
দ্য ওয়াল ব্যুরো: “ভালবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না, ভালবাসা লুটতরাজ কীর্তিনাশা,
একা মেয়েটার নরম গালের পাশে প্রহরীর মতো রাত জাগে ভালবাসা…“
এ ভালবাসার লাইনগুলো আমাদের খুব চেনা। এমন ভালবাসার ধরনও হয়তো চেনা। ভালবাসা হারানোর যুদ্ধ চেনা, ভালবাসা জিতে নেওয়ার লুটতরাজও চেনা। কিন্তু সত্যিকারের প্রহরীর মতো যে ভালবাসা রাত জাগে বছরের পর বছর, নিশ্চুপে, কোনও প্রাপ্তির আশা ছাড়াই, তাকে কি সত্যিই চিনেছি আমরা? পেরেছি সেই ভালবাসাকে ছুঁতে? হয়তো পারিনি। পারিনি বলেই আমাদের অবাক করবে চিনের এক বৃদ্ধ মানুষ জ্যু-এর কাহিনি।
এই ভ্যালেন্টাইন্স দিবসেই স্ত্রীয়ের সঙ্গে ৫০ বছরের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করলেন তিনি। বেলুন, কেক, উপহারে ভরিয়ে তুললেন তাঁদের বিশেষ দিনটি। না, এটুকুতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবাক হতে হয় তখন, যখন দেখা যায় এ সব কিছু ছুঁয়ে দেখা দূরের কথা, টেরটুকুও পাচ্ছেন না জ্যুয়ের স্ত্রী ওয়াং। চোখ বুজে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে রয়েছেন তিনি। গত তিন বছর ধরেই। চিকিৎসা পরিভাষায় এ ঘুমের নাম কোমা। তাতে কী? সত্যিকারের ভালবাসা কি অসুখে ফিকে হয়?
সালটা ২০১৬। শীতের রাত। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যাওয়ার আয়োজন করছিলেন চিনের ঝিজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা, বৃদ্ধ দম্পতি জ্যু এবং ওয়াং। তার আগে শৌচালয়ে যেতে গিয়ে আচমকাই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান বৃদ্ধা ওয়াং। চোট পান মাথায়। কাটাছেঁড়া না হলেও, চোট ছিল গভীর। পরীক্ষায় ধরা পড়ল, মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রবল। দ্রুত অস্ত্রোপচার করলেন চিকিৎসকেরা। প্রাণে বাঁচালেন ৭৫ বছরের ওয়াংকে। কিন্তু কোমায় চলে গেলেন তিনি। চিকিৎসকেরা জানালেন, মিরাকেল না হলে এই কোমা থেকে জাগার সম্ভাবনা নেই ওয়াংয়ের।
সে শীতের পরেই বসন্ত এল। জ্যু আর ওয়াং এত বছর বড় আনন্দের সঙ্গে স্বাগত জানাতেন বসন্তকে। কারণ, বসন্তের প্রথম দিনে, ভ্যালেন্টাইন্স দিবসেই তাঁদের বিবাহ বার্ষিকী যে! প্রতি বছরই এই দিনটি মনের মতো করে উদযাপন করতেন তাঁরা।
কিন্তু তিন বছর আগের সেই দিনে হয়ে গেল ব্যতিক্রম। হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের বিছানায় চোখ বুজে রইলেন ওয়াং। জ্যু হাজার বার ডেকেও সাড়া পেলেন না। তাতে অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নন বৃদ্ধ মানুষটি। দমার নয় তাঁর ভালবাসাও। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে জ্যু ফুল এনে রাখলেন ওয়াংয়ের মাথার কাছে। ওয়াংয়ের হাত ধরে উইশ করলেন শুভ দিনের।
তার পর থেকে চলছে একই নিয়ম। এ বছরের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে তাঁদের ৫০তম বিবাহবার্ষিকী। বিয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপন একেবারে সাদামাঠা হবে, তা কি হতে পারে?
ওয়াংয়ের পছন্দের স্বাদের কেক আনা হল। নানা রঙের বেলুন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হাসপাতালের কেবিন। জ্যু সামনে এনে রাখলেন তাঁদের বিয়ের সময়ের আংটি। জড়ো হলেন চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী, নার্সরা। নিচু স্বরে বাজল প্রেমের গান। কাঁপা হাতে স্ত্রীয়ের হাতটা ধরে কেক কাটলেন জ্যু। মুহূর্তের জন্য আঙুলে পরিয়ে দিলেন বিয়ের আংটি। প্রিয়তমার কপালে রাখলে চুম্বন। ওয়াং একই ভাবে ঘুমিয়ে রইলেন চোখ বুজে। শুধু তাঁর মাথার কাছে রাখা যন্ত্র জানান দিল, হৃদপিণ্ডটুকু ধুকপুক করছে ওয়াংয়ের বুকের ভিতর।
এমন আবেগঘন মুহূর্তে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি কেউ। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভরে গিয়েছে এ অবিস্মরণীয় ভালবাসার উদযাপন। চিনের একটি সংবাদমাধ্যমকে জ্যু জানিয়েছেন, তাঁরা খুব ভালবাসতেন পরস্পরকে। প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করতেন আনন্দ করে। বেঁচে থাকলে ৫০ বছরের বিবাহবার্ষিকী কেমন করে পালন হবে, তা আগে থেকে ঠিকও করে রেখেছিলেন তাঁরা। সেই প্রতিশ্রুতি এভাবেই রক্ষা করলেন জ্যু।
শুধু তা-ই নয়। ঝিজিয়াং প্রদেশের হেইনিংয়ের ওই হাসপাতাল জানিয়েছে, গত তিন বছরে মাত্র তিনটি দিন বাদে অচেতন স্ত্রী-র পাশে রোজ এসে সময় কাটিয়েছেন জ্যু। যে তিন দিন তিনি আসতে পারেননি হাসপাতালে, সেই দিনগুলোতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ জ্যু।
ওয়াংয়ের দিকে তাকিয়ে জ্যু বলেন, “চিকিৎসকেরা আমায় বলেছেন, এমন কোমা থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা এক লাখে এক জন। কিন্তু ওই এক জন তো আমার স্ত্রী-ও হতে পারেন! তাই যতদিন পর্যন্ত আমার স্ত্রীর চেতনা ফিরে আসার ক্ষীণতম সম্ভাবনা থাকবে, তত দিন পর্যন্ত আমি হাল ছাড়ব না। এভাবেই ভালবাসব, পাশে থাকব।”
নেটিজেনরা বলছেন, সঙ্গীকে ভালবেসে আমরণ পাশে থাকার অঙ্গীকার সকলেই করেন কখনও না কখনও। কিন্তু এভাবে তা পালন করতে পারেন না সকলে। জ্যু-ওয়াংকে দেখে ভালবাসার অর্থ শেখার আছে বলেই মনে করছেন সকলে।