
শাশ্বতী সান্যাল
১ জানুয়ারি ইংরাজি বছরের প্রথম দিন। অথচ ভক্ত বাঙালির কাছে এ দিনের গুরুত্ব একেবারে আলাদা। বাইরের উৎসবে, আলোকময়তায় গা ভাসানোর দিন নয়, ১ জানুয়ারি বাঙালির কাছে আত্মমগ্নতার দিন। অন্ধকার থেকে জ্যোতির দিকে, নির্জ্ঞান থেকে চৈতন্যের দিকে হেঁটে যাওয়ার দিন। আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে এমনই এক ১ জানুয়ারি কলকাতার বুকে জেগে উঠেছিল ইচ্ছাপূরণের এক আশ্চর্য গাছ। রুগ্ন, অশক্ত, প্রৌঢ়, ভবতারিণী মন্দিরের এক সামান্য পূজারীর মধ্যে সেদিন করুণাময় ঈশ্বরের রূপ দেখেছিল একটা গোটা জাতি। ধন, মান, অর্থ, সমৃদ্ধি নয়, তাঁর কাছে হাত পেতে কেবলমাত্র চৈতন্য জেগে ওঠার ভিক্ষা চেয়েছিল। এই চাওয়া ভক্তমনের চিরন্তন বাঞ্ছা। তাই শুধু উৎসবের তকমা দিয়ে আর উদযাপন দিয়ে এই দিনটির আধ্যাত্মিক মহিমা ব্যাখ্যা করা মুশকিল। কল্পতরু আসলে সেই গাছ, যার নীচে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করা মাত্র সে আমাদের সব ইচ্ছে পূরণ করে। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের গল্পে এই কল্পতরু বৃক্ষের কথা পাই আমরা। মন্থনকালে ক্ষীর সাগরের বুক থেকে উঠে এসেছিল নানান ভেষজ এবং চোদ্দ রকমের দুর্লভ মণিরত্ন। সেসব ভেষজ ও গাছপালার অন্যতম ছিল এক আশ্চর্য দ্যুতিময় গাছ, যার নাম কল্পতরু। আদি সংস্কৃত সাহিত্যে এ গাছের অনুষঙ্গ এসেছে বারবার। কোথাও আবার স্বর্গের পারিজাতের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে কল্পতরু। তবে শুধু হিন্দু পুরাণেই নয়, বৌদ্ধ আর জৈন মিথলজিতেও এই ‘কল্পতরু’ ভাবনার আশ্রয় মেলে। নামের হেরফেরে কোথাও সে কল্পবৃক্ষ, কোথাও কল্পদ্রুম বা কল্পপাদপ।
ইষ্টপ্রদানকারী ভগবানকে বর দেওয়া গাছ কল্পতরুর সঙ্গে তুলনা করা নতুন কিছু নয়৷ স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজেই অনেকবার ভক্তদের বলেছেন, “ভগবান কল্পতরু। কল্পতরুর নীচে বসে যে যা চাইবে, তাই পাবে।” তবে এই অভীষ্ট সিদ্ধির লোভ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ঈশ্বর-সাধনার পথে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব এও বলেছেন যখন সাধন-ভজনের দ্বারা মন শুদ্ধ হয় তখন খুব সাবধানে কামনা করতে হয়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সম্ভবত একবারই তিনি ভক্তদের সামনে অবারিত হৃদয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একবারই… প্রসন্ন মনে দুহাত খুলে বর দিয়েছিলেন ভক্তদের। কেবল যে সংসারী ভক্তের ইচ্ছে-পূরণ করেছিলেন তাই নয়, ‘চৈতন্য হোক’ এই শব্দবন্ধটি দিয়ে যেন মুছে দিয়েছিলেন তাদের সংসারজীবনের কালি। শুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ভক্ত বাঙালি।
ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন এই কলকাতায়, বরানগরের বুকে?১৮৮৫ র অগস্ট মাস নাগাদ গলার ঘা ধরে পড়ে ঠাকুরের। