
প্রৌঢ় ভিমিসি দ্বিপ্রহরে ঘরের সামনে কচি বাঁশ দিয়ে ঘেরা উঠোনে বসে রয়েছে। কার্তিক মাস এখনও শেষ হয় নাই অথচ এর মধ্যেই রুক্ষ হয়ে উঠেছে চারপাশ। উত্তরপথগামী বাতাসে ভেসে আসছে জীর্ণ পাতার গান। অদূরে একটি প্রকাণ্ড আমলকি গাছের রিক্তপ্রায় ডালপালায় ঝিলিমিলি তুলেছে হেমন্ত-বিধুর রৌদ্র। নির্জন অরণ্যের দিকে আনমনে তাকিয়ে শালপাতার দোনা থেকে মহুয়ায় চুমুক দিল ভিমিসি। সে এই ফালার মুখি। ছয়টি ঘরের সবক’টিই নিজেদের লোক। দুই ছেলে বিয়া করেছে। তার নিজেরও তিন বউ। ছোটজন সিলা বাই ভারি সুন্দর। বাপের ঘর থেকে পাওয়া পেতলের বালা ডানপায়ে আর হাতভর্তি টিনের চুড়ি পরে যখন ঝুমুর ঝুমুর হেঁটে যায় তখন এই বুড়া বয়সেও প্রাণ আনচান করে ওঠে। মহুয়ার নেশায় চোখদুটি ইতিমধ্যেই লাল হয়ে উঠেছে। মৃদু হাসির রেখা ভিমিসির ঠোঁটে। ঘন শ্রাবণ মেঘের মতো নির্মেদ শালপ্রাংশু দেহ এই বয়সেও সুঠাম। পরনে একখানি খেটো ধুতি, পাশে ধূলিধূসর উঠানের উপর টাঙ্গি রাখা। ওটা ভিমিসির সর্বক্ষণের সঙ্গী, কখনও কাছছাড়া করে না। পুরোনো দিনের কথা মনে ভেসে আসছে। কী মনে হওয়ায় গুনগুন মৃদু সুরে একটি গান ধরল প্রৌঢ়- ‘হে-হে-হে লাম্বা লাসিয়া-এ-এ-এ, পকসি বানায়া-এ-এ-এ, লো-লো-লো, এ-এ-এ’… কথাগুলো অস্পষ্ট কিন্তু ঝিমঝিম সুরতরণী আলতো সোহাগির মতো বয়ে চলেছে। অদূরে কী একটা পাখি সেই গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যেন ডেকে উঠল। ভারি মিষ্টি শিসের মতো শব্দ। কয়েকটি মহুয়া পাতা উন্মনা বাতাসে খসে পড়ল ভিমিসির মাথায়। গানের মাঝেই তার মনে পড়ল একটি অপরূপ বাঁশির কথা। বড়ো প্রিয় বাঁশিটি। প্রায় দশ ক্রোশ উত্তরে চার পাঁচটি ফালা পার হয়ে এক পুরাতন গুহায় রাখা আছে ওই বাঁশি। সে পথের হদিশ কেউ জানে না। গুহায় রয়েছেন মহাদেও। ভিমিসি পুরনমসির রাতে তাঁকেই বাঁশি শোনায়। বিচিত্র সুরে ভেসে যায় বনতলী। জনহীন অরণ্য কাদের সমবেত নৃত্যে তখন উতলা হয়ে ওঠে! ভাগোরাদেব স্বয়ং যেন সেই অলীক নৃত্যের অধিপতি। আকাশ বৃক্ষ নদী অরণ্য আর সহস্র ধারার বৃষ্টিকে প্রণাম জানিয়ে ভিমিসি নিজেও মহুয়ার নেশায় দুলে দুলে নাচে। যতেক অশুভ দৃষ্টি সঙ্গে নিয়ে দূরে সরে যায় রুদ্রপিশাচ। আসলে ভিমিসি একজন বাদাভা। মাতাজি স্বয়ং তাকে আশীর্বাদ করে এই মহাশক্তি দিয়েছেন। তার বাঁশির সুরে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ছায়াপ্রেত চরাচর থেকে মুছে যায়। সে এক বিচিত্র ক্রিয়াযোগ। তবে ভিমসি জানে ওই বাঁশি আর দেবীর ইচ্ছা ব্যতীত সে কখনও বাদাভা হতে পারত না!
