
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
প্রেমের দিন তো প্রতি বছরই আসে ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে। অনেকেরই ইচ্ছে করে, এই দিনটা প্রিয়তম মানুষটির সঙ্গে উদযাপন করতে। প্রেমের নামে উৎসর্গ করা দিনটিতে মনের মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে। এমনটা চাইলে অনেকে করতে পারলেও, আর অনেকের মতো নিজেদের মনের মানুষের হাতে হাত রেখে ঘুরতে পারতেন না ওঁরা। ওঁরা পছন্দের মানুষের পাশে বসে, উপভোগ করতে পারতেন না প্রিন্সেপ ঘাটের সূর্যাস্ত। কারণ তাঁদের সামনে কড়া শাসনের লাঠি ধরে রাখত সমাজের রক্তচক্ষু! অপরাধ একটাই, ওঁরা একই লিঙ্গের মানুষকে ভালবেসেছেন! ওঁরা এলজিবিটি কমিউনিটির প্রতিনিধি।
তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি এলে ওঁরাও প্রেমের জোয়ারে গা ভাসাতে মুখিয়ে থাকলেও, পার্ক-রেস্তোরাঁর বাইরে বেরোনোর ভরসা তেমন হতো না তাঁদের। চুপিসারেই, নিভৃতে পার করতেন প্রেম দিবস। অবশ্য তাতেও পিছু ছাড়ত না কটূক্তি, টিটকিরি, বিদ্রুপ।
সেই ওঁরাই এবার ঠিক করেছিলেন প্রথম বার স্বাধীন ভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র আনন্দে মাতবেন। কারণ সুপ্রিম কোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়ের পরে এটাই প্রথম ১৪ ফেব্রুয়ারি।
সমকামিতা কোনও অপরাধ নয় বলে যুগান্তকারী সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছে গত বছরই। সেই রায়কে অস্ত্র করেই এলজিবিটি কমিউনিটির অনেকেই ভেবেছিলাম, এবার আর লুকিয়েচুরিয়ে নয়। ভয়ে ভয়ে নয়। এবার প্রকাশ্যে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে প্রেমের দিন উদযাপন করবেন। অনেকেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র প্ল্যানও করে নিয়েছিলেন।
যেমন রূপম (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে তাঁর কাছে এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে খুবই ‘স্পেশ্যাল’। হেসে বললেন, “প্রথম বার স্বাধীন প্রেমের দিন আমাদের। আমার কাছে খুবই স্পেশ্যাল। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দিঘায় যাব।”
রূপমের জীবনে অবশ্য প্রেম দিবস নিয়ে আগে আলাদা কোনও বিশেষ ব্যাপার ছিল না। বা বলা ভাল, ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। বললেন, “মাঝেমাঝে ইচ্ছে করত, এই দিনটায় একটু সেজেগুজে বেরোব। বয়ফ্রেন্ডকে গিফট কিনে দেব। ওর সঙ্গে ঘুরব। কিন্তু তখন নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। এবারটা অন্য রকম।”
আর এক রূপান্তরকামী তরুণী অনন্যাও (নাম পরিবর্তিত) বলছেন, “আমাদের জন্য এবার অন্য বারের চেয়ে বেটার হবে এই দিনটা।” যদিও এই মুহূর্তে অনন্যা কোনও বিশেষ সম্পর্কে নেই, তবু তিনি চান, তাঁর মতো যাঁরা আছেন, তাঁরা যেন এই দিনটা ইচ্ছেমতো আনন্দ করতে পারেন! তাঁদের যেন প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরার আগে ভাবতে না হয়, কে কী মনে করবে!
অনন্যার সঙ্গে একমত সমকামী অর্পণ। তিনি বললেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিই একটু হলেও বদলেছে। এবং যাঁরা এত দিন ইচ্ছে থাকলেও আমাদের সমর্থন করতে পারতেন না, তাঁরা আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এখন। আমরা এবার একটু খোলা মনে এই দিনটা উদযাপন করতে চাই।” আর এক রূপান্তরকামী, পেশায় গাড়ি চালক অংশুমানের কথায়, “আমার ধারণা, এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে অনেকটাই কালারফুল হবে।”
এলজিবিটি কমিউনিটির আর এক সদস্য সোহম বললেন, “আমরা কোনও দিনই অন্যায় করিনি। কিন্তু সেটা সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইনি বৈধতা জরুরি ছিল। আলাদা করে স্পেশ্যাল কিছুই হয়তো বদলাবে না, কিন্তু আমাদের কমিউনিটির সকলের মনোবল বেড়েছে। আমরা একটু বাড়তি জোর পেয়েছি। সেই জোরেরই প্রতিফলন ঘটতে পারে এই প্রেম দিবসে।”
একই কথা মেনে নিচ্ছেন একটি সমকামী সংগঠনের সদস্য। তিনি বললেন, তরুণ প্রজন্ম হয়তো কিছুটা উদ্দীপনা পাবে। রূপান্তরকামী অনসূয়া বললেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে এবার আমরা একটু বেশি সাহস পাব ভালবাসার মানুষের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করতে।”
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যতই রায় দিক, এলজিবিটি কমিউনিটির প্রতিনিধিরা যতই আশায় বুক বাঁধুন। সত্যিই কি তাঁরা পুরোপুরি স্বাধীন ভাবে ভালবাসা উদযাপন করতে পারবেন? এ প্রসঙ্গে অনন্যা বললেন, “সুপ্রিম কোর্ট যা-ই বলুক, সোশ্যাল ট্যাবু বা সামাজিক বাধা এখনও রয়েছে। সেখানে বদল আসতে এখনও অনেক দেরি। যত দিন না সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে, তত দিন সুপ্রিম কোর্টের হাজার রায়ের পরেও স্বাধীন ভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করা যাবে না।”
কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম রূপান্তরিত নারী। তিনি বললেন, “ভালবাসা যেমন কোনও আইন মানে না, তেমনই আইন বদলে আলাদা করে ভালবাসাকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। ভালবাসা চিরকালই নিজের সাহসে বেঁচেছে, মরেছে। তাই সমাজ যে দিন বদলাবে, সে দিন প্রতিটি দিনই প্রতিটা মানুষের ভ্যালেন্টাইন্স ডে হবে।”