
Inspirational story of Hiroo Onoda
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দেশ জাপানের (Japan) বৃহত্তম দ্বীপ হল হোনশু (Honshu)। এই দ্বীপেরই কামেকাওয়া গ্রামে, ১৯২২ সালের ১৯ মার্চ জন্মেছিলেন হিরু ওনোডা (Hiroo Onoda)। স্কুলের পড়া শেষ হওয়ার পর, ১৯৩৯ সালে ওনোডা চলে গিয়েছিলেন সাংহাই। একটি জাপানি বাণিজ্য সংস্থায় কাজ করতে। এশিয়ার বাতাসে তখন ভেসে বেড়াচ্ছিল বারুদের গন্ধ। শুরু হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (second world war)। অক্ষশক্তিতে থাকা জাপান, জার্মানি, ইতালি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার প্রলয়ঙ্কারী লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল মিত্রশক্তিতে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও চিনের (Inspirational story)।
যুদ্ধে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছিল জাপান। দেশের হয়ে লড়ার জন্য, ১৯৪২ সালে সাংহাই থেকে জাপানে ফিরে এসেছিলেন ওনোডা (Hiroo Onoda)। যোগ দিয়েছিলেন নাকানো কমান্ডো স্কুলে। কিছুদিন পরেই কয়েক হাজার কমান্ডোর মধ্যে থেকে আলাদা করে নেওয়া হয়েছিল ওনোডাকে (Hiroo Onoda)। কারণ তাঁর মধ্যে সেরা গুপ্তচর হওয়ার কিছু গুণ আবিষ্কার করেছিলেন জাপানের সেনাকর্তারা। তাই ওনোডাকে দেওয়া হয়েছিল এক বিশেষ ধরণের ট্রেনিং। শেখানো হয়েছিল ইতিহাস, দর্শন, মার্শাল আর্ট, গেরিলা যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাতমূলক অপারেশনের খুঁটিনাটি। মাত্র দু’বছরের মধ্যেই জাপানের সেরা গুপ্তচর হয়ে উঠেছিলেন ২২ বছরের ওনোডা (inspirational story)।
রণক্ষেত্র লুবং (Inspiration story)
ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর, ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে লেফটেন্যান্ট ওনোডাকে (Hiroo Onoda) পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফিলিপিন্স। হেলিকপ্টার করে তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়ে ছিল, ম্যানিলার ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকা দ্বীপ লুবংয়ে। ওনোডার কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশিমি তানিগুচি দিয়েছিলেন কিছু অবিশ্বাস্য আদেশ।
জাপানের অধিকারে থাকা লুবং দ্বীপের ওপর নেমে আসা মার্কিন আক্রমণে বিঘ্ন ঘটাতে হবে। অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ডুবিয়ে দিতে হবে মার্কিন জাহাজ। ধ্বংস করে দিতে হবে এয়ার-স্ট্রিপ। এবং এ সব কিছুই করতে হবে অত্যন্ত গোপনে। ধরা পড়া চলবে না কোনও অবস্থাতেই। ধরা পড়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকলে করতে হবে আত্মহত্যা।
কমান্ডিং অফিসারের কথা শিরোধার্য করে, গোপন অপারেশন শুরু করে দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট ওনোডা (Hiroo Onoda)। একের পর এক অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন মার্কিন বাহিনীকে। বাধ্য হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লুবং দ্বীপের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছিল মার্কিন বিমানবাহিনী। তছনছ করে দিয়েছিল লুবং দ্বীপে থাকা জাপানি ক্যাম্পগুলি। প্রাণ হারিয়েছিল প্রচুর জাপানি সেনা। (inspirational story)