নর্মদা মাঈ’কে দর্শন করে বন্যা সুবিশাল মন্দির প্রাঙ্গণে এসে দেখল ঝলমলে রৌদ্রে জগৎ ভরে উঠেছে। কেউ এখানে তার জাত-পরিচয় জিজ্ঞাসা করেনি। শুধু মন্দিরের সামনে পূজার উপচার বিক্রেতা একজন মাঝবয়সী মানুষ আসার সময় অনুরোধের স্বরে বলেছিল, ‘মাঈজি পূজাকা সামান লে যাইয়ে!’
বন্যা মৃদু হেসে কোনও কথা না বলে মন্দিরে উঠে এসেছিল। তার মনে কোনও সংশয় নেই। অন্তরে সে যেন এখন সত্যিই একজন পরিক্রমাবাসী। শুধু ক্ষণিকের জন্য একবার মনোপটচিত্রে ভেসে উঠেছিল একটি পুরাতন কালেমা, যার মাধ্যমে শাহাদাত দৃঢ় হয়- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোনও সত্য মাবুদ নাই! কেন যে বন্যার মনে হয়েছিল এ কথা কে জানে! হয়তো সংস্কার! মনের তল পাওয়া তো অত সহজ নয়। তবে মন্দিরে নর্মদা-কুণ্ডে কৃষ্ণবর্ণা দেবীপ্রতিমা দর্শনের পর এক অপরূপ আনন্দস্রোত অন্তরমহলে বেজে উঠেছে। কত মানুষ অন্তরের ভক্তি শ্রদ্ধা অবলম্বন করে কোন দূর দেশ থেকে এখানে ছুটে এসেছেন! শ্বেতহংসের মতো ধবল মন্দির প্রাঙ্গণে কত সন্ন্যাসী! কেউ রক্তাম্বর পরিহিত, কারোও পরনে আবার শুভ্রবসন। কপালে গিরিমাটির তিলক টানা গেরুয়া বসন সন্ন্যাসীও রয়েছেন। প্রায় সবার মুখে ‘নর্মদা হরে’ জয়ধ্বনি। অদূরে ছোটো বড়ো নানাবিধ মন্দির। বন্যার সহসা মনে হল, ধর্মবোধই হয়তো এই বিচিত্র ভারতভূমিকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। নাহলে কারোও সঙ্গে কারোও তেমন মিল তো নেই! কোথায় সে এসেছে শ্যামাঙ্গী বঙ্গদেশ থেকে, আর ওই যে সাদা ধুতি একফেরতা করে পরা বয়স্ক মানুষটি, পরনে সাদা ফুলহাতা জামা, কপালে শ্বেতচন্দন, তিনি নিশ্চয়ই দক্ষিণদেশের মানুষ! ভাষা, আচার, খাদ্যাভ্যাস সবই পৃথক, অথচ তারা দুজনেই ভারতবাসী। এ কোন ভারতবর্ষ? ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ বললে তো শুধু হবে না, বুঝতে হবে কী সেই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা যার কারণে দুজন মানুষই তার মাতৃভূমির সন্তান বলে মনে করে নিজেদের! ধর্ম। হ্যাঁ, এই সুবিশাল প্রাচীন নর্মদাতীরস্থ শিবক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বন্যা বুঝতে পারল, ধর্মই সবাইকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে! ধর্ম মানে জাত নয়। তাই যদি হত তাহলে মুসলিম হয়েও সে কেন এল এখানে?
নিজের অজান্তেই বন্যার মুখখানি অশ্রুমতী হয়ে উঠল। আহা, ওই যে পুণ্যসলিলা নর্মদা। দূরে বনছায়াবৃতা শৈলরাজি, নিঃসীম নীলাকাশ, মন্দ মন্দ হেমন্ত বাতাস- এসবই তার নিজের। স্নেহময়ীর আঁচলের মতো কোন ইতিহাস-বিস্মৃত যুগ হতে তার সন্তানদের রক্ষা করে চলেছে। অরূপ ভারতবর্ষকে সম্ভবত এই প্রথম মনে মনে প্রণাম করল বন্যা- প্রিয়ং ভারতং তৎ সদা শ্লাঘনীয়ম্!
