অদিতি বসুরায়
দ্বিতীয় পর্ব
-কিরে, ডাকছি যে কখন থেকে। শুনতে পাচ্ছিস না, নাকি?
সে পাশ ফিরে ঘাপটি মেরে থাকার উদ্যোগ করে আবার। যদিও জানা কথা, মা এবার ঠিক ঘরে ঢুকে পড়বে।
-রণো, ওঠ, বাবা! চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে!
-উঠছি তো !
-ওঠ, লক্ষী বাব
দ্বিতীয় পর্ব
-কিরে, ডাকছি যে কখন থেকে। শুনতে পাচ্ছিস না, নাকি?
সে পাশ ফিরে ঘাপটি মেরে থাকার উদ্যোগ করে আবার। যদিও জানা কথা, মা এবার ঠিক ঘরে ঢুকে পড়বে।
-রণো, ওঠ, বাবা! চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে!
-উঠছি তো !
-ওঠ, লক্ষী বাবা আমার !
আর উপায় নেই। উঠতেই হবে। তা না হলে, সমানে ডেকেই যাবে। বাবা,বাছা করতে থাকবে! নাহ- ‘উঠছি’ বলে চোখ খুলেই, সামনে মা। চাঁপা ফুল রং শাড়ি পরা, স্নান সেরে, এলোচুলের মা তার, যেন এক উজ্জ্বল সরস্বতী। মা কখনও সিঁদুর পরে না। বিয়েবাড়ি বা পুজো-আচ্চার দিনে, কপালে একটা বড় টিপ কেবল। তখন মাকে কেমন অন্য বাড়ির মেয়ে মনে হয় তার। মনে হয় যেন এক চির তরুণী– দয়িতের বিরহে দিন কাটাচ্ছে।
মা সারা বছর, স্নান সেরে, রহিম চাচার হাতে তৈরি সুরমা লাগায় চোখে। লক্ষী নয়, সরস্বতী-সরস্বতী ব্যাপারটাই মায়ের সঙ্গে খাপ খায় বরাবর। এখন, এই মেঘ নেমে আসা, মাঝ সকালে মায়ের পেছনদিকে, চালচিত্রের মতো এই ঘরের একমাত্র খোলা জানলাটি। আলোর দিকে পিঠ করে থাকা মায়ের মুখে চাপা বিষণ্ণতা, আলপনার মতো ফুটে আছে। দেখে তার মনে হয় – এই, সেই, তাদের, কতকাল আগের ভাড়া-বাড়িতে থাকা তরুণী মা-ই যেন ফিরে ফিরে আসে রোজ সকালে। আজকের মতনই। জানলার ওপাশে তাদের কদম ফুলের গাছ। ঠাম্মার পোঁতা। এই বর্ষায় ঝেঁপে ফুল এসেছে সে গাছে। দেখতে দেখতে চাদর সরিয়ে, এতক্ষণে উঠে বসল সে...
-কতদিন জলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, তোর?
-বেশি না, মাত্র দিন চারেক।
-ইসসসস, বোঁটকা গন্ধ বেরচ্ছে যে গা থেকে। সোনা বাবা আমার, চা খেয়ে স্নান সেরে জলখাবার খেতে এসো। আজ লুচি ভেজে দিচ্ছি তোমায়।
-সে জানে, মা কেন এত জোর করছে ওঠার জন্য। ডাক্তারবাবু বারবার বলে দিয়েছেন, তাকে স্বাভাবিক কাজ মানে স্নান,খাওয়া,পড়া,গানের মধ্যে থাকতে হবে, সে যতই মনখারাপ থাকুক না কেন। এ কদিন সে পারে নি কিছুই। খেয়েছে সামান্য। স্নানে যায় নি। অন্যান্য কাজও করতে পারে নি। মনে করো, যেন সে একটা একমুখী টানেলে আটকে যায় এরম সময়ে। সারাক্ষণ শুয়ে থেকে থেকে দেখে, সকাল কি করে দুপুর থেকে বিকেল পার হয়ে রাতে ঢুকে পড়ে। আর শীত করে খুব। করেছেও। এই গরমে।নাহ! আজ স্নান করতেই হবে। সে সব কিছুতেই ভয় পায়। জল খরচ করতেও। তামিলনাড়ু, গুজরাটে নাকি জল ফুরিয়ে আসছে। বহুজাতিক নরম পানীয় নির্মাতাদের হাতে চলে যাচ্ছে জল। চাষের জলে টান পড়ছে। ওসব জায়গায় এখন খাবার জল কিনে খেতে হচ্ছে! সে ভাবে, কি হবে, এই গ্রহের? এরপর? কি হবে সব জল ফুরিয়ে গেলে? ফসল ফলবে কিভাবে? পানীয় জল না মিললে বাঁচবে কী করে সব? বাচ্চারা স্নান কাকে বলে জানবে না? আর সে? সে যাবে কোথায়? সাঁতার কাটবে কোথায় সে? কে তাকে বাঁচাবে স্বহত্যা থেকে? কিভাবে বাঁচবে তাদের সন্ততি? ভেবে