গপুর পৌঁছেই বন্যার হোস্টেলে ছুটেছিল পৃথ্বীশ। সেখানে ওয়ার্ড-সুপারভাইজারের মুখে শুনল দিন তিনেক আগে একটা ছোটো ব্যাগ নিয়ে সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নাকি বলে গেছে দিন-সাতেক পরে ফিরবে। তাহলে কি নিজের বাড়ি গেছে? কিন্তু একটা মেসেজ বা ফোনের রিপ্লাই দিচ্ছে না। এমন তো আগে কখনও করেনি। আজও অন্তত তিনবার ফোন করেছে। প্রতিবারই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বেজে উঠেছে একই কথায়, দ্য মোবাইল ইজ আউট অব কভারেজ এরিয়া।
কোনও বিপদ হল না তো? একবার পুলিশে জানালেই ভালো হত। কিন্তু খড়গপুর থেকে কলকাতা রওনা দেওয়ার আগেই পৃথ্বীশের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ঈশ্বর নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘রয়, এনিথিং সিরিয়াস?’
ইতস্তত করে উত্তর দিয়েছিল, ‘অ্যাকচুয়ালি মাই কলিগ, বন্যা, বন্যা রহমান ইজ মিসিং ফ্রম লাস্ট টু ডেজ!’
সামান্য বিস্মিত হয়েছিলেন ঈশ্বর, ‘মিসিং মিনস?’
সব কথা খুলে বলার পর শান্ত কণ্ঠে ঈশ্বর বলেছিলেন, ‘ডোন্ট ইনভলভ লোকাল পুলিশ। উই ডু নট হ্যাভ সাচ টাইম। হার মোবাইল ইজ ওয়ার্কিং, সো প্লিজ ডোন্ট ওয়ারি! লেট মি রিচ ডেলহি ফার্স্ট, দেন আই স্যাল ট্রেস হার।’
–বাট হাউ ইউ উইল ট্রেস হার?
প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে একটা অদ্ভুত কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন ঈশ্বর। ‘ডাস ঋষা নো হার?’
পৃথ্বীশ মুখ নীচু করে বলেছিল, ‘বন্যা নোজ হার!’হঠাৎ এখন পৃথ্বীশের মনে হল, ঈশ্বর কীভাবে ট্রেস করবেন! মোবাইল ট্রেস অবশ্যই করা যায় কিন্তু সে তো পুলিশের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব, তাহলে কি ঈশ্বর রাও কোনওভাবে স্পেশাল সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত?
পৃথ্বীশের চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে সহসা ঘণ্টি বেজে উঠল, পরপর তিনবার। মুহূর্তে চারজন উঠে দাঁড়িয়ে সদর দরজার দুপাশে দাঁড়াল, একজন আইহোলে চোখে রেখে দরজা খোলার আগে পৃথ্বীশ খেয়াল করল লোকটির ডানহাত কোমরের কাছে জামার তলায় কোনও বস্তু আলতো স্পর্শ করে রয়েছে। তিনজন কালো সাফারি স্যুট পরা মানুষ দ্রুতপায়ে ঘরের ভেতরে আসার পর তাদের পেছনে একজন সৌম্যদর্শন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় দরজায় পা দিলেন, তাঁকে দেখে ঘরের সবার অ্যাটেনশনের ভঙ্গিমায় পৃথ্বীশে ভারি অবাক হল, কে এই মানুষটি?
গৌরবর্ণ মানুষটির পরনে ছাই-রঙা সুতির প্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা জামা। কাঁচাপাকা চুল সযত্নে বিপরীত দিকে আঁচড়ানো, পরিষ্কার মুখমণ্ডলে তীক্ষ্ণ নাক আর ফিনফিনে পাতলা সোনালি চশমার পেছনে ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি দেখে বোঝ যায় প্রৌঢ় তীক্ষ্ণধী। সামনের একজনকে তিনি ঈষৎ ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাও কঁহা হ্যে?’
নির্লিপ্ত শীতল গলায় উত্তর ভেসে এল, ‘হি ইজ ইন মিটিং, স্যর!’