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘ক্লার্জিম্যানস থ্রোট। প্রথমে ব্যথা, রক্তক্ষরণ, পরে সেই ঘা’ই ক্যান্সারের চেহারা নেয়। ঠাকুরের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল্রন সেসময়কার বিখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। রোগটা যে ক্যান্সার সে নির্ণয়ও তাঁর। দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে এগোচ্ছিল। শরীর দুর্বল, ঢোঁক গিলতেও কষ্ট। তরল খাবার ছাড়া প্রায় কিছুই খেতে পারতেন না তখন। কথাবার্তাও বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ডাক্তারেরা একবাক্যে জানালেন বায়ু বদল দরকার। চিকিৎসার প্রয়োজনে দক্ষিণেশ্বর থেকে সরিয়ে তাঁকে প্রথমে নিয়ে আসা হল উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর আশ্রমে। শ্যামপুকুরের বাড়িটা তেমন মনে ধরেনি শ্রীরামকৃষ্ণের। বেশিদিন থাকতেও হয়নি। বাড়িওয়ালার চাপে শ্যামপুকুরে বাড়ি ছেড়ে দিতে হল ভক্তদের। খোঁজ শুরু হয় নতুন বাড়ির।
রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল লাল ঘোষের একটা বাগানবাড়ি ছিল কাশিপুরে। ৯০ কাশীপুর রোডের সেই গাছপালায় ঘেরা ১১ বিঘের বাগানবাড়ির নিরালা পরিবেশ শরীর সারিয়ে নেওয়ার জন্য ভারি উপযুক্ত জায়গা। মাসিক ৮০ টাকার চুক্তিতে প্রথমে ছ’মাস ও পরে আরও তিন মাসের জন্য সেই বাড়িই ভাড়া নেওয়া হল। ঠাকুর এলেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে।
সেসময় একের পর এক ডাক্তার আসছেন ঠাকুরকে দেখতে। রাতদিন এক করে সেবা করে যাচ্ছে সন্ন্যাসী ভক্তেরা। গৃহী ভক্তরাও উদ্বেগে ছটফট করে ছুটে আসছে প্রতিদিন। কিন্তু শরীর যেন সঙ্গ দিচ্ছে না ঠাকুরের। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জে এম কোটস এলেন একদিন। ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও হল। কিন্তু অসুখ যে কে সেই।
১লা জানুয়ারি, ১৮৮৬, কিছুটা সুস্থ বোধ করায় সেদিন বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। সন্ন্যাসী ভক্তদের অধিকাংশই অনুপস্থিত তখন। ঠাকুরকে সঙ্গ দিচ্ছিল তাঁর গৃহস্থ ভক্তদের কেউ কেউ। সেদিন কাশীপুরে ঠাকুরের সঙ্গে ছিলেন তাঁর অন্যতম ভক্ত মহানট গিরিশ ঘোষও। বাগানে বেড়াতে বেড়াতে ঠাকুর তাঁকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার সম্পর্কে এত কিছু বলে বেড়াও, আমাকে তুমি কী বুঝেছো?’’
আচমকা ঠাকুরের এই প্রশ্নে কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র। বিস্ময়ের সে ঘোর কাটিয়ে তিনি জবাব দেন, “তুমি আর কেউ নও, নররূপধারী পূর্ণব্রহ্ম ভগবান। আমার মত পাপীতাপীদের মুক্তির জন্য নেমে এসেছ।” এই কথা শুনে মৃদু হেসে ঠাকুর বলেছিলেন, “আমি আর কী বলব! তোমাদের চৈতন্য হোক।” এরপরেই সমাধি হয় ঠাকুরের।সমাধি অবস্থাতেই উপস্থিত প্রত্যেক শিষ্যকে স্পর্শ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ঠাকুরের অনুগামীদের মতে, তাঁর স্পর্শে সেদিন প্রত্যেকের অদ্ভুত কিছু আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছিল। ঠাকুরের গা দিয়ে এক অদ্ভুত জ্যোতি বেরোতেও দেখেন ভক্ত গৃহীদের কেউ কেউ। এতদিন কেবল সিমলের রামচন্দ্র দত্ত আর গিরীশ ঘোষেরই ঠাকুরের অবতারত্বে বিশ্বাস ছিল। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ১ জানুয়ারির সেই পুণ্যলগ্নে আর কারোরই সন্দেহের অবকাশ রইল না, ঠাকুর আসলে কে।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের অন্যতম শিষ্য রামচন্দ্র দত্ত পরে এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, সেই দিন রামকৃষ্ণ পরমহংস হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কল্পতরুতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনিই এই দিনটিকে কল্পতরু দিবস নাম দিয়েছিলেন, যা কালক্রমে পরিণত হয়েছে আজকের কল্পতরু উৎসবে।