শেষ আপডেট: 7th August 2022 17:53
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি চাঁদের উলটো পিঠের লেখক। অন্ধকার সমুদ্রগর্ভের নুলিয়া। মানুষের অবচেতন মনের পরিত্রাণহীন লোভ লালসা কুৎসিত কামনা ও দুর্মর রিরংসার নির্মোহ শিল্পী। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনের অদূরে বোলপুরে বসবাস করলেও রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার কুয়াশা থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি রিয়ালিস্টও ছিলেন না পুরোপুরি। বরং ন্যাচারালিস্ট বা যথাস্থিতবাদীদের সঙ্গেই তাঁর লেখনীর আত্মীয়তা ছিল বেশি। মূলধারার বাংলা সাহিত্যের গঙ্গা যমুনা থেকে দূরবর্তী এক ফল্গু তিনি, তিনি জগদীশ গুপ্ত। (Jagadish Gupta)
নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, সংঘাত-ক্লিষ্ট, নিঃসন্তান জগদীশ গুপ্তের মনের একটা দিক রহস্যময়ভাবে ধূসর হয়ে গিয়েছিল। ফলত তাঁর লেখায় চিরাচরিত সৌন্দর্যবোধ, আত্মহারা প্রেম আর হৃদয়ের কোমল অনুভূতিগুলোর দেখাই মেলে না। তাঁর অধিকাংশ গল্প উপন্যাসের চরিত্রেরা ঠগ, প্রতারক, লোভী, কামুক, লম্পট, অবৈধ কামনায় ক্লিন্ন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সমকালে এবং উত্তরকালে আদৌ জনপ্রিয়তা পাননি। কল্লোলের অন্যান্য লেখকদের মতো শৌখিন বাস্তবের মজদুরিও করেননি তিনি। বাঙালি পাঠক মূলত রোমান্টিক। তারা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি'র রোমান্টিক রিয়ালিজম, কিংবা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'বেদে' উপন্যাসের সিন্থেটিক রিয়ালিজম পছন্দ করলেও 'অসাধু সিদ্ধার্থ' বা 'লঘুগুরু' উপন্যাসের ডার্ক রিয়ালিজমকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। পাঠকের ইচ্ছাপূরণের গল্প লেখেননি বলেই বাঙালি পাঠক তাঁকে ভালোবেসে গ্রহণ করতে পারেনি। আসলে মানুষ আত্মদর্শনে ভয় পায়। নিজের মনের অন্ধকার, বিকৃত, পচা গলা, নিষ্ঠুর ও বীভৎস দিকটিকে মেলে ধরে পাঠককে জ্বলন্ত আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন জগদীশ গুপ্ত। নিজেদের ভেতরকার সেই লোভী হায়না আর কদর্য সরীসৃপকে তাঁর গল্পে লক্ষ করে আমাদের চরম অস্বস্তি হয়।
বাংলা কথাসাহিত্যের এক বিরল ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী জগদীশচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭)। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন মূল স্রোতের বাইরের লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন: 'তিনি কোনও কালেই সাধারণ পাঠকের হৃদয় জয় করতে পারেননি। ইদানীং যিনি সমালােচক ও গবেষকদের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ।' (Jagadish Gupta)
আবেগপ্রবণ বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন এক অকপট নগ্নজীবন-দর্শনের রূপকার। সেই স্বধর্ম থেকে চ্যুত হয়ে সস্তা পাঠকের মনােরঞ্জন করে রাতারাতি জনপ্রিয়তা অর্জনের সুলভ পথ গ্রহণ করেননি তিনি। কথাশিল্পী হিসাবে এই অনমনীয় সততার কারণেই একশ বছর অতিক্রম করেও বাংলাসাহিত্যে স্বাতন্ত্র্যে দীপ্যমান হয়ে আছেন জগদীশ গুপ্ত।
রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্তির ছটফট নিয়ে অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়রা তখন ভিড় করেছিলেন 'কল্লোল' (১৯২৩), 'কালিকলম' (১৯২৬), 'প্রগতি' (১৯২৭) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়। জগদীশ গুপ্ত 'কল্লোল'-গােষ্ঠীর লেখক হলেও বয়সে তিনি কল্লোলের তরুণ লেখকদের চাইতে কিছুটা প্রবীণ ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৩৭। কল্লোলের তরুণ বন্ধুদের তিনি লিখেছিলেন:
'আমার বয়স আপনাদের প্রায় সমানই, দেহের না হােক, মনের।'
বস্তুত কল্লোল গোষ্ঠীর যা আদর্শ ছিল তা প্রকৃত অর্থে জগদীশ গুপ্তের মধ্যেই নিহিত ছিল। কল্লোল-গােষ্ঠীর লেখকরা ছিলেন ভাবের সমুদ্রে শৌখিন বাস্তবতার বিহঙ্গ। যথার্থ নির্মোহ জীবনদৃষ্টিকে তাঁরা আয়ত্ত করতে পারেননি। কিন্তু জগদীশ গুপ্ত ছিলেন সত্যিকার নির্মোহ জীবনশিল্পী। কোদালকে তিনি কোদাল বলতে জানতেন। কামকে তিনি রোমান্টিকতার আবরণে অযথা রঙিন করে দেখাননি। তাঁর 'পুরাতন ভৃত্য' রবীন্দ্রনাথের পুরাতন ভৃত্যের মতো আত্মত্যাগে মহান নয়, বরং সে লোভী, প্রতারক ও ঘাতক। ভাবাবেগের রঙিন চশমা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জীবনকে তিনি আকাঁড়া সাদা চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। (Jagadish Gupta)
জগদীশ গুপ্তের পৈতৃকনিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার খোর্দ মেঘচারমি গ্রামে। বাবা কৈলাশচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন কুষ্টিয়া আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী। পিতার কর্মসূত্রে জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া জেলার আমলাপাড়ায় ১২৯২ বঙ্গাব্দের ২২ আষাঢ় (৫ জুলাই, ১৮৮৬) জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে কলকাতা সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে এফ. এ পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট থেকে শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শিখে নেন। টাইপিস্টের কাজ নিয়ে তিনি উড়িষ্যার সম্বলপুর, বিহারের পাটনা থেকে বীরভূম জেলার বোলপুর সহ নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন। মাঝে কিছুদিন ঝর্ণা-কলমের কালি তৈরির ব্যবসা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
শৈশব থেকেই যাবতীয় রোমান্টিকতার বিপরীত মেরুর মানুষ জগদীশ গুপ্ত। ভাওয়ালের আদিরসাত্মক কবি গােবিন্দচন্দ্র দাসের তীব্র দেহবাদ তাঁকে আকৃষ্ট করত। প্রথম থেকেই তিনি পুরোনো বিশ্বাসের গোড়ায় চরম আঘাত করার চেষ্টা করেছিলেন। দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নাস্তিকতা, প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাস তাঁর চেতনাতেও বর্তমান ছিল। ঈশ্বর তাঁর চোখে এক কদর্য শয়তান। ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন:
"বিশ্ব-প্রবাহের মূলে এক অমােঘ শক্তির অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেছেন, যা একান্তরূপে বিনাশক, ক্রুর এবং কদর্য।"
তাঁর প্রথম গল্প 'পেয়িংগেস্ট' (১৩৩১ বঙ্গাব্দ ‘বিজলী’ পত্রিকা)। প্রথম গল্পগ্রন্থ 'বিনােদিনী' (১৯২৭)।
সম্পূর্ণ নতুন ধারার ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির এই গল্প সংকলন পাঠ করে সেসময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: 'তােমার গল্পে নূতন রূপ ও রস দেখিয়া খুশি হইলাম।'