সহসা পৃথ্বীশের দিকে একবার তাকিয়েই আগের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হু ইজ হি?’
–কেম ফ্রম খড়গপুর আইআইটি স্যর, পৃথ্বীশ রয়।
লোকটি তার সম্পর্কে সবকথা জানে দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হল পৃথ্বীশ কিন্তু কোনও কথা চিন্তা করার পূর্বেই প্রৌঢ় মানুষটি তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে করমর্দনের জন্য ডান হাত বাড়িয়ে সামান্য হেসে বললেন, ‘ওয়েলকাম পৃথ্বীশ, আমি অনির্বাণ গাঙ্গুলি।’
কী বলবে বুঝতে না পেরে করমর্দন করে পৃথ্বীশ মৃদু হাসল।
–আমি জানি তোমাকে এখনও কেউ কিছুই বলেনি, রাও পি-এম-ও মিটিংয়ে রয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে ব্রিফ করবে।
আড়ষ্ঠ গলায় পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যর, এইটা কি কোনও অফিস?’
সোফার উল্টোদিকে একটি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ় মৃদু হেসে বললেন, ‘নো মাই সন, দিস ইজ আওয়ার সেফ হাউস!’
পৃথ্বীশ হতভম্বের মতো দেখল দ্রুত হাতে দরজার পাশের দেয়ালে একটি পাল্লা সরিয়ে ইলেকট্রনিক প্যানেলে কম্বিনেশন আঁকার মুহূর্তেই দরজাটি খুলে গেল, মুখ ফিরিয়ে পৃথ্বীশের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বললেন, ‘প্লিজ কাম!’
প্রশস্ত ঘরটি নরম কার্পেটে মোড়া। দেওয়াল জুড়ে নানাবিধ কম্পিউটার স্ক্রিন। একটি বড়ো অর্ধবৃত্তাকার টেবিলের উপর কতগুলি ল্যাপটপ এবং স্যাটেলাইট ফোন রাখা। টেবিলের ওপারে একটি উঁচু চেয়ারে বসে সামনের চেয়ারটি হাতের ইশারায় দেখিয়ে অনির্বাণ বললেন, ‘বসো।’
ল্যাপটপ খুলে অভ্যস্ত হাতে কিছু টাইপ করতেই দেওয়ালে সবগুলি স্ক্রিনে আলো ফুটে উঠল। প্রতিটি মনিটরে ভিন্ন ভিন্ন জায়গার ছবি। তার মধ্যে একেবারে বামদিকের স্ক্রিনের দিকে তর্জনি তুললেন অনির্বাণ, ‘লুক পৃথ্বীশ, এটিই নর্মদা তীরের মুণ্ড মহারণ্য। ঘন শ্বাপদসঙ্কুল এই অঞ্চলে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। তুমি মুণ্ড অরণ্যের কথা আগে কখনও শুনেছ?’
চকিতে বন্যার স্বপ্নের কথা মনে পড়ল পৃথ্বীশের। ঋষাও দেখেছিল বিচিত্র এক স্বপ্ন। পরিক্রমাবাসী দুজন সন্ন্যাসী মুণ্ড মহারণ্যের পথেই কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ছিল শ্যামানন্দ। আজ সকাল থেকে ক্রমাগত আকস্মিক ঘটনার অভিঘাত পৃথ্বীশের স্বাভাবিক যুক্তিবোধ এলোমেলো করে দিয়েছে। মৃদু স্বরে উত্তর দিল, ‘বইয়ে পড়েছি, কিন্তু আমি কিছুই ঠিক বুঝতে পারছি না!’
পাশে একটা ছোটো ক্যাবিনেট খুলে দুটি কাপ বের করলেন অনির্বাণ। তারপর ডানদিকে ছোটো টেবিলের উপর রাখা কফি-মেশিন থেকে কাপে কফি ঢেলে পৃথ্বীশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কফি খাও, তোমার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে রয়েছে!’
-আপনারা কি এ-এস-আইয়ের অফিসার?
