Latest News

ভগবান বুদ্ধের পোশাক নিয়ে কে বসে আছেন গুরপা পাহাড়ে, কার প্রতীক্ষায়!

রূপাঞ্জন গোস্বামী

আসানসোল-গয়া এক্সপ্রেস করে গয়া গেলে, গয়া জংশন থেকে ৪৭ কিলোমিটার আগে পড়বে ছোট্ট একটি স্টেশন। শান্ত ও নির্জন স্টেশনটির নাম ‘গুরপা’ (Gurpa)। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আসার পর, দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে এক পাহাড়। পাহাড়টির নামও ‘গুরপা’। স্টেশন থেকে পাহাড়টির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। লাল মাটির রুক্ষ পথ এগিয়ে চলবে পাহাড়টির দিকে। আপনাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসবে আম, জাম, কাঁঠাল গাছের ছায়া ঘেরা একটি গ্রাম। গ্রামটির নামও ‘গুরপা’ (Gurpa)।

Gurpa Hill
গুরপা পাহাড়

গ্রামকে পিছনে ফেলে রেখে রাঙামাটির পথ এগিয়ে যাবে আপনাকে নিয়ে। পথকে ক্রমশ ঢেকে ফেলতে থাকবে ঘন অরণ্য। মিনিট চল্লিশ হাঁটার পর, দূরে সরে যাবে অরণ্য। দেখা দেবে বুনো ঝোপের দল ও রাশি রাশি বোল্ডার। লালমাটির পথকে আচমকা সরিয়ে দিয়ে, আপনাকে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকবে রুক্ষ পাহাড়ি পথ। নিয়ে যাবে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো সিঁড়ির কাছে। খাড়া পথে পাহাড় পেঁচিয়ে উঠতে থাকবে সিঁড়ি। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে সিঁড়ি ভাঙার পর আপনি যখন ক্লান্তির শেষ সীমায়, আপনার সামনে এগিয়ে আসবে এক ফালি পাথুরে চাতাল।

চাতালে পৌঁছনোর পর পাথরের ওপর বসে পড়বেন আপনি। আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ঝোড়ো হাওয়া। বুনোঝোপ থেকে উড়ে এসে আপনাকে দেখে যাবে মৌমাছির দল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর, পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পথ খুঁজবেন আপনি। কিন্তু পাহাড়ের গায়ে থাকা একশো ফুটের লম্বা ফাটল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়বে না। পাথরের গায়ে আঁকা তির চিহ্ন আপনাকে জানাবে, পথ এগিয়েছে ফাটলটির বুক চিরে।

Gurpa Hill
এই সেই ফাটল

সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক ফাটলটি খুব বেশি হলে দু’ফুট চওড়া। অন্ধকার ফাটলটির ভেতর দিয়ে পথ ক্রমশ উঠে গেছে ওপরে। ফাটলটির ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় বাড়তে থাকবে আপনার হৃদস্পন্দন। প্রায় দুশো ফুট যাওয়ার পর, আপনি পৌঁছবেন একটি গুহার সামনে। গুহাটির একপাশে হিন্দিতে লেখা আছে মহাকশ্যপ গুম্ফা। তিনটি বিশাল পাথর ঝুঁকে পড়ে তৈরি করেছে গুহাটি। হিমশীতল গুহার মধ্যে একটি সোনালি সিংহাসন। তার ওপর পদ্মাসনে যিনি বসে আছেন, তাঁকে এক ঝলক দেখে ভগবান বুদ্ধ বলে মনে হলেও, পরমুহূর্তেই বুঝবেন মূর্তিটি বুদ্ধের নয়।

Image - ভগবান বুদ্ধের পোশাক নিয়ে কে বসে আছেন গুরপা পাহাড়ে, কার প্রতীক্ষায়!
কে এই মহামানব!