নির্মম নির্মোহ ভঙ্গিতে মানব হৃদয়ের কুটিল ও গভীরতম স্বরূপ উদ্ঘাটনের দৃষ্টান্ত এর আগে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়নি। রবীন্দ্র-চেতনাকে ধাক্কা দেবার উদ্দেশ্যেই তিনি এই সংকলনে একেবারে বিপরীত মেরুর এক নিষ্ঠুর পুরাতন ভৃত্যকে এঁকেছেন। 'প্রলয়ংকরী ষষ্ঠী’ গল্পে দেখি, মহাজন সদু খাঁ জসিমের বৌকে ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। জসিম বহু কৌশলে স্ত্রীকে উদ্ধার করে। কিন্তু 'জসিম তার বৌকে ফিরে পায় না। কারণ তার বৌ নিজেই ফিরে আসতে চায়নি।
‘পয়ােমুখম্' এক লোভী কবিরাজের গল্প। কবিরাজ কৃষ্ণকান্ত ছেলে ভূতনাথের বারবার বিয়ে দেন শুধুমাত্র পণের লোভে। পণের টাকা ফুরোলেই আশ্চর্যজনকভাবে কলেরায় বধূটির মৃত্যু হয় এবং ভূতনাথের আবার বিয়ে দেওয়া হয়। তৃতীয় বধূটিকেও একইভাবে হত্যার চেষ্টা করা হলে ছেলের কাছে ধরা পড়ে যান কৃষ্ণকান্ত। ভূতনাথ একটু তির্যক হাসি হেসে বিষাক্ত ওষুধটা ফিরিয়ে দিয়ে বাবাকে বলে: 'এই বৌটার পরমায়ু আছে, তাই কলেরায় মরল না, বাবা।….. পারেন তাে নিজেই খেয়ে ফেলুন।'
সাধে কি আর অধ্যাপক সুবীর রায়চৌধুরী বলেছিলেন— 'জগদীশ গুপ্ত আগাগােড়া তিক্ত, রুক্ষ ও নৈরাশ্যবাদী। তাঁর লেখা পড়লে আমাদের মূল্যবােধগুলি প্রচণ্ডভাবে নাড়া খায় এবং আমরা স্বভাবতই অস্বস্তিবােধ করি।'
তাঁর 'আদি কথার একটি' গল্পে এক বিধবা শাশুড়ির সঙ্গে জামাইয়ের অসামাজিক সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে অকপটে। 'চন্দ্র-সূর্য যতদিন' গল্পে শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে এক ব্যক্তি একই পরিবারের দুই বোনকে বিয়ে করে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে বড় বোনের যৌন ঈর্ষা। গল্পে দেখি, শাশুড়ির নির্দেশে ছােটো বউয়ের প্রতি অধিক লুব্ধ স্বামীর বিছানায় যেতে হয়েছে বড়াে বউকে। কিন্তু প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় সে পাগল হয়ে গেছে।
'পারাপার' গল্পে স্বামীর সঙ্গে পরিচারিকার অবৈধ যৌন সম্পর্কের গোপন কথা তুলে ধরা হয়েছে। 'পৃষ্ঠে শর লেখা' গল্পে ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে বাবা নিজেই মুগ্ধ হয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করে। 'লােকনাথের তামসিকতা' গল্পে ছেলের জন্য সুন্দরী পাত্রী নির্বাচন করেও বাবা পরে তাকে বাতিল করে দেয়, কারণ তার মনে হয়, তার নিজের স্ত্রী তো এত সুন্দরী নয়। পুত্রকে কেন্দ্র করে পিতার এই যৌন ঈর্ষা আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধের ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয়। 'শঙ্কিতা অভয়া' গল্পে স্ত্রী অভয়া যে কন্যাকে নিয়ে নতুন স্বামীর কাছে পালিয়ে এসেছিল, সেই স্বামীর সঙ্গেই তরুণী কন্যার অবৈধ সম্পর্কের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। অভয়া ভাবে, স্বামী যদি তাকে মুগ্ধ করতে পারে, তবে তার যুবতী মেয়েকেও পারবে। এখানেও একজন পুরুষকে কেন্দ্র করে মা ও মেয়ের যৌন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস ফুটে উঠেছে।
'অসাধু সিদ্ধার্থ' উপন্যাসে নটবরের দুটি সত্তা। সিদ্ধার্থ নাম নিয়ে একদিকে সে সুস্থ জীবনযাপন করতে ইচ্ছুক। কিন্তু নটবর আসলে 'ব্রাহ্মণের জারজপুত্র’, 'বৃদ্ধা বেশ্যার শয্যাচর' এবং অর্থলােভী। এই দুই সত্তার দ্বন্দ্বই এই উপন্যাসের প্রাণকেন্দ্র।