‘মাঈজি, আপ মাঈ-কি-বাগিয়া নেহি যাওগি?’, অচেনা কণ্ঠস্বরে বন্যার সংবিৎ ফিরে এল।
পদ্মপাতায় টলোমলো জলবিন্দুর মতো দুই চোখে অস্ফুট অশ্রু নিয়ে মুখ তুলে দেখল একজন কিশোরী সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তেরো কি চোদ্দ বছর হবে বয়স! পরনে একখানি আসমানি ঘাঘড়া ও চোলি। ঈষৎ রুক্ষ কেশরাজি বেণীবন্ধনে আবৃত। ডিম্বাকৃতি মুখখানি ভারি মধুর। জল-থইথই আকাশের মতো চোখ কৌতুক হাস্যে উজ্জ্বল। সামান্য বিস্মিত কণ্ঠে বন্যা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুম কৌন্ হো?’
রিনিঝিনি সুরে বেজে উঠল কিশোরী, ‘মেরি নাম রেবা। মুঝে অবধূতজি নে আপকি পাস ভেজা হ্যে! উনোনে কহা, মাঈজিকো সবকুছ অচ্ছা সে দিখানা!’
অবাকই হল বন্যা। কই সকালে আশ্রম থেকে আসার সময় মনোহরদাস মহারাজ তো কিছু বললেন না! তাহলে আবার এই কিশোরীকে পাঠানোর কী প্রয়োজন হল! বন্যার মনোভাব সম্ভবত আন্দাজ করেই রেবা বলল, ‘আপ ইঁহাপে নয়ি আয়ি হো, স্যয়দ ইসি লিয়ে অবধূতজি নে মুঝে ভেজ দিয়া!’, একমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর নির্ভার বাতাসের মতো মধুর হাসি মুখে টেনে পুনরায় বলল, ‘চলিয়ে মাঈজি, কপিলধারা, দুধধারা, কপিল মুনি কা আশ্রম, মাঈ-কি-বাগিয়া, সবকুছ আপকো দিখায়ুঙ্গি!’
কিশোরীর প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর ভারী ভালো লাগল বন্যার। মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্যয়া তুম আশ্রম মে রহ্যেতি হ্যো?’
–নেহি মাঈজি, মেরা ঘর এঁহিপে হ্যে! অবধূতজি মুঝে বেটি বুলাতে হ্যে, ইসি লিয়ে আশ্রমমে হামেশা আতি হ্যু! আপ কাল আয়ি হ্যে না?’
–হাঁ রেবা, ম্যে কাল আয়ি হ্যুঁ! আচ্ছা, এক বাত মুঝে বতাও, মাঈ-কি-বাগিয়া ক্যয়া পয়দল যা সাকতি হু?
উচ্ছল স্রোতধারার মতোই আনন্দে ভরে উঠল রেবার স্বর। ‘হাঁ মাঈজি কিঁউ নেহি, য্যাদা দূর তো নহি হ্যে! উপরসে আজ মওসম ভি বহুত অচ্ছা হ্যে। চলিয়ে না মেরে সাথ, তুরন্ত পৌঁছ যাউঙ্গি!’পথ খুব কম নয়। মন্দির থেকে প্রায় সাত-আট কিলোমিটার দূরে দুধধারা। ক্রমশ দোকান-বাজার, মানুষের ভিড় কমে এল। ঝিমঝিম রৌদ্রে পথের দুপাশে সারি সারি গাছপালা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে অরণ্যের আভাস যেন ফুটে উঠছে চোখে। ডানদিকে পাইন গাছের মিছিল দেখে বিস্মিত হল বন্যা। আগে এদিকে আম, আমলকি, শাল, সাজি চোখে পড়লেও পাইন কখনও দেখেনি। কতগুলো হনুমান লাফ দিয়ে শীর্ণা পথ পার হয়ে ওইপারে চলে যেতেই সহসা পথটি ছায়াচ্ছন্ন হয়ে গেল। একখণ্ড মেঘ এসে সূর্যের মুখে যেন মায়া-আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে! রেবা আঙুলের ইশারায় দূর শৈলরাজির সানুদেশে অরণ্যাবৃত ভূমি দেখিয়ে বলল, ‘দেখিয়ে মাঈজি, ইসতরফ অচানকমার হ্যে!’
