শেষ আপডেট: 12th February 2023 12:34
আমেরিকার কেনটাকির ফ্লেমিংসবার্গ শহর। সেখানে থাকে ১৮ বছরের ফুটফুটে এক মেয়ে, কাতিয়ে (Katiye)। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে তার, কারণ দেহে বাসা বেঁধেছে মারণরোগ সিস্টিক ফাইব্রোসিস। দিনের অনেকটা সময়ই কাটে ফেসবুকে। তরুণ-তরুণীদের রঙিন ওড়াউড়ি তার খুব ভাল লাগে। ২০০৯ সালে হঠাৎই এক দিন তার চোখে পড়েছিল এক মহিলার ফেসবুক পোস্ট। তাঁর ছেলের হসপিটালে থাকার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন ওই মহিলা। আর কাতিয়ে অবাক হয়েছিল, ওই মহিলার একুশ বছরের ছেলে ডালটনও (Dalton) তারই মতো জেনেটিক অসুখ সিস্টিক ফাইব্রোসিস-এ ভুগছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, এই রোগে মিরাকল না ঘটলে মৃত্যু মোটামুটি নিশ্চিত। রোগীর ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্র পুরোপুরি নষ্ট হতে শুরু করে। একমাত্র উপায় ফুসফুস প্রতিস্থাপন। কিন্তু প্রতিস্থাপিত ফুসফুসও নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এ অসুখে রোগী বাঁচে না বললেই চলে।
[caption id="attachment_79571" align="aligncenter" width="960"] হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ডালটনের এই ছবিটি ফেসবুকে দেখেছিল কাতিয়া[/caption]ওই মহিলার ফেসবুক পোস্টে কাতিয়ে কমেন্ট করেছিল, "যদি তুমি কখনও কথা বলার জন্য কোনও বন্ধু চাও। আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো"। রোগশয্যা থেকেই ডালটন বলেছিল, "আমি কি তোমাকে চিনি ?" কাতিয়ে উত্তর দিয়েছিল, "বন্ধু হতে গেলে চেনাটা বাধ্যতামূলক নয়।" খানিক পরেই কাতিয়ে আবার মেসেজ করেছিল, “আমিও একই অসুখে ভুগি, আমারও তোমার মতো ভীষণ শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু ভেঙে পড়িনি। আমি দেখলাম তুমি হসপিটালে। তোমার জন্য আমার কষ্ট হল। আমি জানি, তোমার আমার নিয়তি। কিন্তু তুমি সেই পর্যন্ত শক্ত থাকবে, তাই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম"।
শুরু হয় দু'জন ফুরিয়ে আসা তরুণ-তরুণীর এক অবাক করা বন্ধুত্ব। রোগের সঙ্গে লড়তে, একে অপরের কাছে অক্সিজেনের মতো দামী হয়ে দাঁড়ায় তারা। ফেসবুকের ইনবক্সে মেসেজ আসছে-যাচ্ছে।
[caption id="attachment_79561" align="aligncenter" width="720"] প্রথম দেখার দিনটাতে[/caption]এক সময়ে বন্ধুত্ব ছাপিয়ে রোগশয্যায় জন্ম নেয় প্রেম (Heartbreaking Lovestory)। বেড়ে ওঠে ভালবাসা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিশ্চিত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা। সিস্টিক ফাইব্রোসিস (cystic fibrosis) তার নিজের নিয়মেই কুরে কুরে খেতে থাকে দু'জনের ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্র। এক সময়ে কাতিয়ে আর ডালটন ঠিক করল, তারা দেখা করবে। ছ'ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে, মিসৌরির সেন্ট চার্লস থেকে ডালটনকে নিয়ে তাঁর মা গেলেন কেনটাকির ফ্লেমিংসবার্গে। সেখানেই যে কাতিয়ে থাকে। ডালটন আর কাতিয়ে আগেই প্ল্যান করেছিল, একটা কন্টিনেন্টাল রেস্টুরেন্টে দেখা করবে তারা। মাথার ওপরে থাকবে নীল আকাশ, আশপাশে থাকবে প্রচুর গাছ।
পরে রোগশয্যায় শুয়ে কাতিয়ের মনে পড়ত তাদের প্রথম দেখার দিনটার কথা, "গাড়ি থেকে নামলাম। ছাদহীন রেস্টুরেন্টের ইটের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিল ডালটন। কালো রোদচশমা পরে। দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছিল ডালটনকে। আমার হার্ট-বিট বেড়ে গিয়েছিল। আমি ওর ডান দিকে গিয়ে বসলাম। বসেই প্রথমে ডালটনের ঠোঁটে চুম্বন করলাম। 'হ্যালো' বলার আগেই। আমি যদিও ওই ধরনের মেয়ে নই, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল ওটাই ঠিক। আমার ডালটনের জন্য।" প্রথম ডেটিং-এর দিনে তারা রোলার কোস্টারে চড়েছিল। সেদিন, কাতিয়ের ১৯তম জন্মদিন উপলক্ষে একটা নেকলেস উপহার দিয়েছিল ডালটন।
