Latest News

ডাইনি অপবাদ দিয়ে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়া শিশুটি আজ জীবনপুরের রাজপুত্র

নাইজেরিয়ার আকোয়া আইবোম ও ক্রস রিভার রাজ্য দুটিতে, গত এক দশকে, প্রায় ১৫০০০ শিশুকে তাদের পরিবার ও সমাজ এইভাবে পরিত্যাগ করেছে ডাইনি অপবাদ দিয়ে। এর মধ্যে ১০০০ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

রূপাঞ্জন গোস্বামী

৩১ জানুয়ারি, ২০১৬। দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসে গিয়েছে, দক্ষিণপূর্ব নাইজেরিয়ার উইও এলাকার ঘিঞ্জি মফস্বলটিতে। পা টেনে টেনে আবর্জনার স্তুপের দিকে এগিয়ে চলেছিল এক শিশু। চলতে পারছিল না, অনেক কষ্টে শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেছিল আবর্জনার স্তুপটির দিকে। ওটাই শিশুটির থাকার জায়গা। কারণ শিশুটি আবর্জনার স্তুপে ফেলে দেওয়া খাবার খায়। তাই খেয়ে বেঁচে থাকে কুকুর বিড়ালদের মতো।

একবছর বয়েসে তাকে এই জঞ্জালের স্তুপে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফেলে দিয়ে গিয়েছিল তার পরিবার, তার সমাজ। সে নাকি ডাইনি। তার ভেতরে নাকি ‘অশুভ শক্তি’ আছে। সে নাকি কালাজাদু করে তার গ্রামের সর্বনাশ করছে। তাদের সম্প্রদায়ের দুর্ভাগ্য, রোগ ও মৃত্যুর জন্য সেই নাকি দায়ী। তাই সে পরিত্যক্ত। সর্বান্তকরণে তার মৃত্যু কামনা করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে তার পরিবার ও সমাজ। চিল শকুনের খাবার হিসেবে।

নাইজেরিয়ার আকোয়া আইবোম ও ক্রস রিভার রাজ্য দুটিতে, গত এক দশকে, প্রায় ১৫০০০ শিশুকে তাদের পরিবার ও সমাজ এইভাবে পরিত্যাগ করেছে ডাইনি অপবাদ দিয়ে। এর মধ্যে ১০০০ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওঝাদের বর্বরতার হাত থেকে শিশুগুলিকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি টিম পাঠিয়েছিল আফ্রিকায়। সেরকমই একটি টিম নিয়ে নাইজিরিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন এক ডেনিস স্বেচ্ছাসেবী আনজা রিংগ্রেন লোভেন। তাঁর স্বামী ডেভিড ইমানুয়েল উমেনকে নিয়ে। যিনি ছিলেন প্রবাসী নাইজিরিয়ান।

শিশুটিকে দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল লোভেনের

গাড়ি থেকে নেমে, দৌড়ে গিয়ে শিশুটির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন লোভেন। জলের বোতলের ছিপি খুলে, বোতলের মুখটা শিশুটির মুখে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হাতে দিয়েছিলেন বিস্কুটের প্যাকেট। বড় বড় চোখ নিয়ে চকচক শব্দে জল খেতে শুরু করেছিল কঙ্কালসার শিশুটি।

স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে লোভেন জেনেছিলেন, প্রায় একবছর ধরে ওই জঞ্জালের মধ্যে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বাঁচছিল, ঠিক মতো কথাও বলতে না পারা শিশুটি। খোলা আকাশের নীচে, একটা নোংরা ভিজে কম্বলের তলায়, শিশুটি কাটিয়ে ফেলেছিল আস্ত একটা শীত। কোনও শীতবস্ত্র ছাড়াই। দয়া করে কেউ হয়ত কম্বলটি দিয়ে গিয়েছিল। সমাজে একঘরে হওয়ার ভয়ে এর থেকে বেশি কিছু করতে পারেনি সে। শিশুটির বাবা মায়ের বা পরিবারের খোঁজ মেলেনি। তবে স্থানীয়রা লোভেনকে জানিয়েছিলেন, এলাকার বাইরে থেকে শিশুটিকে সেখানে ফেলে যাওয়া হয়েছিল।

