
একবার, দুবার, তিনবার… পাড়ার বিবর্ণ মাঠটিকে কুড়িবার প্রদক্ষিণের পর কব্জিতে বাঁধা খুদে যন্ত্রটির দিকে তাকাল সাত্যকি। লাল আলোয় জ্বলজ্বল করছে কতগুলি সংখ্যা, সাড়ে নয় কিলোমিটার, সাতান্ন মিনিট, পালস্ রেট একশো কুড়ি… নাহ, মাথা নেড়ে নিজেকেই যেন অস্ফুটে কথাটি শোনাল যুবক সাত্যকি চক্রবর্তী। দীর্ঘকায় নির্মেদ শরীর, পরনের ছাইরঙা ট্র্যাকস্যুট মিহি তুলোর মতো ঘামে ভিজে উঠেছে, মাথায় এলোমেলো চুল, সুস্পষ্ট চোয়াল, তীক্ষ্ণ নাক আর আপাত-গম্ভীর চোখদুটি দূর কোনও জগতের ছায়ায় ঈষৎ চঞ্চল। কার্তিকের ক্ষীণতনু কুয়াশা ও রৌদ্রে এখনও জগতের ঘুম ভাঙে নাই। সেই কুসুম আলোয় যুবকের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় তার মন কোনও কারণে আজ উতলা হয়ে রয়েছে।
কলকাতার দক্ষিণে এইসব আধো তন্দ্রাচ্ছন্ন অভিজাত পাড়ার ঘুম ভাঙে একটু বেলায়। প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। অদূরেই লেক। হেমন্তের গাছপালায় ঘেরা পাড়াটি আধফোটা ফুলের মতো ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর সরিয়ে শিশুর চোখে চেয়ে রয়েছে। দু-একজন প্রৌঢ় মানুষ পার্কে অলস পায়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। অল্পবয়সী ছিপছিপে এক তরুণী হরিণীর মতো চপল ভঙ্গিমায় পার্কটিকে প্রদক্ষিণ করছে। প্রতিদিনই তরুণীকে দেখে সাত্যকি, দু-একটি সৌজন্যসূচক আলগা কথাও বলে। আজও দৌড়ের মাঝে সাত্যকির দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল। প্রত্যুত্তরে সাত্যকির মুখেও হাসির রেখা ক্ষণিকের জন্য ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ডানহাতটি তুলে নাড়িয়ে বেঞ্চের উপর বসে তরুণীর ছন্দোময় দৌড়পথের দিকে তাকিয়ে সাত্যকির হঠাৎ মনে হল, নির্ভার ঝরা পাতার মতো বাতাসে যেন ভাসছে মেয়েটি! এমনভাবে সে নিজে কখনও দৌড়তে পারে না। তার মাথার ভেতর সর্বক্ষণ টিকটিক করে কতগুলি সংখ্যা, মিটার আর মিনিট, প্রতিদিনই পূর্বের সংখ্যা ও নিজেকে অতিক্রম করার আপ্রাণ চেষ্টায় এই দৌড়ের আনন্দটুকুই যেন সে বিস্মৃত হয়েছে!
পরেরবার সাত্যকিকে অতিক্রম করার সময় তরুণী গতি সামান্য কমিয়ে উঁচু নীচু শ্বাসবায়ুর মাঝেই হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কমপ্লিট?’
সাত্যকি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই মেয়েটি বলল, ‘নাউ স্টার্ট এগেইন উইথ মি!’
স্নিকারের ফিতে শক্ত করে বেঁধে তরুণীকে অনুসরণ করল সাত্যকি। একবার, দুবার… তৃতীয়বার মাঠ পরিক্রমার সময় প্রায় মেয়েটির পাশে থাকায় হেসে জিজ্ঞাসা করল,’ক’রাউন্ড চলছে?’
আলতো হাসল তরুণী, ‘ডোন্নো! হোয়াই আর ইউ অলওয়েজ স্টিক উইথ নাম্বারস?’
–বিকজ, নাম্বারস আর ইম্পর্টেন্ট!
