
রূপাঞ্জন গোস্বামী
আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসের বেশ অভিজাত এলাকা চ্যাটসওয়ার্থ। সেখানে বাস করতেন রবিনসন দম্পতি, অলিভিয়া আর জেমস রবিনসন। এলাকাটি এমনিতে খুবই শান্ত। সচরাচর কারও গলার আওয়াজ পাওয়া যেত না। অলিভিয়া আর জেমস মাঝে মাঝে শুনতে পেতেন প্রতিবেশী ডেভিড আর মিহোকো কুরোসের চার বছরের মেয়ে রিলির (নাম পরিবর্তিত) গলা। দু’মাসের ভাই রিচার্ডকে(নাম পরিবর্তিত) নিয়ে রিলি খেলত। আধো আধো গলায় দিদিমনি সেজে পড়াত, শাসন করত। রিলিদের বাড়ি গিয়ে রবিনসন দম্পতি দেখেছিলেন, সারাদিন ভাইকে নিয়েই কাটে মিষ্টি মেয়ে রিলির।
কিন্তু প্রায় তিনদিন তাঁরা রিলির গলা শুনতে পাচ্ছিলেন না
অথচ কুরোস পরিবারের বাড়িতে প্রায় সব লাইট জ্বলছিল, সারাদিন সারারাত। চিন্তিত হয়ে পুলিশকে ফোন করেছিলেন অলিভিয়া রবিনসন। একই সময়ে পুলিশকে ফোন করেছিলেন রিলিদের এক আত্মীয়। তিনিও ফোনে রিলির বাবা মা’কে পাচ্ছিলেন না তিনদিন ধরে। দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল, সকাল ৯ টার সময়ে একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে। বাড়িটির চারদিকে ঘুরে, সন্দেহজনক কিছু দেখতে না পেয়ে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন।
কিন্তু তাতেও আশঙ্কা দূর হয়নি অলিভিয়া আর জেমস রবিনসনের। কারণ তাঁরা ১০ এপ্রিল, ডেভিড আর মিহোকোর ঝগড়ার আওয়াজ শুনেছিলেন। সেই দিনের পর, কুরোস পরিবার থেকে একটিও আওয়াজ আর ভেসে আসেনি। পুলিশ চলে যাওয়ার পর রিলিদের সেই আত্মীয় এসেছিলেন তালা ভাঙার লোককে নিয়ে। রিলিদের আত্মীয়দের দেখে ভরসা পেয়ে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নেমে এসেছিলেন রবিনসন দম্পতিও।
তালা ভেঙে ঘরে ঢুকেছিলেন সবাই
বাড়িতে ঢুকে একতলায় দেখতে পেয়েছিলেন চার বছরের রিলিকে। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ছিল সে। নিজেরই প্রস্রাবের মধ্যে। গলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকিয়েছিল রিলি। ভাবলেশহীন দৃষ্টি, ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল তাকে। অলিভিয়া দৌড়ে গিয়েছিলেন রিলির দিকে। বুকে তুলে নিয়েছিলেন ছোট্ট রিলিকে।
–মা বাবা কোথায় রিলি?
– বাবা আর মা ওপরে ঘুমাচ্ছে, ওরা আহত।
অলিভিয়ার পায়ের তলায় মাটি কেঁপে উঠেছিল। সবাই বুঝতে পেরেছিলেন ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে গিয়েছে। দৌড়ে বাড়ির দোতলায় গিয়েছিলেন সবাই। দোতলায় পাশাপাশি দু’টি ঘর। সবাই আগে ঢুকেছিলেন ডেভিড আর মিহোকোর শোবার ঘরে। গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। খাটের ওপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়েছিল ডেভিড কুরোস (৪৬) এবং মিহোকো কুরোসের (৩৮) মৃতদেহ। ডেভিডের পাশে পড়ে ছিল একটি রিভলভার। দেহগুলিতে পচন ধরতে শুরু করেছিল। এর অর্থ কয়েকদিন আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল।
অলিভিয়া এবার দৌড়ে পাশের ঘরে ঢুকেছিলেন। সেই ঘরে একটি ছোট্ট খাটে শুয়েছিল দুই মাসের রিচার্ড। প্রস্রাব ও মলে মাখামাখি। কিন্তু জীবিত। মাঝে মাঝে জিভ বের করে ঠোঁট চাটছিল ছোট্ট রিচার্ড। মাথা বারবার এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছিল, হয়ত সে তার মাকে খুঁজছিল। অলিভিয়ার চিৎকারে তাঁর স্বামী জেমস চলে এসেছিলেন। কোলে তুলে নিয়েছিলেন রিচার্ডকে।
পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল
পুলিশ আসার আগে রিলি আর রিচার্ডকে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী টনি মেদিনা। তিনি ও অন্য প্রতিবেশীরা সবার আগে রিলি আর তার ভাইয়ের প্রাথমিক শুশ্রুষা আর খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দু’টি শিশুই প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিল। শরীরে দেখা দিয়েছিল জলাভাব। ছোট্ট রিচার্ডকে স্তনপান করিয়েছিলেন ডরোথি নামের এক প্রতিবেশী মহিলা। মা ভেবে তাঁকে আঁকড়ে ধরেছিল দুমাসের রিচার্ড। মহিলার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নেমেছিল জল।