চিন্তে, সাবধানে জল খরচ করে সে আজকাল। ভয়ে ভয়ে কল খোলে– আর প্রতিবার, অস্থির হয়ে ভাবতে থাকে, যদি জল না আসে? তবে ? – তারপর কি হবে এই শুকনো দুনিয়ার? সে ভেবেই চলে। ইতিমধ্যে মা রান্নাঘরে চলে গেছে ময়দা মাখতে। চা রেখে গিয়েছিল সেই কখন – এতক্ষণে মাথার কাছের টেবিল থেকে কাপ তুলে নিল রণো। জুড়িয়ে আসা চা মুখে দিয়ে, সরিয়ে রাখল সে। বাজে লাগছে খেতে। তবু যদি এক কাপ আগুন গরম চা পান করা যাত! – নাহ! ভালো লাগছে না কিছুই - লক্ষণ ভালো নয়। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে আবার। জোর করে নিজেকে মোটিভেট করল সে। উঠতেই হবে – উঠতে হবেই। এক লাফে ঢুকে পড়ল বাথরুমে। সাদা আর গ্রে রঙের টাইলসে মোড়া এ-ঘর। বিরাট আয়না। চওড়া বেসিন। টুথপেস্ট হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল মিনিট দুয়েক। সকাল বয়ে যেতে লাগল। তার কোনো তাড়া নেই। বাড়িতে কেউ কোনও কথা বলছে না – আওয়াজ নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে এল আবার। নাহ! আর সময় নষ্ট করা যায় না। সে ব্রাশ করা শেষ করে, কুলকুচি করল সময় নিয়ে। এবার স্নান।প্রথম মগ জল মাথায় ঢালতেই, শিরশিরিয়ে উঠল গা। যেন মল্লার রাগ গাওয়া শুরু হয়েছে তার। জলে জলে মল্লার খোলে ভাল। ছড়িয়ে যায় শাখায় শাখায়। সে যেন মল্লারে স্নানে নেমেছে। দ্বিতীয় মগের পর সে দেওয়াল ধরে বসে পড়ল মেঝেতে। শাওয়ার খুলেছিল আগেই। ঝরঝরিয়ে জল পড়তে লাগল তার গা বেয়ে। গড়াতে লাগল জল। সে ভুলে গেল, জল অপচয় করতে নেই। ভুলে গেল, তার না- লেখা কত কবিতা, এখনও টুকে রাখা হয়নি কোথাও! - তিথিকে মনে পড়লে তার এমন হয় আজকাল। মনে মনে কথা বলতে থাকে তারা। আসলে সে একাই কথা বলে – মনে করে দুজনে, বলছে। মনে হয়, তিথি যদি তাকে এভাবে দেখত, কি ভাবত ? একটা সাতাশ বছরের তরুণ। সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। জলে ওলটপালোট খাচ্ছে। সাদা টাইলসের ওপর কী খারাপ যে দেখতে লাগছে তার কালো অঙ্গ-প্রতঙ্গকে! মা যদিও তাকে শ্যামরায় বলে ভোলায়। কিন্তু সে জানে, ওসব শ্যামট্যাম কিস্যু না সে। সে আসলে কালোই। ‘আমার কালো ভ্রমর’ বলে, তাকে আদর করে ডাকত তিথি। ভাই ফরসা। মাও। বাবা নাকি অনেকটা তার মতো ছিল। সাদা-কালো ছবিতে সে বুঝতে পারেনি ফারহান সিদ্দিকির গায়ের রং ঠিক কেমন ছিল! আচ্ছা, কেন সে গায়ের রং নিয়ে ভেবে যাচ্ছে? ভেবেই যাচ্ছে এই আসন্ন বাদল দিনে? ত্বকের বর্ণ কি ভাবনার বিষয় হতে পারে? আর যদি ভাবনার বিষয় না-ই হয়, তবে চারদিকে ফর্সা হওয়ার ক্রিম নিয়ে এত চর্চা কেন? কেন এত বিজ্ঞাপন? এত হইচই?তিথি ফরসা নাকি কালো- সে কোনও দিন বুঝতে, জানতে কিছুই চায়নি। সে কেবল মনে রেখেছে, তিথির গায়ের রং, চাঁদের আলোর মতো। সেই প্রথম দেখার সন্ধেতে, ওই মেয়ে ভেসে উঠেছিল গা-ভর্তি জ্যোৎস্না নিয়ে। শেষ দেখার দিনটিতেও তিথির সারা গা থেকে জ্যোৎস্না ঝরে ঝরে পড়ছিল। কি মনে করত, মেয়েটা তাকে এখন দেখতে পেলে? আদর? কতদূর? চুমুও তো, তাইনা? মাথা ব্যথা করে তার আবার। তীব্র মাথার যন্ত্রণা তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় পারিপার্শ্বিক