বন্যা অবাক গলায় শুধোল, ‘অচানকমার রিজার্ভ ফরেস্ট?’
–হাঁ, ঔর উসকা পার কান্হা!
–কানহা টাইগার রিজার্ভ?
বন্যার গলায় ছেলেমানুষি উত্তেজনা দেখে হেসে ফেলল রেবা, ‘হাঁ মাঈজি, উঁহা শের হ্যে!’
–ইধর নেহি আতা?
–নেহি মাঈজি। লেকিন দাদা কে মু সে শুনা, প্যহলে ইসব জয়্গা পুরা জঙ্গল থা, পরিক্রমবাসী সাধু বিনা কোই নেহি আতা। তব শের ভালু ভি থা। লেকিন ক্যয়া হ্যে সাধুলোগোকা কভি কুছ নহি হুয়া! এহি নর্মদা মাঈ অর শিউজি কা চমৎকার হ্যে!
মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ঈষৎ আনমনা গলায় বন্যা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমহরা দাদাজিকে মু সে বহুত কুছ শুনি হ্যো, হ্যে না?’
–ওহ্ তো শুনি হ্যে!
নর্মদার ব্রিজে না উঠে ডানদিকে একটি অপ্রশস্ত পথ বেছে নিল রেবা। উন্মনা মাটির পথ ঢালু হয়ে যেন সহসা গহিন অরণ্যে হারিয়ে গেছে। দুপাশে সারিবন্দি শাল আর সাজি গাছ। দুটো সুঠাম যুবক শালের মাঝে একটা সাজি, কালোর মাঝে বিবর্ণ ধূসর। পরম যত্নে কেউ যেন সাজিয়ে দিয়েছে পথটি! কী একটা পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে চলেছে! আলো-ছায়ার এক্কাদোক্কা ছককাটা পথ। রৌদ্র আবার তার ঝিকমিকি কিরণে উজ্জ্বল করে তুলেছে চরাচর। রেবাকে অনুসরণ করে পথ চলার সময় কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল বন্যা, তারপর মৃদু স্বরে পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘রেবা, দাদাজি সে এক বাত পুছ সকতি হো?’
পথ চলা থামিয়ে পেছন ফিরে বন্যার মুখপানে চেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বেজে উঠল রেবা, ‘ক্যনসি বাত মাঈজি?’
এক মুহূর্তের জন্য সামান্য ইতস্তত দেখাল বন্যাকে, ‘ক্যয়া ওহ্ব শ্যাম তালুকদার নাম কি কিসি সাধুকো জানতে হ্যে?’
পথের পাশে একটি বুনো ঝোপ থেকে বেগনি-রঙা ফুল আনমনে ছিঁড়ে হাতে নিয়ে রেবা শুধোল, ‘সাধুজি দিখ্নে মে ক্যায়সা হ্যে?’
‘ভেরি আনইম্প্রেসিভ’, অভ্যাসবশে কথাটি বলেই বন্যা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, ‘কুছ খাস নেহি। স্রিফ আঁখে হি বহুত কুছ বোলতি হ্যে!’
‘আঁখে!’ নিজের মনে শব্দটি দু-বার উচ্চারণ করে মৃদু হাসল রেবা, ‘ম্যে দাদাজি সে পুছকর আপকো বতায়ুঙ্গি!’