উত্তরপথগামী বাতাসের মতো নিজেকে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে গলা তুলে কৌতুকের সুরে তরুণী বলল, ‘নো, দে আর নট!’
সামান্য উঁচু গলায় সাত্যকি পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘দেন, হোয়াট?’
‘নাথিং, ফলো মি! ইটস আ জয়!’, দূর দেশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে উত্তর দিল দৌড়রতা তরুণী!
হঠাৎ চিন্তার ছায়াছবি মুছে আপনমনেই হাসল সাত্যকি। এভাবে সংলাপ-দৃশ্য রচনা তার বহু পুরাতন অভ্যাস। মেয়েটির সঙ্গে গত ছ’মাসে এক-দুবার আলগা কথা ছাড়া তেমন পরিচয়ও হয়নি। কিন্তু সে-কারণে কল্পদৃশ্য রচনায় কোনও বাধা নাই! সাত-আট মাস আগে এই পাড়ায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে সাত্যকি। ঠিক বাড়ি নয়, দশ রাজপুতের বারো হাঁড়ির মতো দুই কামরার ফ্ল্যাট। অভিজাত পাড়ায় ফ্ল্যাটে কেউ কাউকে বড়ো একটা চেনে না। লোকজনও আলাপে বিশেষ উৎসাহী নয়। মেয়েটি সম্ভবত সাঁতারু। অদূরে বিখ্যাত সুইমিং ক্লাব থেকে দু-একবার বেলার দিকে বেরোতে দেখেছে। তবে ভোরবেলায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। দেখা যখন হয় তখন মনে মনে কথা বলায় কারোও আপত্তি থাকার কথা নয়!
ফোন বেজে ওঠায় ট্র্যাকস্যুটের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কানে দিতেই ওপ্রান্ত থেকে একটি ভারী পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আর ইউ রেডি?’
–ইয়েস!
–কার উইল বি দেয়ার অ্যাট শার্প নাইন-জিরো-জিরো আওয়ার্স!
–ওকে!
ফোন রেখে দেওয়ার আগে অজ্ঞারপরিচয় পুরুষকণ্ঠ ধীর স্বরে বলল, ‘ডোন্ট বি ওভার ইনকুইজিটিভ। বিহেভ নরম্যালি, জাস্ট লাইক আ টুরিস্ট।’
–সিওর।
ফোন রেখে মণিবন্ধের যন্ত্রটির দিকে তাকাল সাত্যকি। এটি ঘড়িরও কাজ করে। সাতটা বেজে দশ মিনিট। চোখ বন্ধ করে মনে মনে হিসাব করল, স্নান আর ওটস-কলা-দুধ মিশিয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য চল্লিশ মিনিট, জামাকাপড় পরতে আরও দশ, মানে পঞ্চাশ মিনিট, এখান থেকে ফ্ল্যাট সাড়ে সাত মিনিটের পথ, অর্থাৎ সব শেষ করার পরেও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় হাতে বেঁচে থাকবে! নিশ্চিন্ত হল সাত্যকি। তাহলে আরও কিছুক্ষণ, অন্তত মিনিট কুড়ি এখানে বসা যাবে! সাত্যকি ক্রমশ ভাবনার এক আশ্চর্য ভুবনে ভেসে গেল। সংখ্যা আমার ভারি প্রিয়। নাম্বারস, বন্ধুর মতো পাশে থাকে সর্বদা। মানুষের মন যেমন চঞ্চল, বিচিত্র, তেমন নয় সংখ্যারা। শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈনিকের মতো তাদের আচরণ। কখনও মিথ্যা বলে না, সত্যও বলে না, সর্বদা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে, আহ! কী শান্তি! তবে সবসময় কি তারা তেমনই? নাহ! মৌলিক মানে প্রাইম নাম্বার্সরা বেশ খামখেয়ালি। যেমন, দুইয়ের থেকে বড়ো যে কোনও পূর্ণ সংখ্যা আসলে দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল, কিন্তু আশ্চর্য বিষয় এই আপাত সরল সমীকরণটি আজ অবধি প্রমাণ করা যায়নি! সেই সতেরোশো বিয়াল্লিশ সালে অয়লারকে লেখা একটি চিঠিতে গোল্ডবাখ এই সমীকরণের কথা লিখেছিলেন। সেই সময় অবশ্য ওঁরা ১ সংখ্যাটিকে মৌলিক বলেই মনে করতেন। এমন আরও কিছু আশ্চর্য বিষয় রয়েছে, যেমন, তিন ও চারের বর্গের যোগফল পাঁচের বর্গের সমান। কিন্তু জগতে এমন তিনটি কোনও সংখ্যা নাই যাদের প্রথম দুটির কিউবের যোগফল তৃতীয় সংখ্যার কিউবের সমান!