মৃদু হাসলেন অনির্বাণ। ‘এ-এস-আই চিফ রাওয়ের সঙ্গে অন্য ঘরে পি এম-ও মিটিঙে রয়েছেন।’
-তাহলে আপনি? রাও স্যারই বা কে?
কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর মৃদু হেসে অনির্বাণ বললেন, ‘রাইট নাউ ইউ আর ডিলিং উইথ রিসার্চ এন্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং অব ইন্ডিয়া গর্ভমেন্ট।’
হতবাক পৃথ্বীশ অস্ফুটে জিজ্ঞাসা করল, ‘র?’
–লুক পৃথ্বীশ, ‘র’ সম্পর্কে অনেক মানুষের খুব ফিল্মি আইডিয়া থাকে, সেটি একেবারেই ঠিক নয়। কোনও গোপন প্রজেক্টে আমাদের ইনভলভমেন্ট থাকে নানাবিধ কারণে। এখানেও একটা বড়ো এক্সক্যাভেশন অপারেট করবে এ-এস-আই। আর পি-এম-ও চায় সমস্ত অপারেশন আমরা যেন মনিটর করি। দ্যাটস ইট! বাকি ডিটেলস তোমাকে এ-এস-আই চিফ মি. ভার্গব আর রাও বলবেন। প্রজেক্টে অন্যান্য টিম মেম্বারাও রয়েছেন, কিন্তু রাও সুপারিশ করেছেন তোমাকে বিশেষ কিছু দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। সেই কারণেই তোমাকে এই প্রাইভেট মিটিংয়ে আনা হয়েছে। তোমার ফোনও টোয়েন্টি ফোর আওয়ারস মনিটরে রয়েছে, ফলে কোনও পার্সোনাল স্পেসে বিষয়টি প্লিজ ডিসক্লোজ কোরো না। আশা করি তুমি প্রজেক্টের গোপনীয়তা বুঝতে পারছ।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে পৃথ্বীশ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ইয়েস স্যর, আমি প্রোটোকল ফলো করব।’
–গুড, ভেরি গুড! এনিথিং এলস ইউ নিড?
দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ঈষৎ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে পৃথ্বীশ বলল, ‘স্যর, এখানে আমার ফোন কাজ করছে না’। কথার মাঝেই হাত তুলে পৃথ্বীশকে থামিয়ে অনির্বাণ বললেন, ‘এখানে সিকিওরিটির কারণে জ্যামার লাগানো রয়েছে। নেটওয়ার্ক কাজ করবে না। বাড়ির কাউকে ইনফর্ম করার থাকলে বাইরে মি তেওয়ারি রয়েছেন, ইউ মে আস্ক হিম, হি উইল হেল্প ইউ।’
ফ্ল্যাটের মাঝে এত বড়ো কনফারেন্স রুম, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। পৃথ্বীশের ঘরে ঢুকে মনে হল আয়তনে অন্তত চারশো স্কোয়ার ফুট হবে। একখানি বিরাট সেন্টার টেবিলের উপর কোনও অরণ্যাঞ্চলের ম্যাপ বিছানো। দেওয়ালে প্রায় ষাট ইঞ্চি মনিটর-স্ক্রিনে আরেকটি ম্যাপ। পাবলিক ভয়েস অ্যাড্রেস সিস্টেম চালু রয়েছে। ঘরে কোথাও কোনও জানলা নেই। বুলেটপ্রুফ দরজা কম্বিনেশন লকড, সমস্ত শব্দ এখানে বন্দি, এই অত্যাধুনিক কনফারেন্স রুমটি সাউন্ড-প্রুফ।
লম্বা টেবিলের একেবারে মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঈশ্বর। পরনে একখানি সাদা গলফ টি-শার্ট আর ফেডেড ব্লু জিন্স, কানে ব্লু-টুথ ওয়্যারলেস হেডফোন। বামদিকে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, কৃষ্ণাঙ্গ, মাথাজোড়া টাক, পরনে আকাশি নীলরঙা কমপ্লিট স্যুট। টেবিলের ডানদিকে একজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চোখমুখ অত্যন্ত উজ্জ্বল। একমাথা সাদা চুল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা আর পরনে সুতির সাদা কুর্তা আর চুড়িদার।
অনির্বাণ আর পৃথ্বীশ ঘরে ঢুকতেই ঈশ্বর অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘অনির্বাণ, প্লিজ কাম!’