গুহার একপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড় চূড়ায়। সম্মোহিতের মত আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকবেন আপনি। একসময় পৌঁছে যাবেন পাহাড় চূড়ায়। প্রথমেই আপনার নজর কাড়বে সূর্যের আলোয় কাঁচাসোনার মত ঝলমল করতে থাকা অতিকায় এক চোর্তেন ( স্তুপ) ও অজস্র রংবেরঙের ধর্মীয় পতাকা লুং-লা। সুদৃশ্য চোর্তেনটির পাশেই দুটি মন্দির।

সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মের অপূর্ব সহাবস্থান দেখে মুগ্ধ হবেন আপনি। ভুলে যাবেন ১৮০০ সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট। চূড়ায় থাকা সাইনবোর্ড আপনাকে জানাবে, পাহাড়টির প্রাচীন নাম ছিল ‘কুক্কুটপাদগিরি’। কারণ পাহাড়টির আকৃতি, মুরগির পায়ের মত। এছাড়াও পাহাড়টি গুরুপাদগিরি ও বিষ্ণুপাদগিরি নামেও পরিচিত। স্থানীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই পাহাড়েই অবতীর্ণ হয়েছিলেন শ্রীবিষ্ণুর পঞ্চাশতম অবতার। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে পাহাড়ের চূড়ায় মেলার আয়োজন করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।

গুরপা পাহাড় কথা বলতে পারলে, এক অজানা কাহিনি শোনাত আপনাকে। শোনাত সেই রহস্যময় মানুষটির কথা। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে যিনি আত্মগোপন করে আছেন গুরপা পাহাড়ে (Gurpa Hill)। বিশেষ এক উদ্দেশ্য নিয়ে। যাঁর খোঁজে হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে পাহাড়ে ছুটে এসেছেন ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ। ছুটে এসেছেন স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, চতুর্দশ দলাই লামা ‘লামো থন্ডুপ’।

কিসের আকর্ষণে দেশ বিদেশ থেকে গুরপা পাহাড়ে ছুটে আসেন বৌদ্ধরা!

কে এই রহস্যময় পুরুষ!

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। মগধের মহাতিত্থা গ্রামে, ভূস্বামী নিয়গ্রোধের স্ত্রী সুমনা দেবী এক শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। পিপুল গাছের তলায় জন্ম হওয়ায়, শিশুপুত্রটির নাম রাখা হয়েছিল ‘পিপ্পলি’। ছোটবেলা থেকেই পিপ্পলি ছিলেন ধর্মপ্রাণ। যে বয়সে ছেলের দল মাঠে খেলত, ঘরে বসে বেদ মুখস্ত করতেন পিপ্পলি। ছেলের মতিগতি দেখে, যুবক হওয়া মাত্রই ছেলেকে সংসারী করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বাবা মা।

পিপ্পলির বিয়ে দেওয়া হয়েছিল কপিলাবস্তুর অসামান্য রূপসী ভদ্রার সঙ্গে। বিয়েতে প্রথমে রাজি হননি ভদ্রা। কারণ পিপ্পলির মতই ভদ্রাও তাঁর জীবন সঁপে দিয়েছিলেন ধর্মের হাতে। তাই বিয়ের পর একসঙ্গে বসবাস করলেও, একই শয্যায় শুতেন না পিপ্পলি ও ভদ্রা। কিছুদিন পর দুজনেই সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ভিক্ষার বাটি হাতে, এক বস্ত্রে ঘর ছেড়েছিলেন তাঁরা। কয়েক মাইল যাওয়ার পর, দুই দিকে বেঁকে গিয়েছিল দুজনের চলার পথ।

ভারতের পথে পথে দু’বছর ঘুরে বেড়াবার পর, পিপ্পলি ফিরে এসেছিলেন মগধে। পথিকদের মুখে ভগবান বুদ্ধের ( Gautama Buddha) নাম শুনে, পিপ্পলি পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজগৃহ (রাজগীর) নগরের বেনুবনে থাকা গৌতম বুদ্ধের আশ্রমে। পিপ্পলির গলানো সোনার মত গায়ের রঙ তখন তামাটে। মুখে লম্বা দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল। গৌতম বুদ্ধ তখন একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে, শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

Image - ভগবান বুদ্ধের পোশাক নিয়ে কে বসে আছেন গুরপা পাহাড়ে, কার প্রতীক্ষায়!
বেনুবনে ভগবান বুদ্ধ