[caption id="attachment_79543" align="aligncenter" width="480"] অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়েই কাটে ভ্যালেন্টাইন ডে[/caption]এর পরের দু'বছর অসুখ আর প্রেম দু'জনকেই দ্রুত জড়িয়ে ধরতে থাকে। রোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে ভালোবাসাও। ডালটন দেয় বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু ডাক্তারেরা কাতিয়েকে সতর্ক করে দেন, তাঁরা যেন একেবারেই দেখা না করেন। বিয়ে তো একেবারেই নয়। কারণ ডালটনের শরীরে এক মারাত্মক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটেছে এবং সেটা মারাত্মক সংক্রামক। কাতিয়ের মতো সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগীদের ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত ভাবে প্রাণঘাতী। কিন্তু নাছোড়বান্দা কাতিয়ে উল্টে ডাক্তারেরই কাউন্সেলিং করতে শুরু করে দেয়। সে হেসে ডাক্তারকে বলে, "ডাক্তার, একটা কুড়ি বছরের পানসে বিবর্ণ জীবন বাঁচার চেয়ে আমি পাঁচ বছরের প্রজাপতির মত রঙিন জীবন চাই। পাঁচ বছর আমি জীবনের পূর্ণ স্বাদ নিতে চাই। কুড়ি বছরের ভালোবাসাহীন জীবনে বেঁচে থাকার চেয়ে আমি পাঁচ বছরের ভালোবাসা ও সুখে ভরা জীবন চাইব।"
[caption id="attachment_79601" align="aligncenter" width="702"] বিয়ে করল কাতিয়ে আর ডালটন[/caption]ডাক্তারবাবুরা আর বাধা দেননি। কাতিয়ে আর ডালটনের বিয়ে হয়ে যায়। ডালটন কেনটাকিতে বাড়িও কিনে ফেলে। সারা বাড়ি বিয়ের ফটো আর ইনডোর গেমে ভরে থাকে। কাতিয়ে বলেছিল, "দারুণ ছিল বছরগুলো। আমার জীবনের সেরা সময় কেটেছে। আমরা প্রচুর মজা করেছি, খেয়েছি, দু'জনে দু'জনকে আদর করেছি। রূপকথার গল্পের মতো উড়েছি আকাশে"। দু'জনে প্ল্যান করেছিল সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু তা হয়নি।
Burkholderia cepacia নামে একটি ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ দু'জনকে আলাদা করে দেয় কিছু দিনের মধ্যে। কেনটাকি ছেড়ে মিসৌরিতে মায়ের কাছে চলে যায় ডালটন। তাঁরা দুজনেই সেই সময় ফুসফুস প্রতিস্থাপনের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে ডালটনের শরীরে দাতার ফুসফুস বসানো হয়। কিন্তু কাতিয়ের হেলথ ইনসুরেন্স কোম্পানি জানায়, কাতিয়ের ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা যাবে না। কাতিয়ের স্বাস্থ্য বিমার আওতায় ফুসফুস প্রতিস্থাপনের সুবিধা নেই।
[caption id="attachment_79554" align="aligncenter" width="810"] আছি তো কাছেই[/caption]ডাক্তাররা ডালটনকে জানিয়ে দেন, কাতিয়ে আর এক বছরের বেশি বাঁচবেন না। দিশাহারা ডালটন ফেসবুকে এক মর্মস্পর্শী আবেদন করলেন। মাত্র কয়েকটি বাক্যে, "ওরা আমার স্ত্রীকে একটি সংখ্যা বানিয়ে দিয়েছে। বিমা সংখ্যা। ও যেন একটা পরিসংখ্যান, ডলারের চিহ্ন। আমি কাতিয়েকে হারাতে চাই না। আমাদের ভালোবাসা এখানেই শেষ হতে পারে না। আমরা দু'জনেই লড়াই করতে রাজি। পথের শেষ বাঁকে পৌঁছে, আমাদের আর কোনও উপায় নেই। তাই আপনাদের সাহায্য চাইছি। আমার স্ত্রীকে বাঁচান।"
আমেরিকার মিডিয়া প্রচার করায় ২০১৫ সালে নতুন ফুসফুস পেয়েছিল কাতিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সফল হল না প্রতিস্থাপন। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল কাতিয়ের। চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে না তার ফুলতে থাকা শরীর। শুধু কিডনির ডায়ালিসিস চলছে। কাতিয়ে ডালটনকে ফোনে নিস্তেজ হয়ে আসা গলায় বলেছিলো, "আমি ফ্লোরিডা দেখতে চেয়েছিলাম। জানো, আমি এখনও ভাবি, এই আমি গাড়িতে উঠছি। যাক, ঠিক আছে। আমি স্বর্গ থেকেই ফ্লোরিডা দেখব। এক একটা সময় আসে, যখন সব কিছুই ভুল হতে শুরু করে। আমি খুশি মনেই চলে যেতে চাই পৃথিবী ছেড়ে, কষ্ট পেয়ো না সোনা।"