ঘরের বাকি দুজন সদস্যের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হাসলেন অনির্বাণ, ‘ইজ এভরিথিং রেডি?’
ঈশ্বর শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘অলমোস্ট স্যর, বিফোর প্রসিড প্লিজ লেট মি ইন্ট্রোডিউজ আওয়ার টিম মেম্বার মি. পৃথ্বীশ রয়।’
এই পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিং তো দূরস্থান, এর আগে কখনও কথা বলারও সুযোগ হয়নি পৃথ্বীশের। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে হাতের তালু ঘর্মাক্ত, জিভ সামান্য শুকনো। কোনওক্রমে সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘হ্যালো!’
বৃদ্ধ মানুষটি রসিক। ঈশ্বর প্রথাগতভাবে আলাপ করানোর আগেই সহাস্যে পৃথ্বীশকে বললেন, ‘হ্যালো ইয়ংম্যান, মাইসেলফ বালানন্দ পট্টনায়েক। আই হ্যাভ আ ভেরি লিটল নলেজ ইন মেটালার্জি। হোপ উই উইল এনজয় আওয়ার ওয়ার্ক টুগেদার!’
বৃদ্ধের কথা শুনে প্রায় হতভম্ব দশা পৃথ্বীশের। এইজন্য এতক্ষণ ওঁকে চেনা লাগছিল! মাই গড, ইনি ভাটনগর পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক বালানন্দ পট্টনায়েক! মেটালার্জির দিকপাল অধ্যাপকরা বলেন যেকোনও দিন এই তীক্ষ্ণধী বৃদ্ধ রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন!
সেই মানুষ কিনা অতি স্বাভাবিক সুরে বলছেন, সামান্য জানেন ধাতুবিদ্যা! এমনকি নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ অবধি বললেন না!
এঁর সঙ্গে কাজ করতে পারবে এই কথা ভেবেই পৃথ্বীশ ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠল। উত্তেজনা সামলে মুখে বলল, ‘স্যর, এভরিওয়ান নোজ ইউ ওয়েল। মাই রিসার্চ গাইড ড.দেশমুখ ওয়াজ ইয়োর স্টুডেন্ট। ইট ইজ মাই প্লেজার’… পৃথ্বীশের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলে বললেন, ‘আই নো ইউ আর ভেরি ব্রাইট, বাঙালি তো?’
বিস্মিত কণ্ঠে পৃথ্বীশের মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল, ‘আপনি… বাংলা, সরি ডু ইউ নো বেঙ্গলি, স্যর?’
মিটিমিটি হেসে প্রোফেসর পট্টনায়েক বললেন, ‘ইয়েস, আই ডু!’