অভিজ্ঞ লোভেন বুঝেছিলেন, শিশুটির অমানুষিক জীবনীশক্তি ক্রমশ হার মানতে শুরু করেছে। শিশুটির আয়ু আর বেশি দিন নেই। কারণ শিশুটি রাস্তার কুকুর বিড়ালদের সঙ্গে খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে জিততে পারেনি। তাই দিনের বেশিরভাগ সময়ে তাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। নয়ত কুকুর বিড়ালের না ছোঁয়া খাবার খেতে হয়েছিল। নোংরা পরিবেশ ও দূষিত জল, থাবা বসিয়েছে শরীরে। শোচনীয় অপুষ্টি, ফিতা কৃমি, আলসার, ডায়েরিয়া, তীব্র জলশূন্যতা, সারা শরীরে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকঘটিত ইনফেকশন, সব কিছু্র লক্ষণ ছিল একরত্তি শরীরটিতে।

নতুন মায়ের কোলে ‘হোপ’।

শুরু হয়েছিল বাঁচানোর লড়াই

গাড়ি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার সব সরঞ্জাম নিয়ে নেমে পড়েছিলেন লোভেনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যেরা। স্টোভ জ্বেলে জল গরম করে, জলের মধ্যে জীবাণুনাশক সাবান ও জেলি মিশিয়ে, শিশুটিকে স্নান করিয়ে, নরম তোয়ালেতে মুড়ে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। সমবেত জনতা চাইছিল এলাকা থেকে দ্রুত বিদায় নিক এই অশুভ শিশুটি। সবাই জানতেন শিশুটি বাঁচবে না।

তবুও লোভেনরা শিশুটিকে বাঁচাবার শপথ নিয়েছিলেন গাড়িতে বসে। লোভেনের হাতের পাতায় পর পর এসে পড়েছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যদের হাত। সবকটি হাত এক হয়ে যাওয়ার পর লোভেন বলেছিলেন, “এই যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য যতদূর যেতে হয় আমরা যাব। তোমরা তৈরি থাকো।”

স্নান করানো হচ্ছে শিশুটিকে

শিশুটিকে নিয়ে লোভেনরা এসেছিলেন তাঁদের কেয়ার সেন্টারে। লোভেনের কোলে শুয়ে, শিশুটি ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল লোভেনকে। কে জানে, লোভেনকে দেখে তার মায়ের কথা মনে পড়ছিল কিনা । যে মা ন’মাস গর্ভে ধরে, পৃথিবীর আলো দেখিয়ে, মৃত্যুর হাতে তাকে একলা ছেড়ে দিয়েছিল। শিশুটি কিন্তু একটুও কাঁদছিল না। হয়ত কাঁদতেই শেখেনি। হয়ত নিজেকে মানুষ ভাবতেই শেখেনি। বিড়াল কুকুরের সমগোত্রের কোনও প্রাণি বলে নিজেকে ভেবে নিয়েছিল হয়ত।

দু’বছরের শিশুটির নাম লোভেন রেখেছিলেন ‘হোপ’ বা ‘আশা’। কারণ তখনও লোভেনের মনে সামান্য আশা ছিল, তাঁরা শিশুটিকে বাঁচাতে পারবেন এবং শিশুটিও বাঁচার জন্য লড়াই চালাবে। যেভাবে একবছর ধরে শিশুটি বাঁচার লড়াই চালাচ্ছিল আবর্জনার স্তুপের মধ্যে। খোলা আকাশের নীচে।

গাড়িতে মৃতপ্রায় শিশুটি।

বাঁচার লড়াই শুরু করেছিল ছোট্ট হোপও

শিশুটিকে উদ্ধারের দিন সন্ধ্যাবেলা, ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন লোভেন। শিশুটির সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার মূহূর্তটির ছবি। নগ্ন,পরিত্যক্ত, মৃত্যুর প্রতীক্ষা থাকা শিশুটির ছবি কয়েক মিনিটের মধ্যে ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর সবকটি সংবাদপত্রের শিরোনামে ও টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে উঠে এসেছিল হোপ ও লোভেনের ছবি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে হোপকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আসতে শুরু করেছিল অর্থ সাহায্য। চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছিল তার আগেই।