এরপর, ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, দ্বীপে নেমে পড়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনী। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল দ্বীপে থাকা জাপানি সেনারা। রাতের অন্ধকারে দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল কিছু সেনা। তাঁদের সঙ্গেই দ্বীপ ছাড়তে চেয়েছিলেন ওনোডা (Hiroo Onoda)। কিন্তু অনুমতি মেলেনি কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে।
ওনোডাকে মেজর তানিগুচি বলেছিলেন, “তুমি আত্মসমর্পণ বা আত্মহত্যা করবে না। দ্বীপ ছেড়ে পালাবে না। তোমার তিন সহযোদ্ধাকে নিয়ে চালিয়ে যাবে অন্তর্ঘাত। আমি আবার আসবো। তোমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। সেটা পাঁচ বছর পরে হলেও, আমিই আসব।” এর পর কমান্ডিং অফিসারকে স্যালুট করে ওনোডা (Hiroo Onoda) চেয়ে নিয়েছিলেন মেজরের তরবারি। তারপর তাঁর দলের তিন গেরিলা যোদ্ধা ইউচি আকাৎসু, কিনশিচি কোজুকা ও শোইচি শিমাদাকে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন লুবংয়ের দুর্ভেদ্য অরণ্যে।
শুরু হয়েছিল এক নতুন যুদ্ধ
দুর্ভেদ্য অরণ্যের মধ্যে ওনোডা (Hiroo Onoda) আবিষ্কার করেছিলেন একটি গুহা। একটি টিলার দুর্গম অংশে থাকা গুহাটিতে জমা করেছিলেন প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। এরপর তাঁর তিন সঙ্গীকে নিয়ে ওনোডা শুরু করেছিলেন এক অবিশ্বাস্য লড়াই। রাতের অন্ধকারে টিলা থেকে নেমে আগুন লাগিয়ে দিতেন মার্কিন সেনাদের ক্যাম্পে। উত্তাল সমুদ্রে ডুব সাঁতার কেটে মার্কিন জাহাজের নিচে লাগিয়ে আসতেন টাইম বোমা। এভাবেই প্রায় ছ’মাস ধরে অন্তর্ঘাত চালিয়ে গিয়েছিলেন ওনোডা (Inspiration story)।
কিন্তু ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট, মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল জাপান। শেষ হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। লুবং দ্বীপ থেকে দেশে ফেরার পথ ধরেছিল মার্কিন সেনারা। কিন্তু সে খবর পৌঁছায়নি, লুবং দ্বীপের গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকা ওনোডা (Hiroo Onoda) ও তাঁর তিন সহযোদ্ধার কাছে। তাঁরা তখনও চালিয়ে যাচ্ছিলেন অন্তর্ঘাত। ধ্বংস করতে শুরু করেছিলেন স্থানীয় মানুষদের ঘর বাড়ি, শস্যক্ষেত্র ও ধানের গোলা। কারণ স্থানীয় মানুষদের মধ্যে অনেকেই ছিল আমেরিকার চর।
অরণ্যের আকাশে ফাইটার জেট
১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাস। অরণ্যের আকাশে উড়ে এসেছিল জাপানের ফাইটার জেট। ছড়িয়ে দিয়েছিল জাপানি ভাষায় লেখা হাজার হাজার লিফলেট। তাতে লেখা ছিল, “কয়েকমাস আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে যুদ্ধ। স্থানীয় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করো তোমরা।” লিফলেটের নিচে ছিল জাপানি জেনারেল তামোইউকি ইয়ামাশিতার সই।