শিষ্যদের পিছনে বসে পড়েছিলেন পিপ্পলি। প্রভু বুদ্ধের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এসে পড়েছিল পিপ্পলির ওপর। পিপ্পলির অন্তরাত্মা বলেছিল, “এই মানুষটির খোঁজেই তুমি ঘুরে বেড়িয়েছ ভারতের পথে পথে।” বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছিল রাজগৃহ নগরে। আশ্রম থেকে বেরিয়ে, ঘন অরণ্যের অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে চলেছিলেন পিপ্পলি। হঠাৎই অরণ্যের এক জায়গায়, আলো দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। কাছে গিয়েই চমকে উঠেছিলেন। এক অশ্বত্থ গাছের তলায় পদ্মাসনে বসে আছেন প্রভু বুদ্ধ। পিপ্পলির দু’চোখ বেয়ে নেমে এসেছিল জলের ধারা। ঈশ্বর প্রেরিত দূত না হলে, একই সময় দুই জায়গায় থাকতে পারেন না কোনও মানুষ।

প্রভু বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন পিপ্পলি। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “হে প্রভু আমায় গ্রহণ করুন। আমায় দীক্ষা দিন।” নীল পদ্মের মত চোখ দুটি মেলে বুদ্ধ বলেছিলেন,”এই পৃথিবীতে তোমাকে দীক্ষা দেওয়ার মত গুরু নেই। কারণ তুমি মহাকশ্যপ। তুমি আমাকে তোমার শিষ্য করে নাও।” কথাটি বলেই প্রভু বুদ্ধ মিলিয়ে গিয়েছিলেন অন্ধকারে। উদভ্রান্তের মত পিপ্পলি ছুটেছিলেন বেনুবনের দিকে। তিনি তখনও জানতেন না, গৌতম বুদ্ধ এর আগেও বহুবার জন্ম নিয়েছিলেন। তৃতীয় বুদ্ধের নাম ছিল ‘কশ্যপ বুদ্ধ’।

নির্বাণ’ পথের এক অক্লান্ত পথিক

বেনুবনকে ঘিরে ধরেছিল সন্ধ্যার অন্ধকার। আশ্রমে টিম টিম করে জ্বলছিল তেলের প্রদীপ। প্রভু বুদ্ধ তখনও বসেছিলেন অশ্বত্থ গাছের নীচে। পিপ্পলিকে দেখে, স্মিত হেসে পাশে বসতে বলেছিলেন বুদ্ধ। পিপ্পলি বসেছিলেন প্রভুর পায়ের কাছে। সেই রাতে পিপ্পলিকে দীক্ষা দিয়েছিলেন বুদ্ধ। জীবন থেকে মুছে গেছিল পিপ্পলি নামটি। নবজন্ম লাভ করা পিপ্পলির নাম হয়েছিল ভান্তে মহাকশ্যপ(Mahakashyapa)।

Gurpa Hill
মহাকশ্যপ

কালক্রমে মহাকশ্যপ হয়ে উঠেছিলেন বুদ্ধের অন্যতম প্রিয় শিষ্য। কিন্তু বুদ্ধের অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ভগবান বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য ও সেবক আনন্দের সঙ্গে। আনন্দের অনুপ্রেরণায় মগধের নারীরা সংসার ছেড়ে দলে দলে ভিক্ষুণী (সন্ন্যাসিনী) হতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের ভিড়ে মহাকশ্যপ একদিন দেখেছিলেন এক নারীকে। কামানো মাথা। হাতে ভিক্ষার বাটি। স্ত্রী ভদ্রাকে চিনতে পেরেছিলেন মহাকাশ্যপ। তবুও তিনি চাইতেন না, অবাধে আশ্রমে প্রবেশ করুন নারীরা। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার পবিত্রতা যে কোনও মূল্যে রক্ষা করতে চাইতেন। কিন্তু প্রভু বুদ্ধের বেশিরভাগ শিষ্য রাজি থাকায়, আশ্রমে ভিক্ষুণীদের অবাধ প্রবেশ, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন মহাকশ্যপ।

“তোমার বস্ত্র আমায় দাও”

বুদ্ধের পদতলে এভাবেই দিন কাটছিল মহাকশ্যপের। একদিন বুদ্ধ শিষ্যদের সামনে মহাকশ্যপকে বলেছিলেন,”তোমার বস্ত্র আমায় দাও। আমার বস্ত্র তুমি নাও।” স্তম্ভিত হয়ে গেলেও, প্রভুর আদেশ পালন করেছিলেন মহাকশ্যপ। নিজের বস্ত্র প্রভুকে দিয়ে, মাথা নিচু করে হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রভুর বস্ত্র। গৌতম বুদ্ধ ছিন্ন বস্ত্রটি সংগ্রহ করেছিলেন শ্মশান থেকে। বস্ত্রটি দিয়ে ঢাকা ছিল, এক নারী ক্রীতদাসের শব। বুদ্ধের বস্ত্রটি গায়ে দেওয়া মাত্র, শিহরণ জেগেছিল মহাকশ্যপের শরীর জুড়ে। প্রভু বুদ্ধ বলেছিলেন, “আমার এই জীর্ণ বস্ত্রটি আগলে রেখো।”