আরও প্রায় তিরিশ মিনিট পথ চলার পর ঘন অরণ্যের মধ্য থেকে ভেসে আসা একটানা ডম্বরুনাদের মতো মেঘগম্ভীর শব্দ শুনতে পেয়ে বন্যা বুঝতে পারল, নিশ্চয়ই সামনে কোনও জলপ্রপাত রয়েছে! মনে হয় এটিই নর্মদার প্রথম প্রপাত কপিলধারা! এখানে অরণ্য আরও গভীর। বুনো ঝোপ প্রায় পথরোধ করেছে। কেশবতীর ক্ষীণ সিঁথির মতো শীর্ণা সুঁড়িপথ বেশ ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। চারপাশ অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ। জলধারার শব্দের সঙ্গে গুনগুন করে আরও একটি বিচিত্র ধ্বনি ভেসে আসছে। যেন অনেকগুলো ছোটো ব্যাটারি-চালিত হাতপাখা চলছে। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রেবা বলল, ‘মাঈজি সামহালকে! পাহাড়কি মঁক্ষিয়া ইঁহা বহোত পরেশান করতি হ্যে!’
বন্যা প্রায় চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘মঁক্ষিয়া?’
অদূরে বনদফতরের একটি সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে রেবা সামান্য হেসে বলল, ‘হাঁ, দেখিয়ে না, লিখা হ্যে!’
বন্যা সাইনবোর্ডটি ভালো করে খেয়াল করল। সত্যিই তো! ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় লেখা রয়েছে মৌমাছিদের কথা। পাহাড়ি মৌমাছি কামড়ালে আর দেখতে হবে না। সাইনবোর্ডে এইজন্যই এখানে কোনও সুগন্ধি না-মেখে আসতে বলা হয়েছে! এমনকি মৌমাছির কামড়ের পর কী করা উচিত, সে-কথাও সবিস্তারে ছবিসহ বর্ণনা করা রয়েছে।
এতকিছু দেখে বন্যা সামান্য চিন্তিত স্বরেই জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্যেয়া ইয়ে সচ্ মে কাটতি হ্যে?’
বালিকার মতো বন্যার সরল আশঙ্কা দেখে হাসি আটকাতে পারল না রেবা। স্নেহময়ী জননীর মতো আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলল ‘কুছ নেহি হোগা! আপ মেরে সাথ আইয়ে!’
এই ঘটনার থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে দিল্লি শহরে আরেকটি ঘটনা ঠিক তখনই বয়ে চলছিল, তাদের অভিমুখ এক হলেও উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বেলা প্রায় একটা বেজে কুড়ি মিনিট, দিল্লির বিখ্যাত কুয়াশা আজ তেমন গাঢ় না-হলেও রৌদ্র এখনও ম্রিয়মান। ইন্দিরা গান্ধি জাতীয় বিমানবন্দরের একটি নির্দিষ্ট সংরক্ষিত স্থানে বাইশ জনের টিম দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমস্ত স্থানটি কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ঘিরে রেখেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। দূর থেকে দীর্ঘদেহী ঈশ্বর রাওকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। পরনে জংলা ছাপ চোস্ত প্যান্ট আর সাদা হাফহাতা জামার উপর চামড়ার পাতলা জ্যাকেটের সামনের চেন খোলা। পায়ে গোড়ালি অবধি ঢাকা কালো ভারী বুটজুতো। মাথায় একখানি কালো গলফ্ হ্যাট, চোখে আয়তকার রোদ-চশমা, জামার নীচে গোপন হোলস্টারের দুদিকে দুটি এম অ্যান্ড পি শিল্ড লাইটওয়েট কনসিলড পিস্তল রয়েছে। দুটোই লোডেড। সাতটি কার্তুজ ম্যাগাজিনে আর একটি ব্যারেলে। গলা তুলে প্রায় সেনাবাহিনীর পদস্থ কমান্ডারের মতো বজ্রকঠিন স্বরে ঈশ্বর বললেন, ‘ওয়েল, উই উইল স্টার্ট অ্যাট সার্প থার্টিন ফিফটি আওয়ারস, উই হ্যাভ ফোর এমআই-সেভেনটিন-ভি-ফাইব আর্মি চপারস! আওয়ার ডেস্টিনেশন ইজ আমারকণ্টক।
স্বল্প সময়ের টিম মিটিং-এর পরে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথাবার্তার শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর মি. পটবর্ধন ঈশ্বরের কাছে এগিয়ে এসে করমর্দন করে সামান্য হেসে বললেন, ‘বেস্ট অব লাক মি. রাও! পি-এম-ও হ্যাজ কমপ্লিট ফেইথ অন ইউ। হোপ ইউ উইল বি এবল টু ফুলফিল ইট!’