কিন্তু ওনোডার মনে হয়েছিল এটা মার্কিন বাহিনীর একটি চাল। কারণ জাপানি হরফে লেখা বাক্যগুলিতে বানান ভূল ছিল। তাই ওনোডা (Hiroo Onoda) তাঁর তিন সাথীকে বলেছিলেন,”আমি প্রাণ থাকতে আত্মসমর্পণ করবো না। আমাকে দেওয়া আদেশ যদি আমি পালন করতে না পারি, চিরকালের জন্য জাতির কাছে কাপুরুষ হয়ে থেকে যাব।” (Inspirational story)
অধিনায়কের কথা মেনে নিয়েছিলেন আকাৎসু, কোজুকা ও শিমাদা। শত্রুহীন দ্বীপে চার জাপানি গেরিলা চালিয়ে গিয়েছিলেন অন্তর্ঘাতের কাজ। একই সঙ্গে শুরু হয়েছিল বিপদসংকুল অরণ্যে টিকে থাকার লড়াই। কলা ও নারকেল হয়ে উঠেছিল তাঁদের প্রধান খাদ্য। অরণ্যের কিনারায় থাকা গ্রামগুলিতেও গভীর রাতে হানা দিতেন চার গেরিলা। চুরি করে আনতেন ছাগল, ভেড়া, হাঁস ও মুরগি। অরণ্যের গভীরে নিয়ে গিয়ে ঝলসে খেতেন। অতিরিক্ত মাংস পুঁতে রাখতেন নোনা মাটিতে। পরে খাওয়ার জন্য।
শুরু হয়েছিল এনকাউন্টার
ওনোডাদের অতর্কিত হানায় ত্রাহিত্রাহি রব উঠেছিল স্থানীয় গ্রামগুলিতে। গ্রামবাসীরা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে কিছু জাপানি সেনা, গ্রামের পর গ্রামে হামলা চালিয়ে চলেছে। লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে পশুপাখি। শুধু তাই নয়, রাতের অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি, ধানের গোলা ও শস্যক্ষেত্রে। তাদের গুলিতে প্রাণও হারিয়েছেন কয়েকজন গ্রামবাসী। এরপর ওনোডাদের (Hiroo Onoda) মারার জন্য চিরুনি তল্লাশি শুরু করেছিল ফিলিপিনো পুলিশ। কমান্ডো দিয়ে সাহায্য করেছিল আমেরিকাও।
বিপক্ষের গুলির শব্দ পেয়ে আবারও ভুল বুঝেছিলেন ওনোডা (Hiroo onoda)। তিনি ভেবেছিলেন, শেষ হয়নি বিশ্বযুদ্ধ। তাইতো আবার আক্রমণ শুরু করেছে মার্কিন সেনারা। তিন সাথীকে নিয়ে তাই ওনোডা চলে গিয়েছিলেন অরণ্যের আরও গভীরে। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে আসা ফিলিপিনো ও মার্কিন কমান্ডোদের ওপর শুরু করেছিলেন ভয়ঙ্কর আক্রমণ। ওনোডার নিপুণ নিশানায় একে একে প্রাণ হারাতে শুরু করেছিল ওনোডার ও তাঁর তিন সঙ্গীর প্রাণ নিতে আসা কমান্ডোরা (inspirational story)।
দলে ধরেছিল ভাঙন
ওনোডার বিশ্বস্ত সাথী ইউচি আকাৎসু, ১৯৫০ সালে ফিলিপিনো পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আকাৎসু পুলিশকে দিয়েছিলেন ওনোডা (Hiroo Onoda) ও দুই সঙ্গী সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য। জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ফিলিপিন্স। অন্যদিকে আকাৎসু দল ছেড়ে পালাবার পর, আরও সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন ওনোডা। তিনি জানতেন এবার তাঁদের ডেরার খোঁজে পাবে শত্রুপক্ষ। প্রায় প্রতিদিনই তাই ডেরা বদলাতে শুরু করেছিলেন (Inspirational story)।