কেন এমন হয়? সাত্যকি নিজের মনেই হাসল। সেই ইস্কুলের দশম ক্লাসে পড়ার সময় এই সমস্যার কথা তার মাথায় এসেছিল। গণিত শিক্ষক রমাপদবাবুকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি সামান্য বিরক্ত হয়েই উল্টে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘থিয়োরেমের এক্সট্রাগুলো করেছিস?’, তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর ক্লাসঘরের সামনে অস্ত আলোয় ভেসে যাওয়া বারান্দার দিকে তাকিয়ে আনমনা স্বরে বলেছিলেন, ‘সামনে মাধ্যমিক, এসব অদ্ভুত জিনিস মাথায় না ঢুকিয়ে আগে সিলেবাস শেষ কর!’
তবে প্রশ্নটি মাথায় রয়েই গেছিল। অনেক পরে জানতে পারে, ওই সমস্যা মোটেই কোনও সাধারণ প্রশ্ন ছিল না। বিখ্যাত সমস্যাটির পোশাকি নাম ‘ফার্মাস লাস্ট থিয়োরেম’ বা ‘এফ-এল-টি’; xn +yn=zn, where n>2 and x,y,z are positive integers, বড়ো শান্তি এই সংখ্যা ভুবনে। মানুষের মতো তারা অকৃতজ্ঞও নয়!আচ্ছা ওই তরুণীর নাম কী? মৌলিকা? ভালো নয় নামটি? নিজের প্রশ্নের উত্তরে নিজেই খুশি হল সাত্যকি। বেশ নাম, মৌলিকা! মৌলিকার পরনেও ট্র্যাকস্যুট, চুলগুলো আঁটো করে মাথার উপর বাঁধা, ঈষৎ ডিম্বাকৃতি মুখে চিবুকের ডৌলটি ভারি অপরূপ, চোখদুটো সামান্য বাদামি। দৌড় শেষ করে ফিরে যাওয়ার পথে সাত্যকির কাছে এসে নীচু স্বরে বলল, ‘ইউ আর ভেরি লেজি!’
–নো, আই অ্যাম নট!
–ইয়েস, ইউ আর!
–নো, নট অ্যাট-অল!
হাসল মৌলিকা, ‘ইজ ইট? দেন টুডে হোয়াই ইউ আর এন্ডেড উইথ অনলি টুয়েন্টি রাউন্ডস? ইট সিমস্ টু বি থার্টি, রাইট?’
–ওহ! প্লিজ স্টপ নাউ! দৌড় ছাড়াও আমাকে সারাদিনে ফ্রি-হ্যান্ড কমব্যাট ট্রেনিং প্র্যাকটিস করতে হয়। এছাড়াও বেসিক কমব্যাট ট্রেনিং রয়েছে! আপনি সেমি-অটোম্যাটিক পিস্তল গ্লক চালাতে পারেন? আই অ্যাম সিওর, পারেন না! আমার নিশানা কিন্তু অভ্রান্ত, দশবারে দশবারই আই ক্যান হিট বুলস্ আই!
–গ্লক? ওহ, মাই গড! আর ইউ সোলজার? আই থিঙ্ক ইউ আর ভেরি প্রিটেনশাস!
–ইয়েস, আই অ্যাম! দ্যাট ইজ নেচার অব মাই জব! ইউ ওন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড!
–সো ফিল্মি! ইউ নো, ইট সাউন্ডস লাইক আ ভেরি চিপ থার্ড গ্রেডেড ইংলিশ থ্রিলার!