গলফ-হ্যাটটি একবার হাত দিয়ে মাথায় ভালোভাবে সেট করে দৃঢ় প্রত্যয়ী কণ্ঠে রাও বললেন, ‘আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট!’
–ফাইন, ইন্টিলিজেন্স উইল হেল্প ইউ অ্যান্ড আওয়ার বয়েজ আর দেয়ার, অ্যাট এনি প্রবলেম প্লিজ ফোন মি িডিরেক্টলি!
সামান্য হাসলেন রাও, ‘ইয়েস, আই স্যাল ইনফর্ম পি-এম-ও। মি. যোশি ইজ দেয়ার।’
দুজনের শব্দগুলি এবার বাতাসে ভেসে যেতে শুরু করেছে, এম-আই-সেভেনটিন চপারের ব্লেড চালু হয়েছে। রাওয়ের কথা শুনে সামান্য বিস্মিত হলেন পটবর্ধন। যোশি এই মুহূর্তে দিল্লি সাউথ ব্লকের প্রব্যাবলি মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পার্সন, মনের ভাব বুঝতে না দিয়ে পেশাদারি ভঙ্গিমায় গলা তুলে পটবর্ধন বললেন, ‘ওয়েল, প্লিজ ডু দ্যাট!’
‘শিওর’, কপ্টারের ঘূর্ণায়মান পাখার যান্ত্রিক শব্দ ভেদ করে স্মিত হেসে উঁচু গলায় বললেন রাও।
সহসা ঈশ্বরের জামার পকেটে রাখা একটি ক্ষুদ্র যন্ত্র দুবার বেজে উঠেই চুপ করে গেল। দ্রুত হাতে পকেট থেকে যন্ত্রটি বের করে দেখলেন, নীল স্ক্রিনে একটি মাত্র বাক্য ফুটে উঠেছে– মাউস ট্র্যাপড ইন রোড!
এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে অভ্যস্ত আঙুলে ওই যন্ত্র মারফৎ একটি বাক্য লিখে পাঠালেন ঈশ্বর, ইফ নট এলিমিনেটেড, কিপ ক্লোজ আইজ অন মাউস।
দেশের পূর্বপ্রান্তে কলকাতার উডল্যান্ড নার্সিংহোমের অপারেশন থিয়েটারে সেই মুহূর্তে প্রবেশ করলেন বিখ্যাত সার্জন ড. প্রণবেশ হাজরা ও তার সঙ্গী চারজন চিকিৎসকের একটি দল। পেশেন্ট’স কন্ডিশন ইজ ভেরি মাচ ক্রিটিক্যাল, মাল্টিপল ইনজুরিস ইন অ্যাকসিডেন্ট, মেইনলি লাং এন্ড কিডনি। থিয়েটারের দরজা বন্ধ হতেই দ্বিধান্বিত মানুষের অন্তিম আশার মতো জ্বলে উঠল লাল আলো। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মহেশ্বরবাবু। তাঁর পরিচিত আরও দু-একজন মানুষও এসেছেন। শুধু অচেতন ঋষা অপারেশন টেবিলের উজ্জ্বল আলোর নীচে শুয়ে জানতেও পারল না, গোপনে এই অভিজাত হসপিটালের লবিতে বসে রয়েছে একজন যুবক, সাত্যকি। আর তাকে নজরবন্দি করে রেখেছে আরও এক তরুণ, পরনে খুব সাধারণ জামা ও প্যান্ট, এক পলক দেখলে ভিড়ে মিশে যাওয়া মানুষ বলেই ভ্রম হয়। তরুণের নাম রোশন শর্মা। তার পরিচিত মানুষেরা বলে, সে নাকি মানুষখেকো চিতার থেকেও ধূর্ত! এই কারণেই হয়তো রোশনকে ‘প্যান্থার’ বলে ডাকা হয়!
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : পরবর্তী শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।