পুলিশ এসে ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে জানিয়েছিল, স্ত্রী মিহোকোকে খুন করে নিজে সম্ভবত আত্মঘাতী হয়েছিলেন ডেভিড। পারিবারিক অশান্তিই দু’টি মৃত্যুর পিছনে থাকা কারণ। কারণ টনি মেদিনাকে ছোট্ট রিলি বলেছিল, তার মাকে সে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছিল। পুলিশের মতে, খুন ও আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল কয়েকদিন আগেই।
সেই ক’দিন বাবা ও মায়ের মৃতদেহের সাথে বাড়িতে বন্দী ছিল চার বছরের রিলি আর দু’মাসের রিচার্ড। না খেতে পেয়ে তারা কীভাবে বেঁচে ছিল, ভয়ে বা আতঙ্কে কেন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েনি, সেটাই অবাক করেছিল লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে। এরকম ঘটনা ঘটলে, সাধারণত বাচ্চারা কান্নাকাটি করে, চিৎকার করে ডাকে বাইরের লোককে। কিন্তু রিলি বড্ড ছোট ছিল, খুব ভালো করে কথা বলতেও পারত না। তাছাড়া তার উচ্চতা কম থাকায় জানলার কাছে পৌঁছাতে পারেনি হয়ত। কিংবা এই পরিস্থিতিতে কী করতে হবে তা বুঝতে পারেনি। যেমন রিলি বুঝতে পারেনি তার বাবা মা মারা গিয়েছেন। রিলি ভেবেছিল তাঁরা ঘুমিয়ে আছেন, ঘুম ভাঙলে খাবার দেবেন ভাইকে আর তাকে।
তদন্ত শুরু করে হতবাক হয়ে গিয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ
পুলিশ জানতে পেরেছিল, চার বছরের ছোট্ট রিলির বুদ্ধিমত্তায় ও আপ্রাণ বাঁচার চেষ্টায়, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল রিলি ও তার ভাই। মৃত্যুর আগে রিলির মা কয়েকটি বোতলে দুজনের জন্য খাবার তৈরি করে রেখেছিলেন। সারা দিন ধরে খাওয়াবেন বলে। যখনই ভাই রবার্ট খিদেয় কেঁদেছিল, মায়ের তৈরি করে রাখা তরল খাবার দুমাসের ভাইটির মুখে ধরেছিল চার বছরের রিলি। কিন্তু বোতলের খাবারও সম্ভবত এক দু’দিনের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল। নিজে না খেয়ে ভাইকে পুরো বোতলের খাবার খাইয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করে গিয়েছিল রিলি।
বোতলের খাবার শেষ হয়ে গেলে, ছোট্ট রিলি কল থেকে জল বোতলে ভরার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেসিনে হাত পৌঁছায়নি। এরপর টুল নিয়ে এসে বেসিনে ওঠবার চেষ্টা করেছিল রিলি। সারা ঘর খুঁজে খুঁজে, ফ্রিজ থেকে খাবার বার করেছিল রিলি। প্যাকেটজাত খাবার। কিন্তু প্যাকেটগুলো সে খুলতে পারেনি।
অনাহারে ক্রমশ অবসন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেছিল রিলি, তবুও খিদের জ্বালায় কাঁদতে থাকা ভাইকে ভোলাবার জন্য, নিজের খেলনা নিয়ে গিয়েছিল ওপরে ভাইয়ের ঘরে। অপেক্ষা করেছিল, তার বাবা মায়ের ঘুম ভাঙার। কিন্তু রিলি জানত না সে আর রবার্ট তিনদিন আগেই অনাথ হয়ে গিয়েছিল। তারপর, দিন গিয়েছে এসেছে রাত, রাত গিয়েছে, এসেছে দিন। এ ভাবেই কেটে গিয়েছিল তিনদিন। ছোট্ট রিলি নানা ভাবে তার দু’মাসের ভাইকে বাঁচাবার আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর সঙ্গে এক অকল্পনীয় সংগ্রামে নেমে জিতে গিয়েছিল চার বছরের রিলি। জিতিয়ে দিয়েছিল তার দুমাসের ভাইকেও।
অনাথ রিলি আর রিচার্ড এখন সেলিব্রেটি
ছোট্ট মেয়ে রিলির সাহসিকতার কথা আজও সারা আমেরিকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ছোট্ট রিলি ও তার দু’মাসের ভাই এখন সম্পুর্ণ সুস্থ। লস অ্যাঞ্জেলসের শিশু কল্যাণ দপ্তরের পরিচর্যায় থাকে রিলি আর রিচার্ড। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিয়েছে শিশু কল্যাণ দপ্তর। বিশ্বের নামিদামি সংবাদমাধ্যম হন্যে হয়ে ঘুরেছিল অসাধারণ জীবনীশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসা দুই ভাইবোনের ছবি তোলার জন্য। রিলির সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলসের শিশু কল্যাণ দপ্তর। তারা চায়নি, শিশুদুটির কোনও ছবি বাইরে আসুক।
২০১৯ সালের ২৬ মে, লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশের প্রেস কনফারেন্সে, আমেরিকাবাসীর মনের কথা বলেছিলেন ক্যাপ্টেন মৌরিন রায়ান, “ছোট্ট দেবদূত রিলি এবং মিরাকল বেবি রিচার্ড এখন সারা আমেরিকার গর্ব। যে ভাবে চার বছরের ছোট্ট রিলি তার দুমাসের ভাইকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়। সারা দেশ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্যালুট জানাচ্ছে, সেই আজ জাতীয় হিরো।”