–ইউ মে থিংক! বাট টেল মি ওয়ান থিঙ্ক, হোয়াই আর ইউ টকিং উইথ মি? ডোন্ট ইউ থিংক, ইট ইজ অলসো ভেরি ফিল্মি?
চিন্তাজাল ছিন্ন করে মণিবন্ধের যন্ত্রটি কেঠো সুরে বেজে উঠল। চকিতে সেটির দিকে তাকাল সাত্যকি। আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। হুঁ, এবার যেতে হবে। ঘড়ির কাঁটা বা সময় তাকে শার্দূলের মতো তাড়া করছে। উঠে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে একবার তাকাল। দু-চারজন মানুষ মন্থর পায়ে হাঁটছে। নির্মেঘ আকাশতলে মধুর কবোষ্ণ রৌদ্রে ভেসে যাচ্ছে চরাচর। শিমশিম বাতাস অনাম্নী নর্তকীর নূপুর-শব্দে বইছে ভুবনডাঙায়। শুধু ওই তরুণী কোথাও নেই। হয়তো সাত্যকির চোখের সামনে দিয়েই মৌলিকা ফিরে গেছে। নিজের আচরণে অসন্তুষ্ট সাত্যকি নিজেকে মৃদু শাসন করল- এত অন্যমনস্ক হলে কীভাবে চলবে চক্রবর্তী? কনসেনট্রেট, ডোন্ট লুজ কন্ট্রোল।শেক্সপিয়ার সরণীর মুখে ‘দত্ত এন্ড দত্ত ট্র্যাভেল এজেন্সি’র আপিসে যখন সাত্যকি পৌঁছাল তখন সকাল দশটা। ব্যস্ত রাজপথ কর্মব্যস্ত মানুষজনের কোলাহলে মুখর। সারিবন্দি গাড়ির দল লালবাতির আলোয় থমকে রয়েছে। সকলের মধ্যেই ভারি উত্তেজনা, সবাই অতিদ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। ফলে যানজটে স্তব্ধ নগরীর মাঝে রজোগুণের সুর বেজে উঠেছে! এরই মাঝে সাত্যকি খেয়াল করল ট্র্যাভেল এজেন্সির আপিস লাগোয়া একটি ছাতিম গাছের তলে গতদিনের কুসুমরেণু নিজেকে বিছিয়ে রেখেছে। মাথার উপর অপরাজিতার পাপড়ি-মোছা রং দু-এক খণ্ড সাদা মেঘের খেয়ালে আরও উজ্জ্বল। সকলের অলক্ষ্যে এই কর্মব্যস্ত মহানগরীর অন্তঃপুরে কোনও অলীক বাঁশিওয়ালা তার আড়বাঁশিটি নিয়ে বসেছে। কান পাতলে সংবেদনশীল মানুষের মনে সেই অপরূপ বাঁশি আশ্চর্য ঝিলিমিলি তুলে নীচু স্বরে বলে, ‘তোমরা বড়ো চঞ্চল, দু-দণ্ড ভেতর ঘরে তাকাও না, তোমরা বড়ো দুঃখী!’
গাড়ি থেকে নেমে কালো কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে যাওয়ার সময় সাত্যকি আড়চোখে দেখল, তার পেছনেই সুবেশা এক তরুণী এসে দাঁড়িয়েছে। সামান্য যেন আনমনা। আলতো স্বরে পেছন থেকে সাত্যকিকে বলল, ‘এক্সকিউজ মি!’
ঘুরে তাকাল সাত্যকি। মেয়েটির পরনে কচি বাঁশরঙা সালোয়ার ও চুড়িদার। একমুঠি কুসুমের মতো গহিন কৃষ্ণকেশরাজি ঘাড়ের কাছে এসে হঠাৎ যেন শেষ হয়ে গেছে। চোখে একখানি কালো রোদচশমা। সামান্য ইতস্তত সুরে তরুণী জিজ্ঞাসা করল, ‘এইটাই তো দত্ত এন্ড দত্ত ট্র্যাভেলস?’