অরণ্যের আকাশে একদিন আবার উড়ে এসেছিল জাপানি ফাইটার। ছড়িয়ে দিয়েছিল নতুন লিফলেট। এই লিফলেটগুলিতে ছিল ওনোডা ও তাঁর দুই সহযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের ছবি। লিফলেটে লেখা ছিল,”এই শেষ সুযোগ। দ্রুত আত্মসমর্পণ করো। না হলে আর কোনও দিনই দেশে ফিরতে পারবে না তোমরা।” সেদিনও লিফলেটে লেখা বাক্যগুলিকে বিশ্বাস করেননি ওনোডা (Hiroo Onoda)। করেননি আত্মসমর্পণ। এরপর আর ফিরে আসেনি জাপানি বিমান।
রইল বাকি এক (Hiroo Onoda)
ওনোডা ও তাঁর দুই সঙ্গীর কাছে প্রতিটি দিনই ছিল বিশ্বযুদ্ধ। একই সঙ্গে তাঁদের লড়তে হচ্ছিল অরণ্যের ভয়ঙ্কর পরিবেশ ও বিপক্ষের রাইফেলের বিরুদ্ধে। ১৯৫৪ সালে, হঠাৎই ফিলিপিনো কমান্ডোদের রাইফেলের নাগালে এসে গিয়েছিলেন শোইচি শিমাদা। অতর্কিতে ছুটে আসা গুলি উড়িয়ে দিয়েছিল শিমাদার মাথার খুলি। এরপর শিমাদার অসমাপ্ত লড়াই লড়তে শুরু করেছিলেন, লেফটেন্যান্ট ওনোডা (Hiroo Onoda) ও জওয়ান কোজুকা।
দু’জনের কেউই জানতেন না, কবেই থেমে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পালটে গিয়েছে পৃথিবী। শুরু হয়ে থেমে গিয়েছে কোরিয়া যুদ্ধ। আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন মার্টিন লুথার কিং ও জন এফ কেনেডি। তৈরি হয়েছে বার্লিনের পাঁচিল। বিশ্বকে সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে দিয়েছে বিটলস। মানুষের পা পড়েছে চাঁদের মাটিতে। শুরু হয়েছে রক্তক্ষয়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ। তাই নিজেদের অজান্তেই হিরু ওনোডা ও কিনশিচি কোজুকা লড়ে চলেছিলেন অস্তিত্বহীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কারণ কমান্ডারের কাছ থেকে আসেনি দেশে ফিরে যাওয়ার আদেশ। ওনোডাকে (Hiroo Onoda) ফিরিয়ে নিতে আসেননি, কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশিমি তানিগুচি।
আরও পড়ুন: অভিশপ্ত ‘ফ্লাইট-সেভেন্টি থ্রি’, মৃত্যুর আগে নীরজা বাঁচিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকশো বিমানযাত্রীকে
শুরু হয়েছিল একার লড়াই
অস্তিত্বহীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লড়তে লড়তে ওনোডা (Hiroo Onoda) ও কোজুকা কাটিয়ে ফেলেছিলেন আঠেরো বছর। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাস। স্থানীয় এক গ্রামে রাতের অন্ধকারে হানা দিয়েছিলেন ওনোডা ও কোজুকা। ধানের গোলার ওপর লুকিয়ে ছিল ফিলিপিনো পুলিশের স্নাইপার। চিতাবাঘের মত হামাগুড়ি দিয়ে দুই জাপানি গেরিলা গ্রামের কাছে আসতেই, গুলি চালিয়েছিল স্নাইপার। ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল কিনশিচি কোজুকার হৃদপিণ্ড।
শুরু হয়েছিল ওনোডার একার লড়াই। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মেজর তানিগুচির আদেশ পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওনোডা। ১৯৫৯ সালেই ওনোডা ও কোজুকাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল জাপান। কিন্তু কোজুকার মৃত্যুর পর, জাপান বুঝতে পেরেছিল বেঁচে আছেন লেফটেন্যান্ট ওনোডা (Hiroo Onoda)। কিন্তু কীভাবে নাছোড়বান্দা এই যোদ্ধাকে আত্মসমর্পণ করাবে, তা ভেবে উঠতে পারেনি জাপান।