টেবিলের বামদিকে কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক এ-এস-আইয়ের সর্বভারতীয় ডিরেক্টর, মি. প্রবীণ ভার্গবের সঙ্গে পৃথ্বীশের আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর দেওয়ালের মনিটরে ম্যাপের একটি নির্দিষ্ট স্থানে ইলেট্রনিক পয়েন্টার ফোকাস করলেন রাও। সবগুলি বাতি এখন নিভে গেছে। প্রায়ান্ধকার ঘরে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে শোনা গেল ঈশ্বরের গম্ভীর কণ্ঠস্বর- ‘দিস ইজ দ্য এরিয়া, টোয়েন্টি টু ফোর সিক্স নর্থ এন্ড এইট্টিওয়ান থ্রি টু ইস্ট, ডেন্স ফরেস্ট- নোন অ্যাজ মুণ্ড মহারণ্য। ফ্রম বিলাসপুর টু অমরকণ্টক, ডিসট্যান্স অ্যারাউন্ড সিক্সটি কিলোমিটার। ইট ইজ ওয়ান অব দ্য মোস্ট সেক্রেড রুট অব নর্মদা পরিক্রমা। উই উইল স্টার্ট আওয়ার জার্নি ফ্রম অমরকণ্টক। অ্যাজ পার প্রফেসর পট্টানায়েক’স টপ সিক্রেট রিপোর্ট দিস ডেন্স ফরেস্ট ইজ প্রিসার্ভিং ইউরেনিয়াম অ্যান্ড দ্য অ্যামাউন্ট মাইট বি মোর দ্যান ফিফটিন থাউজ্যান্ড টন! দ্যাট ইজ হিউজ। ইন ইন্টারন্যাশানাল মার্কেট, ভ্যালু অব ইউরেনিয়াম ইজ কোয়াইট হাই এন্ড ইফ উই রিয়েলি ফাউন্ড দিস ইউরেনিয়াম স্টোর, ইট উইল চেঞ্জ দ্য এনটায়ার ম্যাপ অব অ্যাটোমিক মিনারেলস অব নেশন! আওয়ার অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার এক্সপ্রেসড হিজ ইন্টারেস্ট অন দিস প্রজেক্ট। র উইল হেল্প আস উইথ এভরি বিট অব ইনফরমেশন এন্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট ইন্ডিয়ান আর্মি ইস রেডি টু হেল্প আস টু এক্সক্যাভেট দিস এরিয়া। বাট প্লিজ রিমেমবার আ নোট ফ্রম পি-এম-ও। দিস প্লেস ইজ হেভেন অফ এভরি সেক্রেড হিন্দু এন্ড মঙ্ক। সো আওয়ার এনি অ্যাকটিভিটি মাস্ট নট হার্ট দেয়ার রিলিজিয়াস বিলিফ। দিস ইজ দ্য স্ট্রিক্ট ইনস্ট্রাকশন ফ্রম অনারেবল পি-এম। রেস্ট অব আওয়ার টিম মেম্বারস উইল রিপোর্ট টুমরো, অ্যাট ফোরটিন আওয়ার্স শার্প, এ-এস-আই হেডকোয়ার্টার। উই উইল স্টার্ট আওয়ার জার্নি অন ডে আফটার টুমরো।
ওয়ান মোস্ট ক্রুশিয়াল পয়েন্ট, প্লিজ রিমেমবার, অনলি উই নো দ্য সিক্রেট অব অ্যাটোমিক মিনারেলস। রেস্ট অব আওয়ার টিম মেম্বারস নো দিস ইজ অ্যান আরকিওলজিক্যাল এক্সক্যাভেশন। এনি ডাউট?’
চুপ করে থাকবে ভেবেও পৃথ্বীশ নীরব থাকতে পারল না, মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যর, হোয়াট অ্যাবাউট দ্য ফরেস্ট? ওন্ট ইট ডেস্ট্রয় টোটাল ইকোলজি অব দ্যাট এরিয়া?’
পৃথ্বীশের প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত সকলেই চুপ করে থাকলেন। পাশ থেকে অনির্বাণ সামান্য রুক্ষ স্বরে বলে উঠলেন, ‘দ্যাট ইজ নট ইয়োর কনসার্ন। প্লিজ কনসেনট্রেট অন দ্য প্রজেক্ট।’
অন্যদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই অবাঞ্ছিত প্রশ্ন কেউই পছন্দ করেননি। শুধু বৃদ্ধ প্রফেসর বালানন্দ পট্টনায়েক ভারি খুশি হলেন। পৃথ্বীশকে মনে মনে আশীর্বাদ করে নিজেকেই নিঃশব্দে বললেন, ‘এই উজ্জ্বল হৃদয়বান যুবক মানুষের হাত থেকে সম্ভবত সুপ্রাচীন মুণ্ড মহারণ্যকে রক্ষা করতে পারবে। কৃপাময়ী দেবী নর্মদা নিশ্চয় সাহসী পৃথ্বীশের সহায় হবেন।’
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : পরবর্তী শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।