দিনের পর দিন রাতের পর রাত, পালা করে শিশুটিকে কোলে করে বসে থাকতেন স্বেচ্ছাসেবীরা। নিজের সন্তান ভেবে পরম মমতায় শিশুটির সেবা করতেন। লোভেনদের অবাক করে চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেছিল হোপ।  নির্দয় সমাজের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড হেলায় নস্যাৎ করে, মাত্র আটমাসের মধ্যে পুরোপুরি সেরে উঠেছিল হোপ। লোভেন তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন, “দ্রুত বাড়ছে হোপ। মিষ্টি দেখতে হচ্ছে সে। হোপকে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। হয়ত নিজের চেয়েও।”

লোভেনের ফেসবুক পোস্টে আবার চমকে গিয়েছিল বিশ্ব

শিশুটিকে উদ্ধারের ঠিক এক বছর পর। ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। ফেসবুকে শিশুটির আর একটি ছবি আপলোড করেছিলেন লোভেন। উদ্ধারের ঠিক একবছর পর তোলা ছবি। সেই ছবিটিতে তিন বছরের শিশুটিকে চেনাই যাচ্ছে না। শিশুটির পরনে জাম্পার, সাদা স্নিকার, পিঠে কালো স্কুল ব্যাগ। সেই দিন শিশুটি তার স্কুল জীবন শুরু ছিল। স্কুলে যাওয়ার আগে শিশুটিকে জল খাইয়ে দিয়েছিলেন লোভেন। যেভাবে ঠিক একবছর আগে খাইয়ে দিয়েছিলেন।

একবছর আগের ‘হোপ’ এবং ঠিক একবছর পরের ‘হোপ’।

সেদিনও দুনিয়া স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, এক বছর আগের ছবিটিও একই সাথে লোভেন পোস্ট করায়। সারা বিশ্ব আনন্দে মেতে উঠেছিল। বিশ্বের সব সংবাদমাধ্যমের হেডলাইনে আবার উঠে এসেছিল, মৃত্যুকে হারিয়ে জীবনে ফেরা হোপ। হোপের চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন অনেকে। সেই টাকায় ইকেত নামে এক জায়গায় লোভেন বানিয়েছেন ‘ডাইনি’ অপবাদে পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য একটি শেল্টার ও চিকিৎসাকেন্দ্র। নাম দিয়েছেন ‘ল্যান্ড অফ হোপ’। আজ সেখানে হোপ ছাড়াও আরও ৩৫ জন সমাজ পরিত্যক্ত শিশু মহা আনন্দে থাকে।

আজ উসেইন বোল্ট হতে চায় ছ’বছরের হোপ।

লোভেন ও তাঁর সহকর্মীদের আদর ভালোবাসায় পেয়ে মাথায় দ্রুত বেড়ে উঠছে হোপ। আজ সে বাকি শিশুদের মতোই ভালো খেতে পাচ্ছে। মাথার ওপর একটা ছাদ পেয়েছে। একটা সুন্দর মা পেয়েছে। আজ আনন্দে আছে হোপ। খুব মজা করছে। স্কুলে যাচ্ছে। অবসর সময়ে ছবি আঁকছে। কয়েকদিন আগেই লোভেন জানিয়েছেন, “এর মধ্যেই হোপ তার স্কুলে ১০০ মিটার দৌড়ে চাম্পিয়ন।” ভবিষ্যতের অলিম্পিক চাম্পিয়নকে হোপের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে নাইজেরিয়া।

জীবনযুদ্ধে হোপ জিতে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে লোভেন বলেছিলেন, “যেখানে ভালবাসা সেখানেই আশা”। লোভেনের বলা সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়ে, আপাতত জীবনের ট্র্যাকে উসেইন বোল্টের গতিতে ছুটতে শুরু করেছে ছ’বছরের হোপ। এরপর, ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ বলবে।

You might also like