সাত্যকিকে আজ ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। দীর্ঘকায় শরীরটি পাতলা নীল হাফহাতা জামা আর লিনেনের ছাইরঙা প্যান্টে সাজানো। চাইনিজ কলারের জামাটি আলগোছে পরা। মাথার চুলগুলি ঈষৎ এলোমেলো। একদিনের না-কামানো দাড়ি ও গোঁফে রুক্ষ শীতের মৃদু সাদা আভাস স্পষ্ট। মৃদু হেসে প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলল, ‘হ্যাঁ!’
কথাটি বলেই উদাসি চৈত্র বাতাসের মতো কাচের দরজা খুলে ভেতরে চলে যেতেই তরুণী একবার উপরের সাইনবোর্ডে লেখা ঠিকানার পানে চাইল। এই সংস্থার হদিশ মহেশ্বরবাবু দিয়েছেন। ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক তাঁর বিশেষ পরিচিত। এঁরাই ঋষার অমরকণ্টক যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবেন। ইতোমধ্যেই ফোন করে মহেশ্বর সেন সে কথা বলে রেখেছেন।
‘স্যর, আপনার জন্য এই ট্র্যাভেল প্ল্যান পারফেক্ট, প্লিজ সি ইট ওয়ান্স!’, দত্ত ট্র্যাভেল এজেন্সির কালো স্যুট পরা সুবেশী তরুণী প্রশস্ত টেবিলের ওপ্রান্ত থেকে একটি কাগজ সাত্যকির দিকে এগিয়ে দিয়ে সামনের চেয়ারে বসা ঋষার দিকে তাকিয়ে কেজো-মিষ্টি স্বরে বলল, ‘ম্যাম, জাস্ট টু মিনিটস, স্যরকে ছেড়েই আপনার সঙ্গে কথা বলছি! মহেশ্বর স্যর আমাদের ফোন করেছিলেন। উই অলরেডি মেড আ পারফেক্ট ট্যুর প্ল্যান ফর ইউ!’
প্রত্যুত্তরে ঋষার মুখে একফালি সৌজন্য-হাসি ফুটে উঠল, ‘ইটস অলরাইট! প্লিজ টেক ইয়োর টাইম!’
কয়েক মিনিট পর কাগজটি টেবিলের উপর রেখে শান্ত স্বরে সাত্যকি বলল, ‘আপনারা রুণ্ডা পরিক্রমার প্ল্যান করেছেন!’
তরুণী সাগ্রহে কাগজটি হাতে নিয়ে উত্তর দিল, ‘ইয়েস স্যর! আজকের দিনের টাইম এন্ড কমফর্ট মাথায় রেখেই আমরা এমন ট্যুর প্ল্যান করেছি। আওয়ার ডেস্টিনেশন স্টার্ট ফ্রম ওঁকারেশ্বর। তারপর দক্ষিণতট ধরে সোজা পশ্চিমে নর্মদা মোহনার দক্ষিণতটে গুজরাতের কাটপোরে বিমলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে পৌঁছে সেখান থেকে নৌকোয় গ্লাফ অব খাম্বাট পার হয়ে নর্মদার উত্তরতটে মিঠি তালাই। সেখান থেকে নর্মদার উত্তরতট ধরে ইস্টে উৎসস্থল, মানে অমরকণ্টক থেকে দক্ষিণতট ধরে পশ্চিমে আবার ওঁকারেশ্বর পৌঁছে পরিক্রমা সম্পূর্ণ হবে। ইন দিস হোল রুট আওয়ার ট্রেনড ট্র্যাভেল গাইড উইল গাইড ইউ। লেট মি সি ইউ আ ম্যাপ স্যর। ইট উইল হেল্প ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ইট উইল টেক টোয়েন্টিটু ডেজ, আ কমফোর্টেবল এসইউভি কার উইল বি দেয়ার। প্রব্যাবলি দ্য বেস্ট হোটেল অর ধরমশালা উই উইল অ্যারেঞ্জ!’
মৃদু হেসে সাত্যকি বলল, ‘কমফোর্টেবল জার্নি ইন পরিক্রমা! ইটস আ ভেরি স্ট্রেঞ্জ ওয়ার্ড!’
