কথামানবী খনার রক্তাক্ত নীরবতা!
শেষ আপডেট: 23rd March 2025 13:40
দ্য ওয়াল ব্যুরো: খনার নাম শুনলেই ভেসে ওঠে বাংলার মাঠ-ঘাটের মাটি-গন্ধ মিশে থাকা বচন। ‘দিনে রোদ রাতে জল, দিন দিন বাড়ে ধানের বল’—এরকম অসংখ্য বচনের মধ্যে দিয়ে বাংলার কৃষি ও আবহাওয়া সম্পর্কে দার্শনিক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই জ্ঞানের মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছিল নিজের জিভ হারিয়ে।
খনা আর কেবল একজন ব্যক্তিচরিত্র নয়, তিনি যেন হয়ে উঠেছেন নারীর বুদ্ধিমত্তাকে রুদ্ধ করে দেওয়ার ইতিহাসের প্রতীক। সমাজ যখন পুরুষের আধিপত্যকে প্রশ্নহীন রাখার চেষ্টা করেছিল, তখন খনার মতো নারীরা বিদ্রোহ করেছিল তাদের মেধার আলো নিয়ে। কিন্তু সেই আলোকে সহ্য করতে পারেনি পুরুষতন্ত্র।
খনার পরিচয় নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা কাহিনি। কেউ বলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার দেউলি গ্রামে জন্মেছিলেন, কেউবা বলেন, তিনি সিংহলের রাজকন্যা। একদল মনে করেন, তিনি ছিলেন কিংবদন্তি জ্যোতিষী বরাহমিহিরের পুত্রবধূ।
যেখানেই জন্ম হোক না কেন, খনার অসাধারণ জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁকে বাংলার কৃষিজীবী সমাজের পরম আশ্রয় করে তুলেছিল। তাঁর সহজাত ভবিষ্যদ্বাণীগুলি সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিল কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনের নির্ভরযোগ্য নির্দেশিকা।
খনার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল নিখুঁত, যা বরাহমিহিরের মতো বর্ষীয়ান জ্যোতিষীর চেয়েও অধিক নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। রাজা বিক্রমাদিত্যের দরবারেও তাঁর উপস্থিতি আলোড়ন তোলে। ক্রমে তিনি রাজসভায় নবরত্নের দশম রত্ন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চলেছিলেন। কিন্তু এখানেই বাধে বিপত্তি।
বরাহমিহিরের মতো পণ্ডিতরা মেনে নিতে পারলেন না যে, একজন নারী তাঁদের সমকক্ষ হয়ে উঠছেন। নারীর মুখ থেকে নির্ভুল জ্ঞান বারবার তাদের পৌরুষের অহংবোধে আঘাত করছিল। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, খনার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে হবে চিরদিনের জন্য।
একজন নারীর পাণ্ডিত্য তখনকার সমাজের জন্য সহ্য করা কঠিন ছিল। বরাহমিহির তাঁর পুত্র মিহিরকে আদেশ দিলেন—খনার জিহ্বা কেটে ফেলার জন্য, যাতে তিনি আর কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করতে না পারেন।
কিন্তু খনা জানতেন, তাঁর শব্দগুলো হারিয়ে গেলেও তাঁর জ্ঞান থেকে যাবে মানুষের অন্তরে। তাই মৃত্যুর আগে তিনি সাতদিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁর সমস্ত জ্ঞান মানুষের মধ্যে বিতরণ করলেন। সেই সাতদিনের ভাষণই পরবর্তীকালে 'খনার বচন' নামে পরিচিতি পেল।
এরপর? ইতিহাস বলে, রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করলেন বিদুষী খনা। আর পুরুষতন্ত্র তার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
খনার জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ এতটাই প্রাসঙ্গিক ছিল যে, শত শত বছর পেরিয়েও বাংলার কৃষকসমাজ তাঁর বচন মেনে চলে। যেমন:
খনার এই জ্ঞান লোকশ্রুতি হয়ে বেঁচে আছে, ঠিক যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন।
খনা নিছক একজন ব্যক্তি নন, তিনি এক প্রতীক—নারী স্বাধীনতার, জ্ঞানের শিকল ভাঙার, এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, খনার গল্প কেবল অতীতের নয়, বরং এক অনন্ত প্রতিরোধের প্রেরণা।
তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন, কিন্তু থেমে যাননি। তাঁর জিহ্বা কাটা পড়েছে, কিন্তু তাঁর চিন্তা থেমে যায়নি। খনা আছেন, থাকবেন, নারীদের প্রতিটি উচ্চারিত বাক্যে, প্রতিটি রুদ্ধস্বরে।
বাংলার এই খনার তো উদ্ধত প্রতিভাদের জন্যই হয়তো কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, 'আবার আসিব ফিরে, বঙ্গদেশে গঙ্গাজল বেয়ে... মনে রেখো ও ভারত, তোমারই দু'কান কাটা মেয়ে!'