শার্ল বোদলেয়ারের সঙ্গে জগদীশ গুপ্তের চিন্তা ও চেতনার যথেষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। বোদলেয়ারের কবিতার বিষয়বস্তু ছিল বিতৃষ্ণা, বিষাদ, নির্বেদ, অন্ধকার কামনা-বাসনা, ইন্দ্রিয়াসক্তি, পতিত ও পতিতার জীবন, হিংসা, অসূয়া, লোভ, মদ ও মৃত্যু। তাঁর কবিতা মায়াময় নয়। গোতিয়ে, মালার্মে বা রবীন্দ্রনাথের মত গুরু নন তিনি। এজরা পাউণ্ড বা এলিয়টের মত কোনও আন্দোলনের নায়ক নন। গ্যেটের মত স্বর্গের মহান দার্শনিক হওয়ার পরিবর্তে তিনি নরকের নিপীড়ন উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। ‘ক্লেদজ কুসুম’-এ তিনি পঙ্কজের চাইতে পাঁককেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কবিতায় শার্ল বোদলেয়ার যে জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যে জগদীশ গুপ্ত সেই জগতের স্রষ্টা। তাঁর গল্প-উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের 'ক্লেদজ কুসুম'। (Jagadish Gupta)
সাহিত্যিক আড্ডায় তেমন আগ্রহী ছিলেন না জগদীশ গুপ্ত। নিজের লেখার প্রতি তাঁর ছিল অসম্ভব মর্যাদাবোধ। একবার জনৈক প্রকাশক অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে তাঁর একটি উপন্যাসকে আরও খানিকটা দীর্ঘ করার অনুরোধ জানালে তিনি তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন: "যে উপন্যাস যেখানে যখন সমাপ্ত হওয়া প্রয়োজন এবং যে ঘটনা বিস্তারের যতটুকু ক্ষেত্র আছে, তার বেশি কোনো ফরমাসী লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"
তাঁর স্ত্রী চারুবালা গুপ্ত স্বামীর স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন:
"মানুষ হিসেবে উনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা, অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ, আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রচণ্ড তীব্র। অত্যন্ত কম কথা বলতেন। তবে হঠাৎ করে এমন একটা কড়া কথা অথবা এমন একটা রসিকতা করতেন যেটা আমাদের কাছে কিছুটা আশ্চর্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি বেশ উদাসীন ছিলেন। কোনওরকম কুসংস্কার ওঁর মধ্যে দেখিনি। এমনকি ঠাকুর দেবতার সম্পর্কেও ওঁর কোন বাড়াবাড়ি দেখি নি।"
কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে স্নান করে পুষ্ট হয়েছে তাঁর শৈশব। যেখানে তাঁর ছোটোবেলা কেটেছিল তার কাছেই ছিল গণিকাপল্লী। তিনি সেই পল্লীর উঠোনেই খেলাধুলো করে বড় হয়েছেন। পরবর্তীকালে গণিকা-জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর 'লঘুগুরু' উপন্যাসের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সমালোচনায় অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন জগদীশ গুপ্ত।
'লঘু-গুরু' উপন্যাসে তিনি যে সমাজের বর্ণনা দিয়েছেন তা রবীন্দ্রনাথের কাছে বাস্তব বলে মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসটির দীর্ঘ সমালোচনা করেছিলেন 'পরিচয়' পত্রিকায়। সেখানে তিনি উপন্যাসটির মৌলিক ত্রুটি তুলে ধরতে গিয়ে লেখককে প্রায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসেন। সেদিন ঠিক কী লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
"এ-দেশে লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে কাটালুম, এই উপন্যাসের অবলম্বিত সমাজ তার পক্ষে সাত-সমুদ্র-পারের বিদেশ বললেই হয়। দূর থেকেও আমার চোখে পড়ে না। লেখক নিজেও হয়তো বা অনতিপরিচিতের সন্ধানে রাস্তা ছেড়ে কাঁটাবন পেরিয়ে ও-জায়গায় উঁকি মেরে এসেছেন। আমার এই সন্দেহের কারণ হচ্ছে এই যে, লেখক আমাদের কাছে তাঁর বক্তব্য দাখিল করেছেন, কিন্তু, তার যথেষ্ট সমর্থন যোগাড় করতে পারেননি।"