থেকে। দ্রুত পোশাক পরে নিতে হবে... এবার। স্নান সেরে বেরিয়ে, সে, যে ঘরে পা রাখলো, কয়েক সেকেন্ডের জন্য সেই ঘরটিকে চিনতে পারল না। তার চোখ দেখল, ওই যে বিশাল জানলা। তার পাশে টেবিল। টেবিলের নীচে কাঠের স্ট্যান্ডে রাখা হারমোনিয়াম। দুদিকের দেওয়ালজোড়া বইয়ের র্যাক। এলোমেলো। প্রায় শ’খানেক কবিতার বই এই ঘরে। বাবাইও খুব কবিতা পড়তে ভালবাসে। কেনেও অনেক। বুকর্যাকের উল্টোদিকে সিংগল খাট। অগোছালো ছিল একটু আগেও। এখন খাট পরিষ্কার। নীল চাদর। বালিশ-বিছানা নিখুঁতভাবে ভাঁজ করে রাখা। মায়ের কাজ। একটা কাঁচের প্লেটে খান চারেক কদম ফুল। ডিমের কুসুমের মতো রং ফুলের। এই ফুল-এই দেওয়াল-এই কাঁচ-এই ছাদ এসব কি তার? - হ্যাঁ। মাথা উত্তর দেয় এবার। এই তো তার ঘর। - হ্যাঁ, তারই। এই তো তার গানের ঘর। কবিতার বই নিয়ে এখানে সে রাত-দিন কাটায়। ঘুমায় রাতে। এখনো আধখোলা ‘মা নিষাদ’ পড়ে আছে টেবিলে - “আবার গুবগুবি বাজল,বাজে খোল,বাজো হে দোতারা/দু’ঘর চারঘর, তবু বেঁচে থাকো বাউলের পাড়া”। মা কখনো তার খোলা বই বন্ধ করে না। কাল রাতে সে-ই কি এই বই খুলেছিল? পড়েওছিল? মনে করতে পারলো না। মনে পড়ছেও না। ফের কিসের যেন ভয় করতে লাগল এবার! সে কি আস্তে আস্তে সব ভুলে যাচ্ছে? সেই ‘স্টিল অ্যালিস’ ছবিটায় অ্যালিসের যেমন হয়েছিল! খুব ভাল লেগেছিল তার সিনেমাটা। তার কেন এমন শীত করে? ঘামতে ঘামতেও ঠান্ডা লাগে ভারি। আতঙ্কে সে আয়নার দিকে তাকালো না। বুকর্যাকের পাশে ছোট্ট একটা ড্রেসিং ইউনিট। টুক করে চিরুনী তুলে নিল সে। চুল-টুল আঁচড়ে জোভান মাস্ক ছড়াল টি-শার্টে। সে আর তিথি একসঙ্গে জোভান কিনত। ওরটা সাদা, তারটা কমলা। এটা তো মনে আছে! তবে কাল রাতের কথা ভুলে গেল কেন সে? ভুরু কুঁচকে আয়নার দিকে তাকালে পারল সে এতক্ষণে। আয়নার প্রতি বিতৃষ্ণা ছোটবেলা থেকেই। সে অবশ্য মজার একটা ব্যাপার। ছোটবেলায় যত ভূতের সিনেমা দেখত, প্রায় সবকটাতেই আয়নার দিকে তাকালেই ভূতের দেখা মিলত – সেই ভয়টা আজও তাকে ছেড়ে যায়নি। আর সে ভয় পেত বাবাকে। বাবা লোকটা এক না মেলা ধাঁধা। বোঝা যেত না বলে, ভয়টা আরো বেশি লাগত। ঠিক ভয়ও নয়। আতঙ্ক এক ধরণের। সেই সঙ্গে ছিল আকর্ষণ। বাবা একদম আলাদা লোক ছিল । অন্যরকম।মা আজীবন ভেবে চলেছে, সে আসলে বাবাকেই ভালবাসত। ভুল। খুব ভুল। বাবাকে ভালবাসা খুব কঠিন ছিল। সহজ যা ছিল, সেটাই সে করেছে। করেও। তা হল, ভয় পাওয়া ও আতঙ্কিত হওয়া। দুনিয়াজুড়ে যে, আতঙ্কের ঢেউ বইছে, তার থেকে সে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারে না কোনদিনই। সে জানে, সে মায়ের মতো নয়।মায়ের থট প্রসেসিং লেভেল আলাদা। ওদের জেনারেশনটা-ই একদম অন্যরকম। ঠাম্মাও আলাদা ছিল। ঠাম্মা মানে বাবাইয়ের মা। যেমন দুর্দান্ত পারসোনালিটি তেমনই বুদ্ধিমতী। মা তো বরাবরের চুপচাপ। কথা কম বলে। কথা কম যারা বলে, তাদের বুঝতে পারা মুশকিল। মাকে সে সব সময় বোঝেনা। মাও কি তাকে বুঝতেপারে? আগের মতো ? অনেক খানিই পারে। খানিকটা আবার পারেও না। বোঝা কি সহজ ব্যাপার? সেও কি নিজেকে বোঝে?
https://thewall.in/magazine/magazine-novel-dark-tragedy-aaj-snaner-din-part-1/