এই ঘটনাটির পর, বৌদ্ধদের কাছে মহাকশ্যপের উচ্চতা আকাশ ছুঁয়েছিল। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করতেন, বস্ত্র বিনিময়ের মাধ্যমে ভগবান বুদ্ধ তাঁর দিব্যজ্ঞান দান করেছিলেন মহাকশ্যপকে। ক্রমশ নিজেকে জগত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছিলেন মহাকাশ্যপ। ধ্যনমগ্ন হয়ে পাহাড়ের গুহায় কাটাতেন দিনের বেশিরভাগ সময়। গৌতম বুদ্ধ তাঁকে বলেছিলেন, সবসময় ধ্যানে মগ্ন না থেকে, তাঁর সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে। কিন্তু মহাকশ্যপ বলেছিলেন, “ধ্যানের মাধ্যমে আমি আপনার আরও কাছে যাওয়ার সৌভাগ্যলাভ করি প্রভু।”

Gurpa Hill
অসুস্থ মহাকশ্যপের পাশে ভগবান বুদ্ধ

অমরলোকে ফিরে গেলেন প্রভু

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ (আনুমানিক)। ভগবান বুদ্ধের বয়স তখন আশি। একদিন শিষ্যদের ডেকে ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন, তাঁর মহাপরিনির্বাণের সময় হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে বিদায় নিতে হবে। এরপর শিষ্যদের নিয়ে কুশীনগরের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধ। পথের ধারে ছিল পাওয়া নামে এক গ্রাম। সেই গ্রামের বাসিন্দা, এক কামারের বাড়িতে খাবার খাওয়ার পর, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ। প্রভুর পায়ে লুটিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন কামার। স্মিত হেসে প্রভু বলেছিলেন, কামারের দেওয়া খাবার তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। কারণ তাঁর ফিরে যাওয়ার ডাক, আগেই এসে গেছে।

অসুস্থ শরীর নিয়ে কুশীনগর পৌঁছানোর পর, ভগবান বুদ্ধ শিষ্যদের বলেছিলেন, তাঁকে যেন দুটি শালগাছের মধ্যে থাকা জমিতে শুইয়ে দেওয়া হয়। প্রভুর নির্দেশ মেনে, একফালি সাদা কাপড়ের ওপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল ভগবান বুদ্ধকে। শেষশয্যায় শুয়ে ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন, “জগতের কোনও বস্তুই চিরস্থায়ী নয়, সব বস্তুর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। তাই নিষ্ঠাভরে নিজের মুক্তির চেষ্টা করে যাও।” এরপর চিরতরে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ। শিষ্যদের কাঁদিয়ে, পাড়ি দিয়েছিলেন অমরলোকে।

তাঁর কোনও উত্তরসূরীর নাম বলে যাননি বুদ্ধ। কিন্তু তাঁর উত্তরসুরী হিসেবে মহাকশ্যপকেই মেনে নিয়েছিলেন সবাই। প্রভু বুদ্ধের অমৃতবাণী ও দর্শনকে চিরজাগ্রত করে রাখার জন্য মহাকশ্যপ গড়ে তুলেছিলেন প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্ঘ। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে সঙ্ঘকে বুকে আগলে রাখার পর, দায়িত্বভার তুলে দিয়েছিলেন তাঁরই সবথেকে বড় সমালোচক আনন্দের হাতে। তারপর মহাকশ্যপ ডুব দিয়েছিলেন প্রভু বুদ্ধের ভাবসাগরে।

গুরপা পাহাড়ে, আগামী বুদ্ধের অপেক্ষায়

মহাকশ্যপের বয়স তখন একশো কুড়ি। প্রভু বুদ্ধের দেওয়া বস্ত্রটি পরে, শেষবারের মত মুষ্টিভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন মহাকশ্যপ। শেষবারের মত দেখা করার জন্য পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজা অজাতশত্রুর প্রাসাদে। রাজা বিশ্রামে থাকায় মহাকশ্যপকে ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রহরীরা। মহাকাশ্যপ ধরেছিলেন তাঁর অন্তিম পথ। যে পথ এসে শেষ হয়েছিল গায়ে গায়ে জুড়ে থাকা তিনটি পাহাড়, কুক্কুটপাদগিরির সামনে।