উত্তরে জগদীশ গুপ্ত লিখেছিলেন, এ তো আসামীকে ছেড়ে আসামীর জনককে আক্রমণ করা হল :
"লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে এতকাল আমাকে কাটাইতে হইয়াছে সেখানে ‘স্বভাবসিদ্ধ ইতর’ এবং ‘কোমর বাঁধা শয়তান’ নিশ্চয়ই আছে; এবং বোলপুরের টাউন-প্ল্যানিং-এর দোষে যাতায়াতের সময় উঁকি মারিতে হয় নাই, ‘ও-জায়গা’ আপনি চোখে পড়িয়াছে। কিন্তু, তথাপি আমার আপত্তি এই যে, পুস্তকের পরিচয় দিতে বসিয়া লেখকের জীবন-কথা না তুলিলেই ভাল হইত, কারণ, উহা সমালোচকের ‘অবশ্য-দায়িত্বের বাইরে’ এবং তাহার ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ’ ছিল না।"
তাঁর গল্পে যৌনতা অশ্লীল নয়, বরং এক স্বাভাবিক প্রেষণা। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত আবেগে ও যত্নে সাহিত্যের যে জগৎ নির্মাণ করেছিলেন জগদীশ গুপ্ত সেই জগতে এক অপ্রত্যাশিত ধূমকেতু। পাঠকের অবহেলায় তাঁর বহু গল্প হারিয়ে গেছে। তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ হত না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁকে অধিকাংশ পাঠকের কাছে অনুপস্থিত বলেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়ায় অভিমানী জগদীশ গুপ্ত লিখেছিলেন :
"এই একটি শব্দ ‘অনুপস্থিত’ শব্দটি আমার সঙ্গে পাঠকের যোগরেখা চমৎকার নির্বিশেষভাবে দেখাইয়া দিয়াছে। একটি শব্দের দ্বারা এতটা সত্যের উদ্ঘাটন আমার পক্ষে ভয়াবহ হইলেও আনন্দপ্রদ। সরল ভাষায় কথাটার অর্থ এ-ই যে, অনেকেই আমার নাম শোনেন নাই।"
জগদীশ গুপ্তের উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে:
গল্পগ্রন্থ: বিনোদিনী (১৩৩৪); রূপের বাহিরে (১৩৩৬); শ্রীমতী (১৩৩৭); উদয়লেখা (১৩৩৯); শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী (১৩৪১); মেঘাবৃত অশনি (১৩৫৪); স্বনির্বাচিত গল্প (১৩৫৭)
উপন্যাস: অসাধু সিদ্ধার্থ (১৩৩৬); লঘুগুরু; দুলালের দোলা (১৩৩৮); নিষেধের পটভূমিকায় (১৩৫৯); কলঙ্কিত তীর্থ (১৩৬৭); রোমন্থন।
কবিতা-সঙ্কলন: অক্ষরা।
কল্লোলের লেখকেরা ছিলেন বাইরে রবীন্দ্রবিরোধী, অন্তরে রবীন্দ্রভক্ত। তাঁরা যা হতে চেয়েছিলেন তা হতে পারেননি। কিন্তু জগদীশ গুপ্তই ছিলেন একেবারে খাঁটি অর্থে অ-রাবীন্দ্রিক। তিনিই প্রকৃত কল্লোলীয়ান। অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এই সত্যটি-
"জগদীশ গুপ্ত কল্লোলের কালবর্তী এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও সত্য যে কল্লোলের যা মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ছিল তা একমাত্র জগদীশ গুপ্তের রচনাতেই অভিব্যক্ত।"
১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল জগদীশ গুপ্ত মারা যান। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের নতুন মাইলস্টোনের সম্মান যাঁর প্রাপ্য ছিল তিনি চলে গেলেন নিতান্ত অবহেলায়, অনাদরে, উপেক্ষায়, কোনও রকম স্বীকৃতি ও সম্মান না পেয়ে, ভয়াবহ দারিদ্র্য আর অর্থকষ্টের মধ্যে। কিন্তু এসব নিয়ে তাঁর অন্তরে কোনও অভিযোগ ছিল না। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘নরনারীর মনের গতির পরিচয় কিছু কিছু যদি এতদিন না দিয়া থাকি, তবে আমার লেখা বৃথা হইয়াছে।’