[caption id="attachment_79576" align="aligncenter" width="720"] যন্ত্রণা ভুলে একটি উষ্ণ চুম্বন[/caption]এ দিকে, ডালটনের শরীরেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় শেষ। এত দিন কাতিয়েকে ডালটন জানায়নি, তার লিম্ফোমা জাতীয় ক্যানসার হয়েছে। ক্যানসারের চিকিৎসা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে, নিউমোনিয়া আর ভাইরাল ইনফেকশনের যুগপৎ আক্রমণে কোমায় চলে যায় ডালটন। সে এখন সেন্ট লুইসের বার্নেস-জিউইস হসপিটালে ভেন্টিলেশনে।
কাতিয়ে চেয়েছিল ডালটনকে চিকিৎসার জন্য কেনটাকি উড়িয়ে নিয়ে যেতে। বলেছিল, “এই অবস্থাতেও যদি আমরা একটা দিন বা রাত একসঙ্গে থাকার সুযোগ পাই, তা হলে আমি সব চেয়ে সুখী হবো।" কাতিয়ে তার মাকে বলেছিল, "জীবন নিয়ে আমার কোনও অনুশোচনা নেই। আবার জন্মালে ডালটনকেই স্বামী হিসেবে চাইব। সে আমাকে আমার জীবনের সেরা বছরগুলি দিয়েছিল।"
[caption id="attachment_79580" align="aligncenter" width="720"] কাতিয়ের ফুস্ফুস প্রতিস্থাপন সফল হল না, হাত ধরেই রইল ডালটন[/caption]মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে ডালটন। কয়েকশো কিলোমিটার দূরে, সবুজ ঘেরা একটি একতলা বাড়ির, বাগানের দিকে মুখ করা ঘরে শুয়ে কাতিয়ে। বিছানায় শুয়ে ডালটনকে ভিডিও কল করল কাতিয়ে। ফোনটি ধরলেন ডালটনের নার্স। কাতিয়ে বিছানায় লেপ্টে যাওয়া, স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসল।
ধীরে ধীরে বলল ,"ডালটন তুমি জানো না, তোমায় আমি কত ভালবাসি। তুমি সাহসী। ভয় পেয়ো না। আমি আসছি"। কাতিয়ে জানে না, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তার ডালটন, তার প্রিয়তমার কথা শুনল কিনা। কিন্তু এটাই ডালটনকে শেষ বিদায় জানানোর একমাত্র পথ ছিল। তারা একে অপরকে শেষ দেখেছে পাঁচ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে। আর পরস্পরকে বিদায় চুম্বন দেওয়ার সুযোগ হয়নি তঁদের।
[caption id="attachment_79584" align="aligncenter" width="720"] পাঁচ বছরের বিবাহ বার্ষিকীর চুম্বনই ছিল শেষ চুম্বন[/caption]চলে গেলো ডালটন। যেদিন ডালটনকে ম্যাপল গাছের তলায় ঠান্ডা মাটির নীচে শুইয়ে দেওয়া হলো, ঠিক তার পরের দিন বিকেল বেলা। কাতিয়ে ঘরের দরজা খুলে দিতে বলেছিল ফিসফিস করে। তার বিছানার চার দিকে ভিড় করে ছি্লেন ডাক্তার, নার্স, কাতিয়ের বাবা, মা, ভাই। সবাই তাকিয়ে ছিলেন কাতিয়ের দিকে। আর, কাতিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল খোলা দরজাটার দিকে।
মৃত্যু যন্ত্রণায় তার সারা শরীর কাঁপছিল। দিগন্তরেখায় বিকেলের সূর্য ঢলে পড়ছিল। হঠাৎ কাতিয়ের স্থির হয়ে থাকা চোখের পাতা পড়ল। আবার খুলল। কাতিয়ে কিছু বলতে চাইছে। জানলা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে সূর্যের শেষ রশ্মি। এক চিলতে হাসি যেন ফুটে উঠল তার শুকিয়ে যাওয়া কালো ঠোঁটে। কাতিয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন মা।
[caption id="attachment_79603" align="aligncenter" width="770"] আর তো নয় বেশিদিন, মিলব আবার দুজনে[/caption]জীবনের শেষ শক্তি একসঙ্গে করে কাতিয়ে ফিসফিস করে বলল , "ওই... ওই দ্যাখো মা, আমার ভ্যালেন্টাইন এসেছে। আমায় নিয়ে চলো ওর কাছে।"
না, কাউকে নিয়ে যেতে হয়নি, কাতিয়ে নিজেই চলে গিয়েছিল ডালটনের কাছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে কাতিয়ের ভাই ঘরের পশ্চিম প্রান্তের জানলাটির কাছে এসেছিল। দু'টি গোলাপরঙা প্রজাপতিকে বাগান থেকে উড়তে উড়তে সীমানার বাইরে চলে যেতে দেখেছিল সে।
মৃত্যু ছিনিয়ে নেওয়া পর্যন্ত প্রিয়তমের হাত ছাড়েনি আতিত্তায়া, বেনজির প্রেমের অনন্য কাহিনি