অভিযাত্রী সুজুকি পেয়েছিলেন খোঁজ
জাপানের তরুণ অভিযাত্রী নোরিও সুজুকিকে নাড়া দিয়েছিল লেফটেন্যান্ট ওনোডার কাহিনি। কাউকে কিছু না জানিয়ে, ১৯৭৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, সুজুকি পৌঁছে গিয়েছিলেন লুবং দ্বীপে। বিপদসঙ্কুল অরণ্যের গভীরে টানা চারদিন খুঁজেও দেখা মেলেনি ওনোডার (Hiroo Onoda)। বাধ্য হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি, ফেরার পথ ধরেছিলেন সুজুকি। হঠাৎই এক ঝোপের ভেতর থেকে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ওনোডা। হাতে উদ্যত রাইফেল (Inspirational story)।
সুজুকিকে গুলি করার জন্য ট্রিগারে আঙুল রেখেছিলেন ওনোডা (Hiroo Onoda)। জাপানি ভাষায় সুজুকি বলে উঠেছিলেন,” ওনোডা তুমি সূর্য। জাপানের সম্রাট ও দেশবাসী তোমার জন্য চিন্তিত।” ট্রিগার থেকে আঙুল সরে গিয়েছিল ওনোডার। বসে পড়েছিলেন সুজুকির পাশে। সুজুকি ওনোডাকে বলেছিলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গিয়েছে ২৯ বছর আগেই। আজও তোমার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী। ” সুজুকির কথা বিশ্বাস করেননি ওনোডা। হিমশীতল গলায় বলেছিলেন, “মেজর তানিগুচির কাছ থেকে দায়িত্ব ছাড়ার আদেশ এখনও আসেনি। তাই আমার ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। আমি একাই চালিয়ে যাব যুদ্ধ।” (inspirational story)
ফিরে এসেছিলেন মেজর তানিগুচি
ওনোডার (Hiroo Onoda) ছবি তুলে সুজুকি ফিরে গিয়েছিলেন জাপানে। যোগাযোগ করেছিলেন জাপান সরকারের সঙ্গে। জাপান খুঁজতে শুরু করেছিল ওনোডার কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশিমি তানিগুচিকে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর তখন চালাচ্ছিলেন বইয়ের দোকান। খুঁজে পাওয়ার পর মেজর তানিগুচিকে বলা হয়েছিল, তাঁকে যেতে হবে ফিলিপিন্স। ডিউটি থেকে রিলিজ দিতে হবে এক জাপানি সেনাকে। যাঁকে ২৯ বছর আগে মেজর দিয়েছিলেন, একটি বিশেষ দায়িত্ব পালনের আদেশ।
জাপানি বিমানে করে হতবাক তামাগুচি পৌঁছে গিয়েছিলেন লুবংয়ে। সঙ্গে ছিলেন অভিযাত্রী সুজুকি ও অনান্য সেনা অফিসারেরা। ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ, অরণ্যের সেই জায়গায় পৌঁছে, নিজের পরিচয় দিয়ে ওনোডোকে বেরিয়ে আসতে বলেছিলেন মেজর তামাগুচি। অরণ্য ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ময়লা ইউনিফর্ম পরা লেফটেন্যান্ট হিরু ওনডো (Hiroo Onoda)। মাথায় টুপি। হাতে আরিসাকা নাইন্টিনাইন রাইফেল সার্ভিস রাইফেল। কোমরে ঝুলছে মেজরের দেওয়া তরবারি।
বয়স ছাপ ফেলেছিল লেফটেন্যান্ট হিরু ওনোডার শরীরে। অত্যন্ত ক্লান্ত ও দুর্বল দেখতে লাগলেও, মাথা সোজা রেখে কমান্ডিং অফিসারকে স্যালুট করেছিলেন ওনোডা। মেজর তামাগুচি বলেছিলেন, “কথা দিয়েছিলাম, তাই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।” এরপর ওনোডার হাতে মেজর তামাগুচি তুলে দিয়েছিলেন, তাঁর লেখা রিলিজ অর্ডার। হাসি ফুটে উঠেছিল ওনোডার মুখে। ওনোডা (Hiroo Onoda) সেদিন বিশ্বাস করেছিলেন, সত্যিই থেমে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ক্ষমা করেছিলেন মার্কোস
