Latest News

এই হিন্দু দেবীর সামনে আজও কেন মাথা ঝোঁকায় পাকিস্তান!

রূপাঞ্জন গোস্বামী

রূপাঞ্জন গোস্বামী

 করাচি থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, আরব সাগর থেকে ১৯ কিমি দূরে এবং সিন্ধু নদ থেকে ৮০ কিমি দূরে  অঘোর বা হিংগুল নদীর তীর। বালুচিস্তান প্রদেশের লাসবেলা জেলার হিংগুল ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে হিংগুল নদী। এই নদীর তীরে একটি দুর্গম পর্বতগুহায় বিরাজ করছেন বালুচিস্তানের জগতবিখ্যাত নানী। হিন্দুদের একান্নটি শক্তিপীঠের শ্রেষ্ঠ পীঠের অধিশ্বরী মাতা হিংলাজদেবী(Hinglaj Mata).

Hinglaj Mata
দেবী হিংলাজ

মরুতীর্থ  হিংলাজ (Hinglaj Mata)

এই পীঠকেই আমরা চিনি মরুতীর্থ  হিংলাজ নামে। সারা পাকিস্তানের মুসলিমরা চেনেন ‘নানী কি মন্দির’ নামে। সারা বিশ্বে এই দেবীর জুড়ি মেলা ভার। তিনি পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের পুরো প্রতিরক্ষার দায়িত্ব একা সামলান। তাই হিন্দুদেবীকে পুজো করেন বালুচ মুসলিমরাও। নিজেদের সাংসারিক সুরক্ষা ও মঙ্গল কামনায় এই দেবীর দরবারে আসেন তাঁরা।

মৌলবাদী অধ্যুষিত পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে প্রচুর হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন মন্দির ধূলিসাৎ করা হয়েছে, কিন্তু এই হিন্দু দেবীকে স্থানচ্যুত করা সম্ভব হয়নি। বালুচ মুসলিমদের বাধায় ও জাগ্রতা দেবীর কোপের ভয়ে। সময়ে অসময়ে দেবীর শরণাপন্ন হন পাকিস্তানের মন্ত্রী আমলারাও।

Hinglaj Mata Mandir
এই সেই গুহা

হিন্দু পুরাণ মতে, এই স্থানে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল

তাই দেবীকে এখানে ‘কোট্টারী’ ও তাঁর  ভৈরবকে ‘ভীমলোচন’ রূপে পূজা করা হয়। শিবসরিতা অনুসারে হিংলাজ পীঠটি হল একান্ন পীঠের প্রথম পীঠ। কুলার্ণব তন্ত্র অনুসারে আঠারোটি পীঠের তৃতীয় পীঠ। কুব্জিকা তন্ত্র অনুসারে বিয়াল্লিশটি সিদ্ধপীঠের পঞ্চম পীঠ।

কিন্তু হিংলাজ মাতার পীঠটি হিন্দুশাস্ত্রের সব পুস্তকেই  জাগ্রত শক্তিপীঠ হিসেবে বর্ণিত। হিংলাজ মাতা ও বিবি নানী ছাড়াও প্রচুর নাম এই  দেবীর, কোট্টরি, কোট্টভি, কোট্টরিশা নামেও তাঁকে ডাকা হয়।

Image - এই হিন্দু দেবীর সামনে আজও কেন মাথা ঝোঁকায় পাকিস্তান!
মুসলিমেরা বলেন বিবি নানী

নানী কি হজ

এপ্রিল মাসে করাচি থেকে ‘নানী কি হজ’ যাত্রা  শুরু  হয়।  হিংলাজ মাতার দরবারে তীর্থযাত্রীরা আসেন ভারত, পাকিস্তান ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রাচীন কালে তীর্থযাত্রীরা হিংলাজ যেতেন উটের পিঠে চড়ে৷ যাত্রা শুরু হত করাচি শহরের কাছে থাকা, হাব নদীর তীর থেকে। যাত্রীদের সঙ্গে থাকত এক মাসের রসদ, যেমন তাঁবু, জ্বালানি, চাল, ডাল, আটা, ঘি, তেল, মশলা, শুকনো খাবার, পানীয় জল ইত্যাদি৷ মরুদস্যুদের প্রতিরোধ করার জন্য থাকতো অস্ত্রশস্ত্রও।

তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে থাকত হিংলাজ মাতার প্রসাদের জন্য শুকনো নারকেল, মিছরি, বাতাসা ইত্যাদি৷ এক মাসের অত্যন্ত কষ্টকর যাত্রার পর শ্রান্ত তীর্থযাত্রীরা পৌঁছে যেতেন হিংলাজ। অঘোর নদীতে স্নান সেরে তাঁরা যেতেন হিংলাজ মাতাকে দর্শন করতে৷ এখন অবশ্য করাচি থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা পথ গাড়িতে পার হয়ে, মরুভুমির দুর্গম স্থানে অবস্থিত নানী কি মন্দিরে আসেন হিন্দু ও মুসলিম শ্রদ্ধালুরা।

Hinglaj_mata_mandir
নানী কি মন্দিরে আসেন হিন্দু ও মুসলিম শ্রদ্ধালুরা

পাহাড়ের গুহার মধ্যে বিরাজমান ‘মাতা হিংলাজ’ (Hinglaj Mata)

গুহার মধ্যে থাকা সিঁদুর লেপা পাথরখণ্ডটিই হলো হিন্দুদের হিংলাজ মাতা এবং বালুচ আদিবাসীদের আদরের ‘বিবি নানী’। গুহাটিই হলো হিংলাজ মাতার মন্দির বা নানী কি মন্দির। মন্দিরের ভেতরে আবহমান কাল ধরে জ্বলছে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড। যার অগ্নিশিখাকে হিংলাজদেবীর অপর রূপ বলে মানা হয়।

Shakti_Peeth_in_Pakistan

মন্দিরের কাছে আছে একটি কুণ্ড। কুণ্ডের মধ্যে অবিরাম ফুটে চলেছে কাদা মাটি। কিংবদন্তী রয়েছে, এই ফুটন্ত কুণ্ডের কাছে এসে অন্তর থেকে দেবীকে ডাকলে, পাপ স্খালন হয়। হিন্দুরা অর্ঘ্য হিসেবে দেবীকে দেন ফুল ও নারকেল। মুসলিমরা দেন সির্নি ও খেজুর।

ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয়ের কাহিনী

হিংলাজ মাতাকে নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো ব্রহ্মক্ষত্রিয়ের কাহিনী।

পরশুরাম তখন  ক্ষত্রিয় নিধনের উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করছেন। সেই সময় তিনি ক্ষত্রিয়ের খোঁজে আসেন এই মরুভূমিতে। তখন স্থানীয় ক্ষত্রিয়রা হিংলাজ মাতার শরণাপন্ন হন। হিংলাজ মাতা তখন ক্ষত্রিয়দের ব্রাহ্মণ রূপ দান করে পরশুরামের হাত থেকে বাঁচান। শুধু ক্ষত্রিয়দের  প্রাণই রক্ষা করেননি, পরশুরামকে এই হত্যালীলা বন্ধ করতে বাধ্য করেছিলেন ক্রুদ্ধ হিংলাজ মাতা।

আরও পড়ুন: ধ্বংস হওয়া মন্দিরে বিগ্রহ নেই, তবুও নীলম উপত্যকা জুড়ে আছেন নীল সরস্বতী

hinglaj_mata_temple_balochistan

দেবী পরশুরামকে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি মানুষ ব্রহ্মার সন্তান। আর ব্রহ্মত্ব আসে সুকর্মের মধ্যে দিয়ে। ক্ষত্রিয় নিধন করে পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য  করলেও ব্রহ্মত্ব প্রমাণ হয় না। পরশুরাম বুঝেছিলেন তিনি ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে ক্ষত্রিয় নিধনের সংকল্পে নেমে প্রকারন্তরে ব্রহ্মহত্যাই করছেন। অনুতপ্ত পরশুরাম ক্ষত্রিয়হত্যা থেকে সরে আসেন।

হিংলাজ মাতা বা বিবি নানীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকল তীর্থযাত্রী। সকল মনস্কামনা পূরণ করেন নানী। তাই নানীর মন্দির বুক দিয়ে আগলে রাখেন বালুচ মুসলিমরা। নানী মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে, তীর্থযাত্রার পুরোটাই তদারকি করেন তাঁরা। তাঁদের চিরাচরিত বিশ্বাস হিংলাজ মাতা বা বিবি নানী  তাঁদের পরিবারের একজন। তিনি বালুচিস্তানের আত্মার আত্মীয়। বালুচিস্তানের জনজীবনে যাঁর পূর্ণ অস্তিত্ব  ও কর্তৃত্ব আছে। তাই তো বালুচ মুসলিমরা হিংলাজ মাতাকে ডাকেন নানী বলে।

You might also like