মহাকাশ্যপের পদধ্বনি শুনে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তিনটি পাহাড়। পাহাড়গুলির মাঝখানে পদ্মাসনে বসে পড়েছিলেন মহাকশ্যপ। গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলেন প্রভু বুদ্ধের দেওয়া বস্ত্র। শিষ্যদের চোখের জলে ভিজে গেছিল পাহাড়ের রুক্ষ পাদদেশ। শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে মহাকাশ্যপ বলেছিলেন, “আমার শরীরে পচন ধরবে না। আমি এই পাহাড়ের বুকে বসে অপেক্ষা করব আগামী বুদ্ধের জন্য। পৃথিবীর বুকে পা রাখার পর, এই পাহাড়ে আসবেন আগামী বুদ্ধ ‘মৈত্রেয়’। প্রভু গৌতম বুদ্ধের দিয়ে যাওয়া বস্ত্র আমি তুলে দেব প্রভু মৈত্রেয় বুদ্ধের হাতে। তারপর লাভ করব মহাপরিনির্বাণ।”

Image - ভগবান বুদ্ধের পোশাক নিয়ে কে বসে আছেন গুরপা পাহাড়ে, কার প্রতীক্ষায়!
আগামী বুদ্ধ ‘মৈত্রেয়

তিনটি পাহাড় আবার কাছাকাছি আসতে শুরু করেছিল। বুকে লুকিয়ে নিচ্ছিল মহাকশ্যপের অস্থিচর্মসার শরীর। খবর পেয়ে আনন্দকে নিয়ে, রথ চালিয়ে কুক্কুটগিরিতে এসেছিলেন রাজা অজাতশত্রু। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে ভগবান বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য মহাকশ্যপকে শেষবারের মত দেখেছিলেন তাঁরা। পদ্মাসনে বসে ছিলেন মহাকশ্যপ। পরনে প্রভু বুদ্ধের দেওয়া সেই বস্ত্র। অজাতশত্রু চেয়েছিলেন মহাকশ্যপের পার্থিব শরীরকে সমাধি দিতে। কিন্তু আনন্দ বলেছিলেন, “ভান্তে মহাকশ্যপ তো মৃত নন। জীবিত মহাত্মাকে কী করে সমাধি দেবেন মহারাজ!” এরপর শোকস্তব্ধ অজাতশত্রু, মহাকশ্যপের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পাহাড়চূড়ায় নির্মাণ করেছিলেন একটি স্তুপ।

আজও গুরপা পাহাড়ে আছে অজাতশত্রু নির্মিত সেই স্তুপের ধ্বংসাবশেষ। আজও গুরপা পাহাড়ে পদ্মাসনে বসে আছেন মহাকশ্যপ। আগামী বুদ্ধ মৈত্রেয়র অপেক্ষায়। মৈত্রেয় বুদ্ধ গুরপা পাহাড়ে পা রাখার পর, আবার তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে গুরপা পাহাড়। আড়াই হাজার বছর পর, আসন থেকে উঠে দাঁড়াবেন মহাকশ্যপ। প্রভু মৈত্রেয় বুদ্ধকে প্রণাম করে তাঁর হাতে তুলে দেবেন প্রভু গৌতম বুদ্ধের দিয়ে যাওয়া বস্ত্র। তারপর সাদা পায়রা হয়ে উড়ে যাবেন বুদ্ধলোকে। তাই সারা পৃথিবীর বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন, আজও জীবিত আছেন মহাকাশ্যপ। আজও নাকি প্রতি সন্ধ্যায় গুরপা পাহাড় নিস্তব্ধ হয়ে গেলে, শোনা যায় তাঁর কন্ঠ। ফাটলের ভেতর থেকে ভেসে আসে সেই অমৃতবাণী,“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি: ধম্মং শরণং গচ্ছামি: সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।”

Gurpa Hill

আরও পড়ুন: হিমালয়ের গহনে আজও নাকি লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় নগররাষ্ট্র, নাম তার ‘জ্ঞানগঞ্জ

You might also like