ওনোডাকে (Hiroo Onoda) নিয়ে জাপানের বিমান উড়ে গিয়েছিল ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলার দিকে। বিমানে ছিল গুহায় লুকিয়ে রাখা ৫০০ রাউণ্ড কার্তুজ, প্রচুর হ্যান্ড গ্রেনেড ও একটি ‘হারাকিরি’ তরবারি। এই তরবারিটি ১৯৪৪ সালে ওনোডাকে দিয়েছিলেন তাঁর মা। ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকলে হারাকিরি বা আত্মহত্যা করার জন্য।
ম্যানিলা পৌঁছে ওনোডা আত্মসমর্পণ করেছিলেন ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি ফার্দিনান্দ মার্কোসের কাছে। প্রায় তিরিশটি হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন ওনোডার ও তাঁর তিন সাথী। তবুও ওনোডাকে মাপ করে দিয়েছিলেন ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি। মার্কোস বুঝেছিলেন, না বুঝেই হত্যাকাণ্ডগুলি ঘটিয়ে ফেলেছিলেন ওনোডো (Hiroo Onoda)। থেমে যাওয়ার পরও, টানা ২৯ বছর ধরে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে লড়ছিলেন এই জাপানি সৈনিক। এরপর ৫২ বছরের ওনোডোকে নিয়ে বিমান উড়ে গিয়েছিল জাপানের দিকে।
আবার ছেড়েছিলেন দেশ
জাপানে ফেরার পর রাজকীয় সম্বর্ধনা পেলেও, মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওনোডার (Hiroo Onoda)। কারণ বদলে গিয়েছিল তাঁর দেখা জাপান। সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন সম্রাট হিরোহিতো। দেশ চালাচ্ছিলেন রাজনীতিবিদেরা। জাপানের দিকে দিকে মাথা তুলেছিল বহুতল। উদীয়মান সূর্যের দেশের বুক চিরে ছুটছিল দ্রুতগামী ট্রেন। অত্যাধুনিক সরঞ্জাম উপচে পড়ছিল জাপানিদের ঘরে ঘরে। এই জাপানকে চিনতেন না ওনোডা।
এ ছাড়াও খ্যাতির আতিশয্য ভালো লাগেনি ওনোডার (Hiroo Onoda)। তিনি একটি শান্তির জীবন চেয়েছিলেন। হয়ত তাই কয়েক বছর পরেই দেশ ছেড়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ব্রাজিলের সাওপাওলোতে। ভিনদেশে থাকা এক জাপানি কলোনিতে জমি কিনে শুরু করেছিলেন পশু খামার। বিয়ে করেছিলেন স্থানীয় জাপানি নারীকে।
কিন্তু বছর দশেক পর, জাপানের একটি খবর তাঁর মনকে ব্যাকুল করে তুলেছিল। খবরের কাগজ তাঁকে জানিয়েছিল, এক জাপানি কিশোর প্রবল আক্রোশে কুচি কুচি করে কেটেছে নিজের বাবা মাকে। দ্রুত ব্রাজিল থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন ওনোডা (Hiroo Onoda)। যুদ্ধক্লান্ত জাপানের অশান্ত ও মানসিক সমস্যাযুক্ত শিশুদের জন্য স্থাপন করেছিলেন একটি বিদ্যালয়। প্রধান শিক্ষক হয়ে শুরু করেছিলেন, জাপানের নবীন প্রজন্মকে বাঁচানোর এক দুঃসাহসী লড়াই। সে লড়াই থেমে গিয়েছিল ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি। যেদিন টোকিওর হাসপাতাল থেকে চিরতরে জাপান ছেড়েছিলেন, জাপানের অনন্য রূপকথার অনন্য নায়ক, ৯১ বছরের হিরু ওনোডো।