–স্যরি স্যর, বাট মোস্ট অব দ্য পিলগ্রিমস, মেইনলি ফ্রম ক্যালকাটা, ওয়ান্ট আ ভেরি নাইস জার্নি! দ্যাট ইজ হোয়াই উই প্ল্যানড ইন দিস ওয়ে!
‘আপনাদের এসইউভি কার নিশ্চয়ই এয়ার কন্ডিশনড?’, সাত্যকির সূক্ষ্ম কৌতুক বুঝতে না-পেরে তরুণী সাগ্রহে বলল, ‘অফকোর্স স্যর! ইটস ফুললি এসি অ্যান্ড মোস্ট কমফোর্টেবল্।
‘অপরিচিত যুবকের কথা শুনে নিজের মনেই হাসল ঋষা, এমন সূক্ষ্ম রসিকতা আজকের দিনে প্রায় শোনাই যায় না।
‘ওকে, অ্যান্ড হোয়াট ইজ দ্য প্রাইস?’, সাত্যকির প্রশ্ন শুনে সামান্য হেসে ট্র্যাভেল এজেন্সির তরুণী বলল, ‘ইটস অনলি ফোরটিটু থাউজেন্ড রুপি স্যর, প্লাস জিএসটি!’
–আচ্ছা, আমার শুধু একটাই প্রশ্ন রয়েছে।
–প্লিজ ফিল ফ্রি টু আস্ক স্যর!
দু-এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে সাত্যকি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কি এখান থেকে জব্বলপুর অবধি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেন?’
–নো স্যর, আমরা যেহেতু ওঁকারেশ্বর থেকে জার্নি স্টার্ট করি, সো আওয়ার পয়েন্ট ইজ ইন্দোর। জেনারেলি আমরা শ্রিপা এক্সেপ্রেসের ফার্স্টক্লাস টিকিট প্রোভাইড করি, ফ্রম হাওড়া টু ইন্দোর।
–নাইস, দেন প্লিজ বুক আ সিট ফর মি। আমি এখনই সম্পূর্ণ পেমেন্ট করে দিচ্ছি, আর হ্যাঁ, আপনাদের জার্নি তো আগামী পরশু মানে শনিবার শুরু হচ্ছে?
পুরো বিয়াল্লিশ হাজার টাকার কথা শুনে সামান্য বিস্মিত কণ্ঠে তরুণী বলল, ‘বাট স্যর, আমরা অ্যাডভান্স নিই অনলি টোয়েন্টি পার্সেন্ট!’
মৃদু হাসল সাত্যকি, ‘আমি পুরো পেমেন্ট করলে কি অসুবিধা হবে?’
–নো স্যর, নট অ্যাট অল! ইয়েস স্যর, শনিবার আমরা স্টার্ট করছি, প্লিজ গিভ মি হাফ অ্যান আওয়ার, আমি আপনার সমস্ত পেপার রেডি করে দিচ্ছি!
–ওকে! প্লিজ টেক ইয়োর টাইম!
‘এন্ড স্যর, ইন পরিক্রমা দেয়ার আর সাম রুলস’, কথা শেষ হওয়ার আগেই সাত্যকি ডানহাত তুলে শান্ত স্বরে বলল, ‘ইয়েস, ডোন্ট ওরি, আই নো দ্য রুলস্!’
সাত্যকির সঙ্গে কথা শেষ করে ঋষার দিকে তাকিয়ে তরুণী অল্প হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইয়েস ম্যাম, আপনার অমরকণ্টক অবধি ট্রেন বুকিং আর ওখানে হোটেল দরকার, তাই তো?’
তরুণীর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে ঋষা বলল, ‘হ্যাঁ! ফ্লাইটের টিকিট অ্যারেঞ্জ করুন প্লিজ, আমি অ্যাজ শুন অ্যাজ পসিবল অমরকণ্টক পৌঁছাতে চাই!’
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : পরবর্তী শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।
https://three.pb.1wp.in/magazine/magazine-novel-harer-banshi-part-twenty-nine-by-sayantan-thakur/